অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার প্রসঙ্গে চৌরিচৌরা ঘটনা, আন্দোলন প্রত্যাহার, হিংসার বিরোধী গান্ধীজি, গান্ধীজির অভিমত, গান্ধীজির জনপ্রিয়তা হ্রাস, খিলাফত আন্দোলন বন্ধ, আন্দোলন প্রত্যাহারের সমালোচনা হিসেবে নিন্দা প্রকাশ, সুযোগ হাতছাড়া, নেতাদের ছিনিমিনি খেলা, জাতীয় বিপর্যয়, নেতৃবৃন্দের দুর্বলতা, আন্দোলন প্রত্যাহারের যুক্তি হিসেবে হিংসা নিয়ন্ত্রণ, ব্রিটিশরাজের অত্যাচার প্রতিরোধ, হিংসাত্মক আন্দোলন, কৃষকদের মনোবল, অভিভাবকদের ক্ষোভ, মুসলিম সমাজের উৎসাহ হ্রাস ও আন্দোলনে ভাটার টান সম্পর্কে জানবো।

অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার

ঐতিহাসিক ঘটনাঅসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার
সূচনাকাল১৯২০ খ্রিস্টাব্দ
লক্ষ্যস্বরাজ অর্জন
পন্থাঅহিংস অসহযোগ
নেতামহাত্মা গান্ধী
প্রত্যাহার২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ
ফলাফলব্যর্থতা
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার

ভূমিকা:- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। দেশব্যাপী এক বিরাট উন্মাদনা সৃষ্টি হলেও মাঝপথেই এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

চৌরিচৌরা ঘটনা

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা নামক স্থানে প্রায় তিন হাজার কৃষক জনতার এক শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। উত্তেজিত জনতা তাদের আক্রমণ করলে তারা থানায় আশ্রয় গ্রহণ করে। উত্তেজিত জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করে এবং তাতে ২২ জন পুলিশের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা চৌরিচৌরা ঘটনা নামে পরিচিত।

আন্দোলন প্রত্যাহার

চৌরিচৌরা ঘটনায় শান্তির পুজারি গান্ধীজি খুবই মর্মাহত হন এবং ১২ই ফেব্রুয়ারি বারদৌলিতে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির সভায় অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের প্রস্তাব দেন। ২৫ শে ফেব্রুয়ারি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।

হিংসার বিরোধী গান্ধীজি

গান্ধীজি অহিংস আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, আন্দোলনকে তিনি হিংসার মুখে ঠেলে দিতে রাজি ছিলেন না। ইতিপূর্বে বোম্বাই (১৭ই নভেম্বর, ১৯২১ খ্রিঃ) এবং মাদ্রাজে (১৩ই জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিঃ) হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলেও, চৌরিচৌরার ঘটনা তাঁর কাছে ছিল ‘চরমতম অপমান’।

গান্ধীজির অভিমত

তিনি লিখছেন “মাদ্রাজ আমাকে সর্তক করে দেয়, কিন্তু আমি গুরুত্ব দিই নি। চৌরিচৌরা ঘটনার মাধ্যমে ঈশ্বর আমার কাছে স্পষ্ট নির্দেশ পাঠান” (“Madras give the warning, but I heeded not. But God spoke clearly through Chauri Chaura.”)।

গান্ধীজির জনপ্রিয়তা হ্রাস

গান্ধীর এই কাজে সারা দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রভূত পরিমাণে হ্রাস পায় এবং এই সুযোগে ১০ই মার্চ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধ

এই সময় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে কামাল পাশা-র নেতৃত্বাধীন ‘তরুণ তুর্কী’ দল তুরস্ক-এর সুলতান বা খলিফাকে গদিচ্যুত করলে ভারতেও খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়।

আন্দোলন প্রত্যাহারের সমালোচনা

গান্ধীজির আন্দোলন বন্ধের আকস্মিক সিদ্ধান্তে সমগ্র দেশবাসী হতাশা ও ক্ষোভে মর্মাহত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ভাবে তার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়। যেমন –

(১) নিন্দা প্রকাশ

চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, লালা লাজপৎ রায় প্রমুখ সকল নেতাই গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেন।

(২) সুযোগ হাতছাড়া

সুভাষ চন্দ্র বসুর The Indian Struggle’ থেকে জানা যায় যে, কারারুদ্ধ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ “এই ঘটনায় ক্রোধে অস্থির হয়ে ওঠেন।” তিনি বলেন যে, “সারা জীবনের মতো সুযোগ হাতছাড়া হল।”

(৩) নেতাদের ছিনিমিনি খেলা

লালা লাজপৎ রায় লেখেন যে, “আমরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম”। কংগ্রেস নেতা মুঞ্জে বলেন, “দেশের সম্মান ও গৌরব নিয়ে নেতারা ছিনিমিনি খেলছেন।”

(৪) জাতীয় বিপর্যয়

সুভাষচন্দ্র বসু এই ঘটনাকে ‘জাতীয় দুর্দৈব’ (‘national calamity’) বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি লেখেন যে, জনসাধারণের উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই আন্দোলন প্রত্যাহার করা একটি জাতীয় বিপর্যয় ছাড়া অন্য কিছু নয়।

(৫) কংগ্রেস কর্মীদের মনোভাব

জওহরলাল নেহরু গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তে ‘বিস্মিত ও হতবাক’ হন। তাঁর মতে তরুণ কংগ্রেস কর্মীদের মনোভাব ছিল খুবই উগ্র। মতিলাল নেহরু বলেন, “একটি স্থানের একটি জনতার পাপের জন্য গান্ধীজি গোটা দেশবাসীকে শাস্তি দিলেন।”

(৬) বন্ধের আদেশ বিপজ্জনক

রোমা রোলাঁ বলেন যে, “একটি দেশের সকল শক্তি একজনের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে বিপদ রয়েছে এবং যে সময় একটি আন্দোলন চরম সীমায় পৌঁছেছে সেই মুহূর্তে সেই আন্দোলন বন্ধ করার জন্য আদেশ দেওয়া আরও বিপজ্জনক।”

(৭) নেতৃবৃন্দের দুর্বলতা

মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনী পাম দত্ত বলেন, “যুদ্ধ শেষ। সমগ্র অভিযানও শেষ হয়ে গেল। পর্বত বাস্তবে মুষিক প্রসব করল।” এম.এন.রায় এর মধ্যে গণশক্তির নয়, নেতৃত্বের দুর্বলতার সুস্পষ্ট পরিচয় পান।

(৮) আগ্ৰহ ও আত্মদানের প্রচেষ্টার বলি

মুজাফ্ফর আহমদ গান্ধীজিকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেন। লুই ফিশার বলেন যে, গান্ধীর একটি কথাতেই সারা ভারত বিদ্রোহে ফেটে পড়তে পারত, কিন্তু তাঁর সেই কথাটি আর বলা হল না। এর পরিবর্তে জনসাধারণের সকল আগ্রহ ও আত্মদানের প্রচেষ্টাকে তিনি অহিংসার যূপকাষ্ঠে বলি দিলেন।

আন্দোলন প্রত্যাহারের যুক্তি

এই সব সমালোচনা সত্ত্বেও বলতে হয় যে, গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলা যায় না। কারণ,

(১) হিংসা নিয়ন্ত্রণ

এই আন্দোলন ছিল অহিংস এবং এতে হিংসার প্রবেশ সম্পূর্ণ নীতি বিরোধী ছিল। গান্ধীজি ইয়ং ইণ্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন “আমি সকল প্রকার অপমান, এমনকী নির্যাতন, পূর্ণ নির্বাসন এবং মৃত্যুবরণে প্রস্তুত। কিন্তু আমি আন্দোলনকে হিংসার পথে যেতে দিতে পারি না। দেশব্যাপী হিংসার প্রকাশ ঘটলে কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে?”

(২) ব্রিটিশরাজের অত্যাচার প্রতিরোধ

গান্ধীজি উপলব্ধি করেন যে, নিরস্ত্র দেশবাসী হিংসার পথে অগ্রসর হলে শক্তিশালী ব্রিটিশরাজ অত্যাচার শুরু করবে এবং তাতে রক্তের বন্যায় আন্দোলন ডুবে যাবে।

(৩) হিংসাত্মক আন্দোলনের দায়িত্ব

গান্ধীজি নিজেই লিখছেন, “তখন যদি একে স্থগিত না রাখা হত, তাহলে অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করার পরিবর্তে আমরা মূলত হিংসাত্মক আন্দোলনেরই দায়িত্ব নিয়ে ফেলতাম।”

(৪) কৃষকদের মনোবল

এই আন্দোলনে কৃষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা হিংসার পথে অগ্রসর হলে সরকার তাদের জমি-জমা বাজেয়াপ্ত করে তাদের মনোবল ভেঙে দিত।

(৫) অভিভাবকদের ক্ষোভ

গান্ধীজি উপলব্ধি করেছিলেন যে, আন্দোলনকে আর বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হন। মধ্যবিত্ত ও বিভিন্ন পেশার মানুষরা জীবিকা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অধৈর্য হয়ে পড়েন।

(৬) মুসলিম সমাজের উৎসাহ হ্রাস

তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে খলিফাতন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটলে মুসলিম সমাজ অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং নানা স্থানে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হয়।

(৭) আন্দোলনে ভাটার টান

আন্দোলনে ভাটার টান পড়েছিল। এক বছর ধরে আন্দোলন চলছিল, কিন্তু আপোসের কোন ইচ্ছাই সরকারের ছিল না।

উপসংহার:- আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হতে হত বা পিছু হটলে ব্যাপারটা ভাল দেখাত না। এই অবস্থায় চৌরিচৌরার ঘটনা সসম্মানে পিছু হটার সুযোগ করে দেয়।

(FAQ) অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

২. অসহযোগ আন্দোলন কে কবে শুরু করেন?

মহাত্মা গান্ধী, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে।

২. অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য কি ছিল?

স্বরাজ অর্জন।

৩. অসহযোগ আন্দোলনের পন্থা কি ছিল?

অহিংস অসহযোগ।

৪. কবে, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়?

২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে চৌরিচৌরা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

Leave a Comment