রাওলাট আইন -এর পটভূমি, রাওলাট কমিটি গঠন, দমনমূলক বিল উত্থাপন, বিলটি আইনে পরিণত, আইনের বিভিন্ন শর্ত, কালা কানুন ও রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানবো।
রাওলাট আইন প্রসঙ্গে রাওলাট কমিটি বা সিডিশন কমিটি, রাওলাট কমিশন বা সিডিশন কমিশন, রাওলাট আইন কি, রাওলাট আইন পাস, রাওলাট আইন পাসের সময়কাল, রাওলাট আইনের প্রবর্তক, রাওলাট আইনের পটভূমি, রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য, রাওলাট আইনের বিভিন্ন দিক বা রাওলাট আইনের শর্ত, রাওলাট আইনের মূল বক্তব্য, রাওলাট আইন পাসের কারণ, কালা কানুন রাওলাট আইন, রাওলাট আইনের প্রতিক্রিয়া ও রাওলাট সত্যাগ্রহ।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের রাওলাট আইন
ঐতিহাসিক ঘটনা | রাওলাট আইন |
সময়কাল | ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ |
ধরণ | দমনমূলক আইন |
নামকরণ | স্যার সিডনি রাওলাটের নামে |
ফলাফল | সারা ভারত জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় |
ভূমিকা :- ভারতে ব্রিটিশবিরােধী ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ড -এর বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এটি ‘সিডিশন কমিটি’ নামে পরিচিত। এই কমিটি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে তার প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ কুখ্যাত রাওলাট আইন পাস হয়।
রাওলাট আইনের পটভূমি
১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে এই আইন প্রণয়নের কারণ অনুধাবন করা যায়। যেমন –
(১) দমন নীতি গ্ৰহণ
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন দ্বারা সরকার জনগণের প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করে। এই সময় একই সঙ্গে সরকার আবার জনগণের প্রতি দমন নীতিরও পথ ধরে।
(২) প্রতিরক্ষা আইনের মেয়াদ শেষ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ‘ভারত প্রতিরক্ষা আইন’ নামে এক প্রতিক্রিয়াশীল আইন প্রবর্তন করে। যুদ্ধাবসানে এই আইনটির মেয়াদও শেষ হয়।
(৩) চরম গণ-অসন্তোষ
এই সময় ভারতে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, বেকারত্ব, রোগ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব প্রভৃতি কারণে গণ-অসন্তোষ তখন চরমে ওঠে।
(৪) বিরোধী মুসলিম সমাজ
তুরস্ক -এর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আচরণ মুসলিম সমাজকে ইংরেজ-বিরোধী করে তোলে। ব্রিটিশ ডোমিনিয়নগুলি, বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গ শাসকদের আচরণ ভারতবাসীকে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ করে।
(৫) বিপ্লববাদী কার্যকলাপ
এই সময়েই আবার ভারতের বুকে বিপ্লববাদী কার্যকলাপের পুনরাবির্ভাব দেখা দেয়, যার ফলে ব্রিটিশ সরকার ভীত হয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন
এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ভারত সরকার একটি নতুন প্রতিক্রিয়াশীল আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং এই মর্মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড চেম্বারলেনের কাছে আবেদন জানায়।
রাওলাট কমিটি গঠন
এই পরিস্থিতিতে ভারতে সকল প্রকার বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের জন্য ভারত সরকার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যাণ্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করে। সভাপতির নাম অনুসারে এই কমিটি রাওলাট কমিটি বা সিডিশন কমিটি নামে পরিচিত।
দমনমূলক বিল উত্থাপন
এই কমিটির সুপারিশক্রমে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে দমনমূলক বিল উত্থাপিত হয়।
রাওলাট আইন
কেন্দ্রীয় আইনসভার সরকারি ও বেসরকারি সকল ভারতীয় সদস্যের সমবেত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই মার্চ বিলটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনটি ‘রাওলাট আইন’ নামে পরিচিত।
রাওলাট আইনের বিভিন্ন দিক বা শর্তাবলী
রাওলাট আইনের শর্ত গুলি হল –
(১) প্রচারকার্যে বাধাদান
সরকারবিরোধী সবধরনের প্রচারকার্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
(২) বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার
সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে এবং বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল তাদের আটক রাখা যাবে।
(৩) বিনা পরোয়ানায় বাড়ি তল্লাশি
সরকার যে কোনো ব্যক্তির বাড়ি বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে পারবে।
(৪) জুরি ও সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই বিচার কার্য সম্পাদন
বিশেষ আদালতে বিচারকগণ কোনো জুরির সহায়তা এবং কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই বিচার করতে পারবেন।
(৫) আপিলে নিষেধাজ্ঞা
রাওলাট আইনের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চতর আদালতে আপিল মামলা দায়ের করা যাবে না।
(৬) সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ
কোনো সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না
রাওলাট আইন একটি কালো আইন
এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই রাওলাট আইনকে কালো আইন বলা হয়
রাওলাট আইনের প্রতিক্রিয়া
এই আইনের বিরুদ্ধে দেশময় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
(১) আইন পরিষদের সদস্য পদ ত্যাগ
বিলটি পাশ হয়ে গেলে মহম্মদ আলি জিন্না, মদনমোহন মালব্য এবং মাজহার-উল-হক আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন।
(২) জিন্নাহর উক্তি
মহম্মদ আলি জিন্না তাঁর প্রতিবাদপত্রে লেখেন যে, এই আইন দ্বারা ন্যায় বিচারের মূল আদর্শ ধ্বংস করা হয়েছে এবং যে সময়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার কোনো আশঙ্কা নেই, সেই সময় জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।” তিনি বলেন যে, “যে সরকার শান্তির সময় এই ধরনের নির্মম আইনের আশ্রয় নিয়েছে সেই সরকার কখনই ‘সভ্য সরকার’ বলে দাবি করতে পারে না।”
(৩) পত্র পত্রিকার প্রতিবাদ
অমৃতবাজার পত্রিকা এই আইনকে ‘এক ভয়াবহ ভ্রান্তি’ বলে অভিহিত করে। মাদ্রাজের ‘হিন্দু’, ‘দি নিউ ইণ্ডিয়া’, লাহোরের ‘পাঞ্জাবি, বোম্বাইয়ের ‘বোম্বাই ক্রনিক্যাল’ প্রভৃতি সংবাদপত্র এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে।
(৪) নারায়ণ চন্দ্রের বক্তব্য
বোম্বাই হাইকোর্ট -এর প্রাক্তন বিচারপতি স্যার নারায়ন চন্দ্রভারকার এই আইনকে ‘অনাবশ্যক’ ও ‘অসঙ্গত’ বলে আখ্যায়িত করেন।
(৫) তিলকের উক্তি
বাল গঙ্গাধর তিলক -এর কেশরী পত্রিকা এই আইনটিকে “অত্যাচার-উৎপীড়নের দানবীয় যন্ত্র” বলে অভিহিত করে।
(৬) লাজপৎ রায়ের উক্তি
লালা লাজপৎ রায় মন্তব্য করেন যে, এই আইনের ফলেই আবার নতুন করে বিপ্লব প্রচেষ্টা শুরু হবে।
(৭) রাওলাট সত্যাগ্রহের ডাক
দক্ষিণ আফ্রিকা প্রত্যাগত বিজয়ী মহাত্মা গান্ধী এই প্রতিক্রিয়াশীল আইনের প্রতিবাদে রাওলাট সত্যাগ্রহ -এর ডাক দেন।
(৮) জালিয়ানওয়ালা-বাগের হত্যাকান্ড
রাওলাট আইন ও অন্যান্য কয়েকটি ঘটনার প্রতিবাদে পাঞ্জাব -এর জালিয়ানওয়ালাবাগে মানুষ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভায় যোগদান করলেন সরকারের পুলিশ সমাবেশে উপস্থিত নিরস্ত্র জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এই ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
উপসংহার :- সরকারের বিরুদ্ধে গান্ধীজীর প্রত্যক্ষ সংগ্রামকে কেন্দ্র করেই ভারতের আধুনিক ইতিহাস -এ শুরু হয় নতুন সংগ্রাম, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন যুগ। এই যুগের নতুন নেতার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি সম্পূর্ণ নতুন ভাষায় ও নতুন ভঙ্গিতে ভারতীয় রাজনীতিকে নতুন পথে পরিচালিত করতে থাকেন।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “রাওলাট আইন” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) রাওলাট আইন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ব্রিটিশ সরকার।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ।
এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই রাওলাট আইনকে কালাকানুন বলা হয়।
ভারতীয়দের যাবতীয় বিক্ষোভ ও আন্দোলনকে দমন করা।
রাওলাট আইনের আইনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাওলাট সত্যাগ্রহ শুরু করেন।
ব্রিটিশ সরকার।
মহম্মদ আলি জিন্না।
ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই মার্চ একটি দমনমূলক আইন পাশ করে। এই আইনটি ‘রাওলাট আইন’ নামে পরিচিত।