জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড -এর পটভূমি হিসেবে অত্যাচারের তীব্রতা বৃদ্ধি, দমন মূলক রাওলাট আইন প্রয়োগ, নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার, অমৃতসরে সামরিক শাসন জারি, সমাবেশ, সভাস্থলের প্রকৃতি, গুলি চালানা, হত্যাকান্ডের বীভৎস রূপ, সামরিক আইন জারি, পাঞ্জাবের অনত্র নির্যাতন, প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্ষোভ, উপাধি ত্যাগ ও কংগ্রেসের প্রতিবাদ সম্পর্কে জানবো।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে অমৃতসর গণহত্যা, জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের সময়কাল, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঘটনা, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের স্থান, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের নায়ক কুখ্যাত জেনারেল ডায়ার, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের মূল কারণ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডে নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পূর্ব সমাবেশ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের বীভৎস রূপ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়া, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের গুরুত্ব, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের তাৎপর্য ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঘটনায় কংগ্রেসের প্রতিবাদ সম্পর্কে জানব ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৯১৯ খ্রি.)
ঐতিহাসিক ঘটনা | জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড |
সময়কাল | ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ |
হত্যাকাণ্ডের নায়ক | জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার |
ফলাফল | হাজারের বেশি নিহত ১২০০ আহত |
ভূমিকা :- ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত রাওলাট আইন পাস হলে এই আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের তীব্র ঝড় ওঠে। এর মধ্যে পাঞ্জাবে রাওলাট আইন-সহ ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি খুবই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এর চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে করুণ পরিণতি ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি
অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে ব্রিটিশ বিরোধী গণ-আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। এর কারণগুলি হল –
(১) অত্যাচারের তীব্রতা বৃদ্ধি
পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ ডায়ারের অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে বারুদের স্তূপে পরিণত করে। জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ করা, গদর বিদ্রোহ প্রতিরোধ করতে পাঞ্জাবিদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো, বঞ্চনার প্রতিবাদে বেকার শিখ সৈন্যদের সমাবেশ প্রভৃতি ঘটনা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের মানুষকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে।
(২) দমনমূলক রাওলাট আইনের প্রয়োগ
সরকার ভারতীয়দের যাবতীয় স্বাধীনতাও অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নিষ্ঠুর দমনমূলক রাওলাট আইন প্রবর্তন করলে দেশবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে এই ক্ষোভ পাঞ্জাবে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
(৩) নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার
‘পিপলস্ কমিটি’ নামে একটি গণসংগঠন লাহোর ও অমৃতসরে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ১০ এপ্রিল১৯১৯ খ্রি.অমৃতসরের স্থানীয় দুই নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড. সত্যপাল-কে হিংসায় মদত দেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোরে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। মারমুখী জনতা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, টেলিগ্রাফ লাইন, ইউরোপীয় নারীপুরুষের ওপর আক্রমণ চালায়।
(৪) অমৃতসরে সামরিক শাসন জারি
অমৃতসরে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর হাতে অমৃতসর শহরের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। সামরিক আইন জারি করে ১১ এপ্রিল সেই শহরে জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পূর্বে সমাবেশ
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সরকার তীব্র দমননীতির আশ্রয় নেয়। এই দমনপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ ১৩ এপ্রিল১৯১৯ বিকেলে শান্তিপূর্ণভাবে পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে যোগ দেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ সভাস্থলের প্রকৃতি
সমাবেশ স্থলটি চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সভাস্থলে প্রবেশের জন্য একটি এবং সভাস্থল থেকে বেরোনোর চারটি খুব সরু গলিপথ ছিল।
জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলিচালনা
সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল মাইকেল ও’ ডায়ার বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে সভাস্থলে উপস্থিত হন।তিনি সমাবেশের নিরস্ত্র জনতাকে কোনো ধরনের সতর্কবার্তা না দিয়েই সেনাবাহিনীকে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলিচালানোর নির্দেশ দেন। মাঠে ঢোকা ও বেরোনোর পথ আটকে পঞ্চাশটি রাইফেল থেকে অন্তত দশ মিনিট ধরে ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালানো হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বীভৎস রূপ
উঁচু প্রাচীর ঘেরা মাঠ থেকে পালানোর কোনো উপায় না থাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ১২০০ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিশু, নারী-সহ অন্তত এক হাজারেরও বেশি মানুষ ঘটনাস্থলে মারা যায়। এই জঘন্যতম ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত।
জালিয়ানওয়ালাবাগে সামরিক আইন জারি
এই জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল এক মিটিং-এ ডায়ার সহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার যে বিবৃতি দেন প্রকৃতপক্ষে তা ছিল ভারতীয়দের প্রতি হুমকি। এরপর অমৃতসর সহ বিভিন্ন জেলায় সরকার সামরিক আইন জারি করে। তা ৯ জুন পর্যন্ত চলে। ভারতীয় আইনজীবীরা হরতালে অংশ নেওয়ায় সামরিক আইনের সাহায্যে তাঁদের নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। এই আইনের দ্বারা বিশেষ আদালত গঠন করে অন্তত ৫১ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বহু মানুষকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পাঞ্জাবের অন্যত্র নির্যাতন
অমৃতসরের বাইরে পাঞ্জাবের অন্যত্রও সামরিক শাসন জারি করে চূড়ান্ত অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয়। ‘মার্শাল ল কমিশন’ গঠন করে পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় মৃত্যুদণ্ড, বেত্রাঘাত, হাতে পায়ে শেকল বেঁধে অত্যাচার প্রভৃতি নির্মম নির্যাতন চলতে থাকে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া
পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়ানক ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। সরকার জেনারেল ডায়ারের কাজকে সমর্থন করে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গোটা বিশ্ব শিহরিত হয়। দেশে-বিদেশে সর্বত্র সরকারের নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র বলেছেন যে, “পাঞ্জাবের ঘটনা দেশের মানুষের কাছে সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের মুখোশধারী বিদেশি শাসনের কুৎসিত ও ভয়াবহ রূপটি প্রকাশ করে দেয়।”
(১) ক্ষোভ
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র ঘৃণা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, “এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারত-এ যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।
(২) উপাধি ত্যাগ
জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘৃণা ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিট্রিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে কংগ্রেসের প্রতিবাদ
জাতীয় কংগ্রেস এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে। কংগ্রেস নেতা সি. এফ. এন্ড্রুজ এই ঘটনাকে কসাইখানার গণহত্যার’ (it was a massacre, a butchery)-র সমতুল্য বলে নিন্দা করেছেন। গান্ধিজি তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।”
উপসংহার :- এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে বহু ইংরেজও অত্যন্ত মর্মান্তিক ও নজিরবিহীন বলে নিন্দা করেন। ভাবী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, “জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আর কখনও ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। …এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক, পাশবিক….”
(FAQ) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল।
জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৩ ই মার্চ, ১৯৪০খ্রিস্টাব্দে উধম সিং লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে।