১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব হিসেবে প্রথম গণ আন্দোলন, শুধু ইংরেজ বিরোধিতা নয়, কংগ্রেসের যথার্থ গণ আন্দোলন, সর্বভারতীয় আন্দোলন, জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক শান্তি বিঘ্নিত, জাতীয় জাগরণ, আত্মবিশ্বাস, ভীতি দূরীকরণ, জাতির নেতা মহাত্মা গান্ধী, জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধি, গণ সংগঠন রূপে জাতীয় কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ, বিপ্লবমুখী কংগ্রেস, জাতীয় চেতনা সৃষ্টি, আন্দোলনের নতুন পদ্ধতি, অস্ত্রহীন আন্দোলন এবং জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি সম্পর্কে জানবো।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব |
সময়কাল | ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
লক্ষ্য | স্বরাজ অর্জন |
পন্থা | অহিংস অসহযোগ |
নেতা | মহাত্মা গান্ধী |
ভূমিকা:- আপাতদৃষ্টিতে অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এই আন্দোলন তার ঘোষিত লক্ষ্য পূরণে সফল হয় নি। এক বছরের মধ্যে স্বরাজ লাভ হয়নি এবং পাঞ্জাব সমস্যা বা খিলাফৎ সমস্যারও বিন্দুমাত্র সমাধান হয় নি।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত
ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, অসহযোগ আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে সফল বা ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যায় না। তাঁর মতে, এই দুইয়ের মধ্যেই সত্য নিহিত আছে।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব
আপাত ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের গুরুত্ব হল –
(১) প্রথম গণ-আন্দোলন
ভারতবর্ষের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলনই হল প্রথম সুসংবদ্ধ গণ-আন্দোলন। শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ—সর্বস্তরের মানুষের যোগদানে এই আন্দোলন যথার্থ গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। জওহরলাল নেহরু একে একটি ‘গণ-আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন
(২) শুধু ইংরেজ বিরোধিতা নয়
কেবলমাত্র ইংরেজ বিরোধিতাই নয় সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি শোষণ, পাঞ্জাবে মহান্তদের দুর্নীতি, রাজস্থানে দেশীয় রাজাদের অত্যাচার এবং পুঁজি পতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ধর্মঘট এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(৩) কংগ্রেসের যথার্থ গণ আন্দোলন
ডঃ এ. আর. দেশাই বলেন যে, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলনের পরিধি কেবলমাত্র সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু শ্রমিক-কৃষকের অংশগ্রহণের ফলে তা এই প্রথম গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। ডঃ মজুমদার বলেন যে, এই প্রথম কংগ্রেস আন্দোলন যথার্থ গণ-আন্দোলনে পরিণত হল।”
(৪) সর্বভারতীয় আন্দোলন
প্রকৃত অর্থে অসহযোগ আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী প্রথম সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলন। ব্যাপকতার দিক থেকে দেখতে গেলে এই আন্দোলন ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকেও অতিক্রম করে যায়। মহাবিদ্রোহ মূলত উত্তর ও পূর্ব ভারতের নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন ভারতের প্রতিটি প্রান্তে বিস্তার লাভ করে।
(৫) জনসাধারণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি
এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ অশিক্ষিত দরিদ্রতম গ্রামবাসী পর্যন্ত সকলেই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা আত্মশক্তি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
(৬) মানসিক শান্তি বিঘ্নিত
মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড উইলিংডন ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সদস্যকে লিখছেন, “অসহযোগ আন্দোলনের ফলাফল যাই হোক না কেন তা সাধারণ মানুষের মনে রাজনৈতিক চেতনা বিস্তার করেছে এবং তাদের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করেছে।”
(৭) জাতীয় জাগরণও আত্মবিশ্বাস
জনসাধারণ হতাশা কাটিয়ে নৈতিক বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা, বীরত্ব এবং কারাদণ্ড ও নির্যাতন সহ্য করার মানসিকতা তাদের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই আন্দোলন ছিল ‘জনগণের কাছে এক ‘অগ্নিপরীক্ষা’।
(৮) ভীতি দূরীকরণ
জওহরলাল নেহরু বলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মূল ভিত্তিই ছিল প্রজাপুঞ্জের মনে সর্বব্যাপী ভীতির সঞ্চার। গান্ধীজি জনমানস থেকে সেই ভীতি দূর করে দেন। নজরুল ইসলাম-এর কবিতায় আছে “এই শিকল পরে শিকল তোদের করব রে বিকল”।
(৯) জাতির নেতা গান্ধীজি
জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে গান্ধীজি সর্বভারতীয় জাতীয় নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশবাসী তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেয়। গান্ধীজির আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘তুমি সর্বাশ্রয়, এ কি শূন্যকথা’। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন “নগরের পথে রোল ওঠে শোনো ‘গান্ধীজি’! ‘গান্ধীজি’!”
(১০) জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধি
এই আন্দোলনের ফলে একটি সুসংঘবদ্ধ, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
(১১) গণ সংগঠন রূপে জাতীয় কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ
ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, জাতীয় কংগ্রেস আর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের আলোচনা সভায় সীমাবদ্ধ হয়ে রইল না—অচিরেই তা বিপ্লবের আদর্শে দীক্ষিত একটি সংগ্রামী গণ-সংগঠনে পরিণত হল। কর্মপদ্ধতি পৃথক হলেও লক্ষ্য ও আদর্শের দিক থেকে বিপ্লবী সংগঠন সমূহের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের আর কোন পার্থক্য রইল না।
(১২) বিপ্লবমুখী কংগ্রেস
সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে (The Indian Struggle) লেখেন যে, গান্ধীজি কংগ্রেসকে একটি ‘বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। প্রখ্যাত সাংবিধানিক ভাষ্যকার কৃপল্যাণ্ড বলেন যে, “তিলক যা করতে পারেন নি, গান্ধীজি তা করতে পেরেছেন। গান্ধীজি কংগ্রেসকে বিপ্লবমুখী করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন।”
(১৩) জাতীয় চেতনা সৃষ্টি
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, এই আন্দোলন ভারতের শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী নেতিবাচক জাতীয়তাবাদী চেতনা” সৃষ্টি করেছে।
(১৪) আন্দোলনের নতুন পদ্ধতি
গান্ধীজি এক নতুন ও অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করেন। কোনো গোপন হিংসাত্মক আন্দোলন নয়— শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ গণ-আন্দোলন শুরু হয়।
(১৫) অস্ত্রহীন বিদ্রোহ
ডঃ তারা চাঁদ এই আন্দোলনকে কেবলমাত্র ভারত ইতিহাসেই নয়—সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে ‘প্রথম অস্ত্রহীন বিদ্রোহ’ (the first unarmed revolt’)বলে অভিহিত করেছেন।
(১৬) জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি
অসহযোগ আন্দোলন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে নানা ভাবে সাহায্য করে। আন্দোলনের সময় দেশজুড়ে যে সব জাতীয় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু টিকে থাকে, যা জাতীয় ভাবধারা বিকাশের সহায়ক হয়।
উপসংহার:- অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দারিদ্র, অস্পৃশ্যতা, মদ্যপান প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি গুলি সম্পর্কে জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে এবং খাদি ও কুটির শিল্পের বিকাশের ফলে তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ফিরে আসে।
(FAQ) অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে।
স্বরাজ লাভ।
অহিংস অসহযোগ।
নাগপুর অধিবেশন।