মধ্যবিত্ত শ্রেণি

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রসঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাদের বলা হয়? উদ্ভবের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ, মধ্যবিত্তদের অগ্ৰদূত, বাঙালি মধ্যবিত্তদের উদ্ভবের কারণ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের সময়কাল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ ও মধ্যবিত্তদের পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য সম্পর্কে জানবো।

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি

ঐতিহাসিক বিষয়মধ্যবিত্ত শ্রেণি
বিভাগতিনটি
শ্রেণিবিন্যাসবি বি মিশ্র
বাঙালি মধ্যবিত্তবঙ্গদূত পত্রিকা
পলাশির যুদ্ধ১৭৫৭ খ্রি
ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি

ভূমিকা  :- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সংস্কারের বাধা দূরে ঠেলে দিয়ে তারাই সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে অগ্রণী হয়। পরবর্তীকালে তাদের মাধ্যমেই ভারত-এ সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাদের বলা হয়?

সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং কায়িক শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের মধ্যবর্তী স্তরে যে সামাজিক গোষ্ঠী অবস্থান করে তারা সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক উত্থান ও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

উদ্ভবের ভিত্তিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির শ্রেণিবিভাগ

ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতে বিভিন্ন ধারা থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। ঘটেছিল। বি. বি. মিশ্র উদ্ভবের ভিত্তিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-

  • (১) ভূমিজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি,
  • (২) শিল্পজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি,
  • (৩) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

মধ্যবিত্তদের অগ্রদূত

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অগ্রভাগে ছিল বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরাই ছিল ব্রিটিশ-ভারতে চিন্তা-চেতনা, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রভৃতির অগ্রদূত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম বাঙালি মধ্যবিত্তদের কথা বলা হয়।

বাঙালি মধ্যবিত্তদের উদ্ভবের কারণ

‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় বাংলায় মধ্যবিত্তদের উত্থানের চারটি কারণের উল্লেখ করা হয়েছে। যথা-

  • (ক) ভূমির মালিকদের ক্ষেত্রে জমির মূল্যবৃদ্ধি,
  • (খ) অবাধ বাণিজ্যের প্রসার,
  • (গ) এদেশে ইউরোপীয়দের আগমন,
  • (ঘ) মুদ্রানির্ভর অর্থনীতির প্রসারের ফলে বাংলায় ধনসম্পদ বৃদ্ধি।

বাংলার বিভিন্ন মধ্যবিত্ত

বিনয় ঘোষ বাংলার মধ্যবিত্ত বলতে যাদের উল্লেখ করেছেন, তারা হলেন-

  • (১) ইংরেজদের অধীনে চাকরি গ্রহণকারী দেওয়ান, বেনিয়ান, মুনশি, খাজাঞ্চি, সরকার প্রমুখ,
  • (২) বাংলার শেঠ, বসাক, মল্লিক, লাহা, দত্ত, বিশ্বাস প্রভৃতি বণিক সম্প্রদায়,
  • (৩) বিভিন্ন ঠিকাদার প্রভৃতি।

বাংলার মধ্যবিত্তদের অনেকেই আবার চাকরি ও ব্যাবসা একসঙ্গে করতেন।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের সময়কাল

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটেছিল। তবে কেউ কেউ মনে করেন যে, ব্রিটিশ শাসনকালের পূর্বেই ভারতীয় সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষীণ উত্থান শুরু হয়েছিল। যেমন-

(১) মোগল আমলে মধ্যবিত্ত

ইকতিদার আলম খান তাঁর ‘দ্য মিডল ক্লাসেস ইন দ্য মোগল এম্পায়ার’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মোগল আমলে সরকারি কর্মচারী, উকিল, শিক্ষক, হাকিম, বৈদ্য এদের নিয়েই মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। এদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য এবং সামাজিক প্রভাব ছিল অতি সামান্য।

(২) নবাবি আমলে মধ্যবিত্ত

অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ মনে করেন যে, ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে নবাবি আমলে বাংলাদেশ-এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। তাঁর মতে, মোগল আমলের কায়স্থবংশীয় জমিদাররাই ছিল নবাবি আমলে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎস। বাংলায় ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, শাসন পরিচালনা, পুলিশ বিভাগ, বিচার ব্যবস্থা প্রভৃতির সঙ্গে বহু লোক যুক্ত ছিল। এর সঙ্গে ছিল পেশাদার ব্যাংকের মালিক, বণিক, মহাজন, কবি-সাহিত্যিক, দরবেশ, হাকিম, বৈদ্য প্রমুখ। এদের নিয়েই বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল।

(৩) ব্রিটিশ আমলে মধ্যবিত্ত

বি.বি. মিশ্র-সহ বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হল ব্রিটিশ শাসনের ফল। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা নিয়ে এই শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনকালে একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি বিদ্যায় রপ্ত জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ফলে সরকারি চাকরির আশায় মধ্যবিত্তরা ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহী হয়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ব্রিটিশ সরকার এদেশে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এমন একটি শ্রেণি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যারা রক্তে ভারতীয় হলেও চিন্তা-চেতনায় হবে ইংরেজ। এরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে। বি.বি. মিশ্র ব্রিটিশ শাসিত ভারতে সরকারি চাকুরিজীবী, বণিক, এজেন্ট, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এদেশে ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উপায়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। যেমন –

(১) করণিক

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধজয়ের পরবর্তী ১০০ বছরে ইংরেজরা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জন্য ব্রিটিশ সরকার বিরাট প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্রশাসনের উচ্চপদগুলিতে ইংরেজরা নিযুক্ত হলেও নিম্নস্তরের পদগুলিতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের নিয়োগ করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এসব ভারতীয় কর্মচারী মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

(২) আইন পেশায় যুক্ত ভারতীয় শ্রেণি

ইংরেজরা ভারতে পাশ্চাত্যের ধাঁচে আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও প্রচুর বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রচুর ভারতীয় অত্যন্ত লাভজনক আইন পেশায় নিযুক্ত হয়। এভাবে আমলা, উকিল, মোক্তার, কেরানি, মুহুরি প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত ভারতীয়ের উদ্ভব ঘটে। আর্থিক দিক থেকে বলীয়ান এই ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

(৩) বাণিজ্যের কাজে যুক্ত কর্মী

ইংরেজরা ভারতে এসেছিল প্রধানত বাণিজ্য করতে। ভারতের সুদূর গ্রামগঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক পণ্যের আদানপ্রদান অব্যাহত রাখা ও ব্যাবসায়িক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য তারা শিক্ষিত ভারতীয়দের বেনিয়ান, সরকার, মুহুরি, উকিল প্রভৃতি বাণিজ্য-সহায়ক বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করে বাণিজ্যের অগ্রগতি অব্যাহত রাখে। বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত এই সব ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

(৪) সামরিক বিভাগের কর্মী

ভারতে সাম্রাজ্য-এর সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার এদেশে বিশাল সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছিল। তাঁরা সামরিক বিভাগের নিম্নপদগুলিতে প্রচুর ভারতীয় নিযুক্ত করে। সরকারি বেতনভুক্ত এই সামরিক কর্মীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে উঠে আসে।

(৫) সরকারি অফিসের কর্মী

ভারতে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হওয়ার পর থেকে এদেশে সরকারি কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয়। এই সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত প্রচুর ভারতীয় নিযুক্ত হয়। এরাও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম অংশ ছিল।

(৬) শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় শ্রেণি

ইংরেজরা ভারতে শিল্পক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে। তাদের উদ্যোগে লোহা কয়লা, ইঞ্জিনিয়ারিং, পাট, কাগজ, চা, কফি প্রভৃতি শিল্পের বিকাশ ঘটে। এইসব কারখানার কাজ পরিচালনার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা যোগদান করে। এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে উঠে আসে।

(৭) করভোগী ভূস্বামী শ্রেণি

ঔপনিবেশিক আমলে যেসকল করভোগী জমিদার বা ভূস্বামী পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

(৮) মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি

ব্রিটিশ সরকার ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রভৃতি ভূমি বন্দোবস্ত চালু করেছে। এইসব বন্দোবস্ত পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরাও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিভিন্ন দেশীয় মহাজন শ্রেণির মানুষও মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য

ব্রিটিশ শাসনকালে গড়ে ওঠা ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল ভারতে পাশ্চাত্য শাসনের অন্যতম ফসল। এই সময়ে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য

ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু। ১৮৮৩-১৮৮৪ শিক্ষাবর্ষে বাংলার হিন্দু কলেজের ছাত্রদের ৮৪.৭ শতাংশই এসেছিল ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য – এই তিনটি তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি থেকে। সরকারি চাকরির বেশিরভাগই ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও ক্ষত্রিয়দের দখলে ছিল। সরকারি চাকরিতে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।

(২) পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে তাদের আগ্রহ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক সামর্থ্য সীমাহীন না হলেও মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে ভারতীয় সমাজে তারা প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচয় দিতে পেরেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রথমদিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতের পক্ষে ব্রিটিশ শাসনকে মঙ্গলজনক বলে মনে করত। তাই ডিরোজিওর অনুগামী রামগোপাল ঘোষ ব্রিটিশ সরকারের চাকরি প্রত্যাখ্যান করলেও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব কামনা করেছিলেন।

(৩) আর্থিক সংগতি

মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল ছিল। কেউ কেউ ছিলেন যথেষ্ট সংখ্যক ভূসম্পত্তির মালিক, বড়ো ব্যবসায়ী, পুঁজি লগ্নিকারী প্রমুখ। বাকিদের অধিকাংশই ছিলেন মাঝারি আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন। পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণকারী দুর্বল আর্থিক অবস্থাসম্পন্নরা ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’ হিসেবে বিবেচিত হত। আর্থিক সংগতির দ্বারা মধ্যবিত্তরা সাধারণ দরিদ্র ভারতীয়দের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন।

(৪) সংখ্যায় স্বল্পতা

ব্রিটিশ আমলের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত এবং আর্থিক প্রশ্নে সচ্ছল ছিলেন। এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা ঔপনিবেশিক আমলে দেশের সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে সারা ভারতের শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যবিত্তের সংখ্যা আজকের দিনের দিল্লির মতো ক্ষুদ্র অঞ্চলের শিক্ষিত নাগরিকের চেয়েও কম ছিল। তাই ব্রিটিশরা প্রায়ই বলত যে উদীয়মান এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের আয়তনের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

(৫) সাম্প্রদায়িক সচেতনতা

মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের সাম্প্রদায়িক স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তারা নিজেরা জাতনির্ভর কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন, আবার নিজ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা বা বজায় রাখার বিষয়েও যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। উচ্চবর্ণজাত, ধনী, প্রভাবশালী প্রভৃতি বিষয়গুলিকে কোনো গোষ্ঠীর প্রধান হওয়ার জন্য যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হত।

(৬) কর্মহীনতা

ভারতের এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রধানত ব্রিটিশদের অধীনে চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এই সম্প্রদায় পরবর্তীকালে ক্রমবর্ধমান কর্মহীনতার মুখোমুখি হয়। যোগ্যতা থাকলেও ভারতীয় মধ্যবিত্তরা নিম্নপদের চাকুরিগুলিতে নিযুক্ত হতে বাধ্য হত। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী দেখিয়েছেন যে, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মাসে ৭৫ টাকার বেশি বেতনের সরকারি পদের সংখ্যা ছিল ১৩,৪৩১টি। এর বেশিরভাগটাই উচ্চবিত্ত ইংরেজ ও মধ্যবিত্ত ইঙ্গ-ভারতীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

(৭) শহরকেন্দ্রিকতা

কোম্পানির শাসনকালে ভারতে বহু নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা হয়। কোর্টকাছারি, অফিস-আদালত, বিচারপতি ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্তাদের বাসভবন, রাস্তাঘাট প্রভৃতির সমন্বয়ে বহু মফসসল জেলা শহরও গড়ে ওঠে। এই শহরগুলিকে কেন্দ্র করেই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়। তবে জমিভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যেমন জমিদার প্রমুখ গ্রামে বাস করত।

(৮) জাতীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরবর্তীকালে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য এ. আর. দেশাই ভারতের মধ্যবিত্তদের ‘আধুনিক ভারতের স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্‌বুদ্ধ হয়। তাই ব্রিটিশ সরকারের অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তরাই সর্বপ্রথম সরব হয় এবং জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠনের বেশিরভাগ সক্রিয় সদস্য ও সমর্থকই এসেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। আই. সি. এস. পরীক্ষায় বসার বয়স কমানোর প্রতিবাদ করে সরকারি চাকরির সুযোগবৃদ্ধির দাবিকে কেন্দ্র করেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সর্বপ্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার ফলেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ

ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশের মোট জনসংখ্যার বিচারে তারা অতি সামান্য অংশ হলেও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে খুবই তৎপর হয়ে ওঠে।

(১) পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ

ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা এদেশে আইন-আদালত ও অন্যান্য প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে শুরু করে। ইংরেজ বণিকরাও দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে। ব্রিটিশদের অফিস-আদালত, বাণিজ্য ঘাঁটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি জানা বহু কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল। প্রথম পর্বে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং পরবর্তীকালে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মধ্যবিত্তরা চাকরি লাভের আশায় ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ফলে ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আগ্রহ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সারা ভারতে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার। সুমিত সরকার দেখিয়েছেন যে, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষ ১৮ হাজার।

(২) ব্রিটিশ সহযোগী

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রথমদিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে সদর্থক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রমুখ। তারা কার্যক্ষেত্রে ব্রিটিশদের ‘সহযোগী’ শ্রেণি বা ‘collaborator’-এ পরিণত হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুললেও নীল বিদ্রোহকে কখনও সরকার বিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখতে চাননি।

(৩) সামাজিক পরিবর্তন

পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে ব্রিটিশদের সঙ্গে বহু মধ্যবিত্তের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে বহু মধ্যবিত্তের সামাজিক উন্নতি ঘটেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরিবার নিম্নশ্রেণির ব্রাহ্মণ হওয়ায় সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এইসব পরিবার ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছিল।

(৪) সরকারের কুনজর

ব্রিটিশ সরকার নিজেদের প্রশাসনিক কাজকর্মের স্বার্থেই ভারতীয় মধ্যবিত্তদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার নিজেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সহ্য করতে পারত না। লর্ড কর্নওয়ালিশ মনে করতেন যে, প্রতিটি ভারতীয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত। বাঙালি মধ্যবিত্তদের প্রতি সরকারের কুনজর বেশি ছিল বলে তপন রায়চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে করণিক পদে নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞাপনে বলা হয় যে, ‘বাঙালি বাবুরা আবেদন করবেন না।” মধ্যবিত্তদের প্রতি ঈর্ষা থেকে সরকার সরকারি উচ্চপদগুলি থেকে ভারতীয়দের দূরে সরিয়ে রাখে।

মধ্যবিত্তদের পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে আসার ফলাফল ও তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –

(১) পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসার

মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ করে পাশ্চাত্য সভ্যতা, জ্ঞানবিজ্ঞান, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবতাবাদ প্রভৃতি ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের মাধ্যমে ভারতে এসব আদর্শের বিকাশ ঘটতে শুরু করে।

(২) যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপন

ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিকাশের ফলে এই ভাষার মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য গড়ে ওঠে। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ভারত সভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।

(৩) যুক্তিবাদী আন্দোলন

মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠলে তাদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনার বিকাশ ঘটে। এর ফলে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তিবাদী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

(৪) ভারতীয় নবজাগরণ

ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাবে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতীয়দের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটে। এই ঘটনাকে অনেকে ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়েছিল বাংলায়।

(৫) জাতীয়তাবাদী সাহিত্য

পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুরাগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরে বাংলা তথা ভারতে সাহিত্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে এবং সাহিত্যে জাতীয়তার প্লাবন দেখা দেয়।

উপসংহার :- পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ক্রমে জাতীয়তাবাদের চেতনা শক্তিশালী হলে তারা ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জোয়ার আনে। এই উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সভাসমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এ. আর. দেশাই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আধুনিক ভারত গঠনের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। ভারতে ইংরিজি ভাষা ও পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ব্রিটিশ শাসনকালে কখনোই গণশিক্ষায় পরিণত হয় নি।

(FAQ) ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাদের বলা হয়?

সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং কায়িক শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের মধ্যবর্তী স্তরে যে সামাজিক গোষ্ঠী অবস্থান করে তারা সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে পরিচিত।

২. উদ্ভেবের ভিত্তিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কে কটি ভাগে ভাগ করেছেন?

বি বি মিশ্র, তিনটি ভাগে।

৩. কখন কোন পত্রিকায় সর্বপ্রথম বাঙালি মধ্যবিত্তদের কথা বলা হয়?

১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদূত পত্রিকায়।

৪. ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অগ্ৰভাগে কারা ছিলেন?

বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

Leave a Comment