সত্যাগ্রহ

গান্ধীজি পরিচালিত সত্যাগ্রহ -এর জন্ম, গান্ধীজির মতে সত্যাগ্রহ, সত্যাগ্রহের সংজ্ঞা, সত্যাগ্রহ সাফল্যের বিষয়, গান্ধীজির সত্যাগ্রহের প্রকৃতি হিসেবে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, অহিংসা নীতি, আত্মনিগ্ৰহ, ভয়হীনতা, কলাকৌশল, সত্যাগ্রহ আন্দোলনের চরিত্র, গান্ধীজির সত্যাগ্রহের বিভিন্ন রূপ হিসেবে অহিংস অসহযোগ, আইন অমান্য, অনশন, পিকেটিং, গঠনমূলক কর্মসূচি, গান্ধীজির পরিচালিত বিভিন্ন সত্যাগ্রহ ও গান্ধীজির সত্যাগ্রহের সমালোচনা সম্পর্কে জানবো।

গান্ধীজি পরিচালিত সত্যাগ্রহ

ঐতিহাসিক ঘটনাসত্যাগ্রহ
স্রষ্টামহাত্মা গান্ধী
অর্থসত্যের প্রতি আগ্রহ
নীতিঅহিংসা
প্রথম সত্যাগ্রহদক্ষিণ আফ্রিকা
সত্যাগ্রহ

ভূমিকা:- মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সত্যাগ্রহ। ভিনসেন্ট সিয়েন তাঁর ‘Lead, Kindly Light’ গ্রন্থে লিখেছেন সত্যাগ্রহ হল গান্ধীর চূড়ান্ত আবিষ্কারবা সৃষ্টি। মহাত্মা গান্ধী তথাকথিত শান্তিবাদী ছিলেন না, সম্মুখ যুদ্ধের পক্ষপাতী না হলেও তার কাছে যুদ্ধের বিকল্প যে শানিত তরবারি ছিল, তা নৈতিক বিকল্প যা সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।

সত্যাগ্রহের জন্ম

খ্রিস্টধর্ম এবং পবিত্র বাইবেল গ্রন্থ গান্ধীজিকে কম প্রভাবিত করেনি। বাইবেলের বিভিন্ন উপদেশ বিশেষ করে প্রেমের দ্বারা অন্যায়কে প্রতিরােধ গান্ধীর মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। গান্ধীজি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন গীতার কর্মযােগের আদর্শ এবং রাসকিন, টলস্টয় প্রমুখ মনীষীদের জীবনাদর্শের দ্বারা, যার ফলস্বরূপ এই সত্যাগ্রহ তত্ত্বের জন্ম হয়।

গান্ধীর মতে সত্যাগ্রহ

গান্ধীজীর মতে, তাই হল সত্যাগ্রহ যা অহিংসার পথে সমাজের অন্যায় ও স্বৈরাচারী শক্তিকে প্রতিহত করতে অনুপ্রাণিত করবে।

সত্যাগ্রহের সংজ্ঞা

  • (১) গান্ধীজির মতেসত্যাগ্রহ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ। তাঁর মতেসত্যের প্রতি অবিচল থেকে যদি অন্যায় ও স্বৈরাচারী শক্তির মােকাবিলা করা যায় তাহলে সেই অশুভ ও স্বৈরাচারী শক্তির বিনাশ ঘটানাে সম্ভব হবে।
  • (২) অন্যভাবে বলা যায়, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা অশুভকে প্রতিরােধ ও প্রতিহত করাই হল সত্যাগ্রহ। বলাবাহুল্য, সত্যাগ্রহ হল বলপ্রয়ােগ না করে অর্থাৎ ঘৃণা, ক্রোধ ও হিংসার আশ্রয় না নিয়ে যুদ্ধ করার এক অভিনব কৌশল।
  • (৩) সত্য, অহিংসা ও আত্মত্যাগের সমন্বয়ী রূপই হল সত্যাগ্রহ যা প্রতিটি মানুষের সহজাত জন্মগত অধিকার বলে বিবেচিত হয়। গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন যে, সত্য ও অহিংসা যেন মােহরবিহীন একটি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই দুই বিষয়কে কখনােই আলাদা করা যায় না।

সত্যাগ্রহের সাফল্য

যে বিষয়গুলির উপর সত্যাগ্রহের সাফল্য নির্ভর করে, তা গান্ধীজি নিজেই হরিজন পত্রিকায় উল্লেখ করেছেন। এই বিষয়গুলি হল–

  • (১) সত্যাগ্রহীরা পরস্পরকে বিশ্বাস করবে।
  • (২) নেতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য থাকতে হবে।
  • (৩) সত্যাগ্রহী সদাসর্বদা ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে।
  • (৪) সত্যাগ্রহী আনন্দের সঙ্গে বন্দুক ও বেয়নেটের সামনে দাঁড়াতে পারবে।
  • (৫) বিপক্ষ ও সহকর্মীর প্রতি হিংসার ভাব পোষণ করা সত্যাগ্রহীর পক্ষে অধর্ম।
  • (৬) সত্যাগ্রহ সংগ্রামের প্রধান চালিকাশক্তি হল চরিত্র শক্তি।
  • (৭) সত্যাগ্রহী দের পাঁচটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। সেগুলো- তাচ্ছিল্য, উপহাস, নিন্দাবাদ, দমন ও সংনম।

গান্ধীজি সত্যাগ্রহের প্রকৃতি

গান্ধীজি পরিচালিত সত্যাগ্রহের প্রকৃতি ছিল নিম্নরূপ –

(১) সত্যাগ্রহ নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধ নয়

গান্ধীজির মতেসত্যাগ্রহ কোনাে নিষ্ক্রিয় কিংবা অলস প্রতিরােধ নয়। সত্যাগ্রহ হল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা অন্যায়কে প্রতিরােধ করার সংগ্রাম।

(২) সত্যাগ্রহের অহিংসা নীতি

গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শন তার অহিংসাতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। সত্য সন্ধানের উদ্দেশ্যে তিনি অহিংস খুঁজে পেয়েছিলেন, যা তার মস্তিষ্কজাত নয়। অহিংসার মধ্য দিয়ে সত্যলাভ সম্ভব বলেই একজন সত্যাগ্রহী সর্বদাই হিংসাকে পরিহার করে চলবে।

(৩) সত্যাগ্রহে আত্মনিগ্রহ

আত্মনিগ্রহ বা আত্মপীড়নের নামান্তর হল সাহস। প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করা এবং তাদের নৈতিক পরিবর্তন ঘটানাের জন্য সত্যাগ্রহীদের এই আত্মনিগ্রহ বা আত্মপীড়নরূপ সাহসের প্রয়ােজন। পরাধীন ভারতবর্ষ -এ গান্ধীজীর অনশন ছিল আত্মনিগ্রহরূপ একপ্রকার ভালােবাসা, যেখানে বৃহত্তর সমাজের স্বার্থ জড়িত ছিল।

(৪) সত্যাগ্রহে ভয়হীনতা

গান্ধীজি প্রবর্তিত সত্যাগ্রহে দুর্বলতা, ভীরুতা ও কাপুরুষতার কোনাে স্থান ছিল না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, দুর্বল, ভীরু ও কাপুরষরা কখনােই সত্যাগ্রহী হতে পারবে না।

(৫) সত্যাগ্রহের কলা কৌশল

গান্ধীজি সত্যাগ্রহে কতকগুলি কলাকৌশলকে অনুসরণ করতে বলেছেন। এগুলি হল –

  • (ক) কারোর কোনাে কথায় প্রলােভনের ফাঁদে পা না গলানাে,
  • (খ) জনগণের কাছে যে ব্যাপারগুলি মৌলিক গুরুত্ব বলে বিবেচিত হয়, সেগুলিকে কষ্ট স্বীকারের দ্বারা অর্জন করা,
  • (গ) সত্যাগ্রহে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে সবসময় চলতে হবে,
  • (ঘ) বিজয়ী আধিপত্যকারীদের কাছে কোনােভাবেই মাথা নত না করা,
  • (ঙ) সত্যাগ্রহীদের আত্মবলে বলীয়ান হতে হবে প্রভৃতি।

(৬) সত্যাগ্রহ আন্দোলনের চরিত্র

সত্যাগ্রহের সারমর্মই হল জাতীয় জীবনে সত্য ও নম্রতার প্রাথমিক প্রয়ােগ ঘটানাে। এই আন্দোলনে বাদী ও বিবাদী, নিপীড়ক ও নিপীড়িত উভয়েরই কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে।

গান্ধীজির সত্যাগ্রহের বিভিন্ন রূপ

গান্ধীজি পরিচালিত সত্যাগ্রহের বিভিন্ন রূপ ছিল। যেমন –

(১) সত্যাগ্রহের পদ্ধতি অহিংস অসহযোগ

গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের উল্লেখযােগ্য পদ্ধতিগুলির মধ্যে অন্যতম হল অসহযোগ, যা হল অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে নরমপন্থী আন্দোলন। তার মতেসুসঙ্গে সহযােগিতা ও কু সঙ্গে অসহযােগিতা করা উচিত। অসহযোগ হল কর্তৃপক্ষকে কু’ পরিত্যাগ করিয়ে সু’-কে গ্রহণ করতে বাধ্য করা। গান্ধীজি ধর্মঘট, হরতাল, বয়কট প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে অসহযােগিতা করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

(২) সত্যাগ্রহের পদ্ধতি আইন অমান্য

গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অপর উল্লেখযােগ্য পদ্ধতি হল আইন অমান্য। অহিংস আইন অমান্যকে গান্ধীজি সংবিধানসম্মত এবং বিশুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, আইন অমান্য আন্দোলন হল ভদ্র ও শান্তিপূর্ণভাবে অনৈতিক নিয়মকানুনকে ভঙ্গ করার পদ্ধতি।

(৩) সত্যাগ্রহের পদ্ধতি অনশন

গান্ধীজির মতে সত্যাগ্রহের অন্য সব পদ্ধতি বা কৌশল বা আন্দোলন ব্যর্থ হলে সত্যাগ্রহী শেষ অস্ত্র হিসেবে বেছে নেবেন অনশনকে। অনশনের অর্থ হল কোনাে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ না করে দাবি আদায় করার পন্থা। অনশন হল আত্মিক কর্মযােগ এবং তা ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত। অনশনের চরম রূপ হল আমৃত্যু অনশন।

(৪) সত্যাগ্রহের পদ্ধতি পিকেটিং

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হল পিকেটিং। সত্যাগ্রহীরা দেশি-বিদেশি দোকানের সামনে দ্রব্য ক্রয়ে বাধা সৃষ্টি করেছিল বলেই গান্ধিজি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পদ্ধতি বা কৌশল হিসেবে পিকেটিং ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

(৫) সত্যাগ্রহের গঠনমূলক কর্মসূচি

ইতিবাচক গঠনমূলক কর্মসূচি পালন ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের আর একটি পদ্ধতি। গান্ধীজির মতে গঠনমূলক কর্মসূচি নেই এমন কোনো আন্দোলন করার অর্থ হল যে রােগী নড়তে বা চলতে পারে না তাকে হাতের দ্বারা খাবার খেতে বলার সমার্থক।

(৬) সত্যাগ্রহের অন্যান্য পদ্ধতি

সত্যাগ্রহের উপরোক্ত উপায় বা পদ্ধতি ছাড়াও গান্ধীজি প্রয়ােজন সাপেক্ষে অন্যান্য যে সকল উপায় অবলম্বনের উপর জোর দিয়েছিলেন সেগুলি হল – পারস্পরিক আলাপ-আলােচনা, আবেদন-নিবেদন, বয়কট, বিক্ষোভ-আন্দোলন, সভাসমিতি, মিছিল, প্রয়ােজনে বিকল্প সরকার গঠন ও পরিচালনা প্রভৃতি।

গান্ধীজি পরিচালিত সত্যাগ্রহ

ভারতে গান্ধীজির পরিচালিত উল্লেখযোগ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছিল চম্পারণ সত্যাগ্রহ, খেদা সত্যাগ্রহ, আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ, লবণ সত্যাগ্রহ, ধরসানা সত্যাগ্রহ প্রভৃতি।

গান্ধিজি সত্যাগ্রহের সমালােচনা

বিভিন্ন ভাবে গান্ধীজির সত্যাগ্রহের সমালােচনা করা হয়। যেমন –

  • (১) অনেক সমালোচক গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ কৌশলের বাস্তবতা সম্পর্কে বিরুদ্ধ মত পােষণ করে বলেছেন যে, তার অহিংস আন্দোলন অনেকটাই আবেগতাড়িত এবং একেবারেই অবাস্তব।
  • (২) গান্ধীজি প্রবর্তিত সত্যাগ্রহ এতটাই আধ্যাত্মিক যে, ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের কাছে এই আন্দোলন একেবারেই গুরুত্বহীন।
  • (৩) গান্ধীজি তার সত্যাগ্রহ সম্পর্কে নিজেই সম্পূর্ণরূপে আস্থাশীল ছিলেন না। এই কারণেই বহু আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েও তা পুনরায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
  • (৪) ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও সত্যাগ্রহের প্রয়ােগ ও সার্থকতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন যে, গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দ্বারা সুসংবদ্ধ ও সশস্ত্র ইংরেজ দুর্গার বিনাশ ঘটানাে সম্ভব নয়।
  • (৫)মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতে গান্ধীজির অহিংস নীতি জাতীয় সংগ্রামকে দুর্বল করে তুলেছিল।

উপসংহার:- গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলন বিভিন্ন সমালােচনার সম্মুখীন হলেও এককথায় বলা যায়, গান্ধীজির সত্যাগ্রহ মানবমুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য এবং অনন্য প্রয়াস।

(FAQ) সত্যাগ্রহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সত্যাগ্রহ কথার অর্থ কী?

সত্যের প্রতি আগ্রহ।

২. সত্যাগ্রহ আন্দোলনের স্রষ্টা কে?

মহাত্মা গান্ধী।

৩. গান্ধীজি প্রথম কোথায় সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন?

দক্ষিণ আফ্রিকায়।

Leave a Comment