জাতীয় শিক্ষা হল বঙ্গভঙ্গ বা স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম ধারা, জাতীয় শিক্ষা গ্ৰহণের কারণ, রংপুরে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন, জনসভার আয়োজন, জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থ প্রদান, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য, বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা, অরবিন্দ ঘোষের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ, বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন, কারিগরি শিক্ষা, বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় শিক্ষার ব্যর্থতা সম্পর্কে জানবো।
জাতীয় শিক্ষা
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাতীয় শিক্ষা |
পরিচিতির কারণ | স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম ধারা |
ডন সোসাইটি | সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় |
অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি | শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু |
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ | ১১ মার্চ, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা:- বঙ্গভঙ্গ বা স্বদেশী আন্দোলন -এর তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়-
‘বয়কট’ -এর মাধ্যমে জাতি বিদেশি সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু করে, আর ‘স্বদেশী’-র মাধ্যমে জাতি মেতে ওঠে সৃষ্টির নব-আনন্দে।
স্বদেশী ও বয়কট
স্বদেশী ও বয়কট হল একই অস্ত্রের দুই দিক। স্বদেশী হল অস্তি বাচক-গঠনমূলক; আর বয়কট হল নেতি বাচক-বর্জনকর, বাতিলকর।
জাতীয় শিক্ষা
‘জাতীয় শিক্ষা’ হল সকল বিদেশি প্রভাব বর্জন করে জাতীয় আদর্শে ও জাতীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।
জাতীয় শিক্ষা গ্ৰহণের কারণ
- (১) বিদেশি নিয়ন্ত্রিত ও বিদেশি ভাবধারায় পরিচালিত বিদেশি শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষিত ভারতবাসী মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারে নি। এই শিক্ষা-ব্যবস্থা তাঁদের কাছে মনুষ্যত্বনাশক, হৃদয়হীন ও যান্ত্রিক বলে মনে হত।
- (২) স্বদেশী আন্দোলনের বহু পূর্বে ঊনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ভারত -এর বিভিন্ন অংশে ভারতীয় আদর্শ ও নিয়ন্ত্রণাধীনে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
- (৩) তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা (১৮৪০ খ্রিঃ), হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয় (১৮৪৬ খ্রিঃ), রবীন্দ্রনাথ -এর ব্রহ্মচর্য আশ্রম (১৯০১ খ্রিঃ), ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সারস্বত আয়তন (১৯০১ খ্রিঃ), সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ডন সোসাইটি (১৯০২ খ্রিঃ), হরিদ্বারের গুরুকুল আশ্রম—এই আদর্শেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (৪) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সরকারি ছাত্রদলন নীতি এবং কার্লাইল সার্কুলার (১০ই অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রিঃ), পেডলার সার্কুলার (২১শে অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রিঃ), লিয়ন সার্কুলার (১৬ই অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রিঃ) জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে ইন্ধন জোগায়।
- (৫) ছাত্ররাই ছিল স্বদেশী আন্দোলনের মূল শক্তি। এই আন্দোলন থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এই সব সার্কুলার জারি করে ছাত্রদের স্বদেশী সভা-সমিতিতে যোগদান, ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি দেওয়া প্রভৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞাআরোপ করে। এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে বেত্রাঘাত, বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, শিক্ষকদের চাকরি থেকে অপসারণ, এমনকী বিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রত্যাহার প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়।
- (৬) সরকারের এই সার্কুলার বা ফতোয়া-রাজের বিরুদ্ধে ছাত্রনেতা শচীন্দ্র প্রসাদ বসু-র নেতৃত্বে কলকাতায় ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি’ (৪ঠা নভেম্বর, ১৯০৫ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বদেশীর প্রচার, স্বদেশী পণ্যাদি বিক্রয়, স্বদেশী আন্দোলনে উৎসাহ দান এবং বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা এই সোসাইটির বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল।
- (৭) ‘ডন সোসাইটি’ ও ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি’-র গঠনমূলক পরিকল্পনা ও চিন্তাধারা একে আরও শক্তিশালী করে। জাতীয় নেতৃমণ্ডলী ছাত্রসমাজকে “গোলদীঘির গোলামখানা” (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গাত্মক অভিধা) ত্যাগ করার আহ্বান জানান।
রংপুরে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন
সরকারি অনাচারের প্রতিবাদে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ই নভেম্বর রংপুরে সর্বপ্রথম জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সে যুগের ছাত্র মনীষী বিনয় সরকারের মতে—“রংপুর ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ হচ্ছে বাংলার শিক্ষা-স্বরাজের প্রবর্তক।”
জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে জনসভার আয়োজন
১৯০৫ সালের ৫ই নভেম্বর ‘ডন সোসাইটি’-র আহ্বানে জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় প্রায় দুই হাজার ছাত্র উপস্থিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই সভায় ভাষণ দেন।
জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে অর্থ প্রদান
৯ ই নভেম্বর পান্তির মাঠে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ হস্টেল যে জমিতে) এক বিশাল সভায় সুবোধচন্দ্র মল্লিক জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে এক লক্ষ টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। কৃতজ্ঞ দেশবাসী তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। উৎসাহী ছাত্রের দল তাঁর ঘোড়ার গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে দিয়ে নিজেরাই জয়ধ্বনি-সহ তাঁর গাড়ি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে (বর্তমান সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার) তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব
১০ই আগস্ট গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জাতীয় শিক্ষার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দান করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর কলকাতায় ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আরও কয়েকজন ধনবান ব্যক্তি এই উদ্দেশ্যে কয়েক লক্ষ টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৯২ জন সদস্য নিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ মনীষীবৃন্দ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ –
- (১) স্বদেশী ধাঁচে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
- (২) শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশ সেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা।
- (৩) নৈতিক শিক্ষা দান করা।
- (৪) মাতৃভাষা বিশেষত বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
- (৫) বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা প্রভৃতি।
বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে অরবিন্দ ঘোষকে অধ্যক্ষ করে ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
অরবিন্দ ঘোষের অধ্যক্ষ পদ গ্ৰহণ
বরোদা রাজ কলেজের অধ্যাপক অরবিন্দ ঘোষ ৭৫০ টাকা বেতনের চাকরি ত্যাগ করে ৭৫ টাকা বেতনে জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন
ক্রমে ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মালদহ প্রভৃতি স্থানে অনুরূপ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় প্রায় ২৫টি মাধ্যমিক এবং ৩০০-র কিছু বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে–এর অধিকাংশই ছিল পূর্ববঙ্গে।
কারিগরি শিক্ষা
জাতীয় নেতৃবৃন্দ কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারেও পিছিয়ে ছিলেন না। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জুলাই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’।
বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষা
জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলার বাইরেও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিলক, লাজপৎ রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ জাতীয় শিক্ষার আদর্শ সমর্থন করলে বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বেরার প্রভৃতি স্থানে বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মসলিপত্তমে একটি জাতীয় কলেজ এবং অন্ধ্রে একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।
জাতীয় শিক্ষার ব্যর্থতা
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের পর জাতীয় শিক্ষার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এর কারণ হল –
- (১) জাতীয় বিদ্যালয় মূলত রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়—নেতৃবর্গের উদ্দেশ্যেও ছিল রাজনৈতিক। শিক্ষা বিস্তারের দিকে তাঁদের আগ্রহ ছিল কম।
- (২) এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘গোলামখানা’ হলেও বিশ্বের বাজারে তার ডিগ্রির দাম চাকরি-অন্ত প্রাণ বাঙালির পক্ষে উপেক্ষা করার উপায় ছিল না।”
- (৩) প্রবল আর্থিক অনটন এবং সরকারি বিরোধিতা এর অন্যতম প্রতিবন্ধক ছিল।
উপসংহার :- বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম বৃহৎ গঠনমূলক প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।
(FAQ) জাতীয় শিক্ষা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে।
শচীন্দ্র প্রসাদ বসু ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে।
১১ মার্চ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৪ আগস্ট ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে।
অরবিন্দ ঘোষ।