সিংহ বাহিনী দেবী দুর্গা (Devi Durga) প্রসঙ্গে দুর্গা কথার অর্থ, দুর্গা নামের বুৎপত্তি, দেবী দুর্গার বিভিন্ন নাম, দেবী দুর্গার মূর্তি, দেবী দুর্গার বাহন, জনপ্রিয় কালী রূপ, সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা, মঙ্গলকাব্যে দেবী দুর্গার বর্ণনা, দেবী দুর্গার আরাধনা, বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা, দুর্গা নামের উৎপত্তি, বিভিন্ন রূপে দেবী দুর্গা, দুর্গার অবতার, বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণে দেবী দুর্গার উল্লেখ, দেবী দুর্গার পূজা, প্রাচীন কালের দুর্গাপূজা, ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে দুর্গার রূপ, দেবী দুর্গার অস্ত্রসমূহের তাৎপর্য।
মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা (Mahishasuramardini Goddess Durga)
ঐতিহাসিক চরিত্র | দেবী দুর্গা |
অন্যান্য নাম | আদিশক্তি, মহিষাসুরমর্দিনী, ভগবতী, ভবানী, জগদম্বা |
আবাস | কৈলাস |
প্রধান অস্ত্র | ত্রিশূল |
বাহন | সিংহ |
প্রধান উৎসব | দুর্গাপূজা |
ভূমিকা :- হিন্দু দেবী পার্বতীর এক উগ্র রূপ হল দুর্গা। হিন্দু সংস্কৃতিতে তিনি খুবই জনপ্রিয় এক দেবী। তাঁকে আদ্যাশক্তির রণরঙ্গিনী মহাদেবীর এক রূপ বলে মান্য করা হয়।
দুর্গা কথার অর্থ
“যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন”; এবং “যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন” তিনিই দেবী দুর্গা।
দুর্গা নামের বুৎপত্তি
- (১) হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, ‘উ’ কার বিঘ্ন নাশ করে, ‘রেফ’ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং ‘অ’ কার শত্রু নাশ করে। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
- (২) অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলা হয়েছে, “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা”। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। দেবী পার্বতী দেবতাদের অনুরোধে ও মহাদেবের আদেশে এক উগ্র রূপ ধারণ করে দুর্গম অসুর কে বধ করেন তাই তিনি দুর্গা নামে অভিহিত হন।
দেবী দুর্গার বিভিন্ন নাম
তিনি চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুরসংহন্ত্রী, নারায়ণী, মহামায়া, কাত্যায়নী, দাক্ষায়ণী, অদ্রিজা, নগনন্দিনী, সিংহবাহিনী, শারদা, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও পরিচিতা।
দেবী দুর্গার মূর্তি
দুর্গার বাহুসংখ্যা অনেক। তাঁর সহস্রভুজা, ত্রিংশতিভুজা, বিংশতিভুজা, অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তির উল্লেখ পুরাণ গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন স্থাপত্য-ভাস্কর্যেও দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়।
দেবী দুর্গার বাহন
তাঁর বাহন সিংহ। তবে উত্তর ও পশ্চিমভারতে আঞ্চলিকভাবে তার বাহন বাঘ।
মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে তাঁকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর অনেক রূপ, যার মধ্যে কালী রূপটি অন্যতম জনপ্রিয়।
সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা
হিন্দু সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতীর উগ্র রূপ, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্যরূপ।
মঙ্গলকাব্যে দেবী দুর্গার বর্ণনা
বাংলা মঙ্গলকাব্য গুলিতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে মহাদেবজায়া হিমালয়দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলির (দুর্গাপূজা) এবং তাঁর বিবাহিত জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাদেবী দেবতাদের অনুরোধে দুর্গম অসুরকে বধ করেন। তাই দেবী পার্বতী দুর্গা নামে অভিহিত হন।
দেবী দুর্গার আরাধনা
দুর্গার আরাধনা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ, অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারত -এর অন্যত্র দুর্গাপূজা মূলত নবরাত্রি ব্রত রূপে উদযাপিত হয়। বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা আছে – আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা।
বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা
সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম সাড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন এবং তারপর নেত্রকোনা জেলার মেন্দিপুর গ্রামের মঠবাড়িতে দূর্গা পূজার সূচনা হয়।
দুর্গা নামের উৎপত্তি
- (১) দেবীভাগবত পুরাণ অনুযায়ী হিরণ্যাক্ষ পুত্র রুরুর বংশধর দুর্গম সমুদ্র মন্থনকালীন অসুরদের বঞ্চনা তথা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ কামনায় ব্রহ্মার তপস্যা করে। সেই কঠোর সাধনায় ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়।
- (২) দুর্গম বর প্রার্থনা করে যে তাকে এমন এক নারী বধ করবেন যিনি অনাবদ্ধকে আবদ্ধ করতে পটিয়সী। বরলাভের অহংকারে মত্ত দুর্গম শুরু করে চরম বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়। তার অত্যাচার ও ধ্বংসলীলায় ত্রিভুবন বিধ্বস্ত।
- (৩) ক্ষমতা ও বিজয়গর্বে মত্ত অসুর চতুর্বেদকে হস্তগত করলে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় দেবী মহামায়া এক দশভুজারূপী মঙ্গলময়ী দেবী রূপে আবির্ভূতা হন। তিনি দুর্গম অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন। বিন্ধ্যাচলে ১০ দিন ব্যাপী ঘোরযুদ্ধে দেবী ও তাঁর অংশোদ্ভূতা গুহ্যকালী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরা, ভৈরবী প্রমুখ দেবীগণ দুর্গম অসুরের কোটি সৈন্যকে নিধন করেন।
- (৪) এরপর দেবী দুর্গম অসুরকে সুতীক্ষ্ণ শূলের আঘাতে বধ করেন এবং চতুর্-বেদ ও সকল মন্ত্র উদ্ধার করেন বলে তিনি সর্বমন্ত্রময়ী। ক্ষমাশীলা পরমাজননী দেবী এরপর অনুতাপদগ্ধ দুর্গম অসুরকে অদ্বৈত ব্রহ্মের জ্ঞান প্রদান করে মোক্ষলাভ করান।
- (৫) দেবী দুর্গা স্বয়ং সচ্চিদানন্দময়ী পরব্রহ্মস্বরূপা আদ্যাশক্তি মহামায়া। যে সময় বা কাল সৃষ্টিতে একমাত্র আবদ্ধ নয়, যে কাল চিরন্তন সত্য, সেই কালকে পিষ্ট করেন মহাকাল শিব আর মহাকালকে পদতলে রেখেছেন দেবী মহামায়া।
- (৬) তিনি পরমাপ্রকৃতি; দেবী ভিন্ন শিব কেবল জড় বস্তু, দেবীর শক্তিতেই ব্রহ্মা সৃজন, বিষ্ণু পালন এবং রুদ্র সংহার করেন। মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডী ও দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এক অভেদ মূর্তিকল্পে প্রতিষ্ঠিতা।
বিভিন্ন রূপে দেবী দুর্গা
- (১) দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। ঋগ্বেদ -এ দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদে উক্ত দেবীসূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসাবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দেবী দুর্গা নির্গুণ অবস্থায় এই জগৎ সংসারে বিরাজ করেন। তার জন্ম হয় না, আবির্ভাব ঘটে।
- (২) দুর্গা সপ্তশতীতে উল্লেখ আছে যে, মহাশক্তি ব্রহ্মার ব্রহ্মত্ব, শিবের শিবত্ব, বিষ্ণুর বিষ্ণুত্ব প্রদান করেছেন, সেই দেবী দেবতাদের সমষ্টিভূত তেজপুঞ্জ থেকে স্বরূপ ধারণ করেন। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত।
- (৩) তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী, কালী, গৌরী, উমা, মহাদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, শূলিনী দুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, মূলা দুর্গা, মহামায়া, মহিষমর্দিনী, চামুণ্ডা প্রভৃতি নামে ও রূপেও পূজিতা হন।
- (৪) তিনিই জগদীশ্বরী, আপন মহিমায় সমগ্ৰ পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন প্রতিটি কণায়। তিনি ঘটন-অঘটন পটিয়সী, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। তিনিই জগতকে চালান ও প্রতিপালন করেন জগদ্ধাত্রী রূপে, আবার প্রলয়কালে তিনিই কালিকা রূপে জগৎকে গ্রাস করেন।
- (৫) বঙ্গ দেশে এবং উৎকল দেশে এই দেবীকে নবপত্রিকার মাধ্যমে নটার রূপকে পূজা করা হয়, যা অনেকাংশে কলা বউ নামে পরিচিত। যদিও কলা বউ লোক ভাষায় পরিচিত, যার কোনো পুরাণগত ব্যাখ্যা নেই।
- (৬) দেবী দুর্গা শাক্তমতে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব মতে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈবমতে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী রূপে চিহ্নিত করা হয়। বৈদিক সাহিত্য -এ দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেন উপনিষদে বর্ণিত উমা (পার্বতী) বা হৈমবতীকে দুর্গা হিসাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে।
- (৭) ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গার একটি স্বরূপ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যিনি হরির সহায়িকা শক্তি তথা শিবভক্তিপ্রদায়িনী। এছাড়াও দুর্গাদেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়।
দুর্গার অবতার
দেবী দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন অবতার হল কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদন্তিকা, কৌশিকী, ভীমা, উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী, কাত্যায়নী, শান্তা দুর্গা, অজিতা, অপরাজিতা ইত্যাদি।
বিভিন্ন পুরাণ ও উপপুরাণে দেবী দুর্গার উল্লেখ
যে সকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা বা দেবী সংক্রান্ত আলোচনা আছে সেগুলি হল মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, বামনপুরাণ, কালিকাপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বরাহপুরাণ, শিবপুরাণ ও দেবী ভাগবত।
দেবী দুর্গার পূজা
- (১) দুর্গাপূজা হল শক্তির অধিষ্ঠাত্রী পার্বতী দেবীর দুর্গা রূপের উপাসনার উৎসব। দুর্গাপূজা শরৎ (আশ্বিন) এবং বসন্ত (চৈত্র) ঋতুর শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুসারে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে। সূচনা করেছিলেন রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি।
- (২) দেবী ভাগবত ও কালিকাপুরাণে বর্ণিত আছে, শরৎকালে রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক শ্রীরামচন্দ্র দেবী পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী দুর্গা রূপের পূজা করেছিলেন রাবণ বধের জন্য। তাই একে ‘অকালবোধন’ও বলা হয়ে থাকে।
- (৩) পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডে দুর্গাপূজা বহুলভাবে উদ্যাপন করা হয়। উত্তর ভারতে এই উৎসব নবরাত্রি হিসাবে পালন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র দুর্গাপূজা পালন করে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সকলে দুর্গাপূজা পালন করে।
- (৪) সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠীর থেকে আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত এই দুর্গোৎসব হয়ে থাকে। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত।
- (৫) এই সময়ের পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামেও জানা যায়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, যা মহালয়া নামে পরিচিত। আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষ্মী পূজার দিন হিসাবে গণ্য করা হয়।
দেবী দুর্গার প্রভাব
- (১) ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বন্দেমাতরম গানের পিছনে অনুপ্রেরণা যোগায় দেবী হিসেবে দুর্গা। পরবর্তীতে এই গান ভারতের সরকারী জাতীয় গানে পরিণত হয়।
- (২) ভারতীয় জাতীয়তাবাদে ভারত মাতা রূপে দুর্গা উপস্থিত। অর্থাৎ ভারত মাতাকে দুর্গার একটি রূপ হিসাবে দেখা হয়। এটি সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ভারতীয়দের জন্য মা ও রক্ষক হিসাবে দুর্গার প্রাচীন আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
- (৩) দেবী দুর্গা পপ সংস্কৃতি এবং জয় সন্তোষী মা- এর মতো ব্লকবাস্টার বলিউড সিনেমায় উপস্থিত রয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী হিন্দুস্তানি বাক্যাংশ ব্যবহার করে। যেমন – “দুর্গা মাতা কি জয়!” এবং “কালীমাতা কি জয়!”।
- (৪) যে কোনও নারী যে শুভ ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করে বা একটি কারণ হিসেবে গ্রহণ করে তার মধ্যে দুর্গার আত্মা রয়েছে বলে গণ্য করা হয়।
প্রাচীন কালের দুর্গাপূজা
- (১) ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য বা বৈদিক সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে।
- (২) সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় মাতৃ পূজার। মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্না-র।
- (৩) কুষাণ সাম্রাজ্য -এর সম্রাট কনিষ্ক -এর মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা-র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তান -এ প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনও দেবী চণ্ডী ‘বিবি নানা’ হিসেবে এই সব অঞ্চলে পূজিত হন।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে দুর্গার রূপ
- (১) জাপানি দুর্গা বা ‘জুনতেই ক্যানন’ ১৮ হাতের দুর্গা রূপ। মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি। শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয় খ্রিস্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে।
- (২) খ্রিস্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম। এই সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্যম গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলি একত্রিত করা হয়।
- (৩) দেবীমাহাত্ম্যম গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম অব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
- (৪) মহাযান বৌদ্ধধর্ম -এর হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়।
- (৫) হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে। অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দী) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুধর্মের হাত ধরে।
- (৬) এই সময়ের যে দুর্গা মূর্তিগুলি কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, অধিকাংশ চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুরমর্দিনী। মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্যাবলি এখানেই যে, এই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর মতো চতুর্ভুজা এবং শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণকারী।
- (৭) জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলির মধ্যে প্রাচীনতম তারিখ অনুমান অষ্টম শতাব্দীর।
- (৮) ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। এটি একটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ।
- (৯) পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু রাজ্য বলিতে।
দেবী দুর্গার অস্ত্রসমূহের তাৎপর্য
দুর্গা প্রতিমার সাজের সবচেয়ে বড় অংশ হল দেবীর দশ হাতে দশ অস্ত্র। দেবীর প্রতিটি হাতের এক একটিতে বিভিন্ন অস্ত্রের তাৎপর্য রয়েছে আলাদারকমের। যেমন –
(১) ত্রিশূল
দেবী দুর্গাকে ত্রিশূল দান করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব। ত্রিশূলের তিনফলা হল তিনটি গুণের প্রতীক। সত্ত্ব, তমঃ,রজঃ গুণের কথা এখানে বলা হয়েছে। সত্ত্ব হল জ্ঞান, ম হল অন্ধকার, আর রজঃ হল অহংবোধ।
(২) সুদর্শন চক্র
দেবীকে সুদর্শন চক্র দিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু। ব্রহ্মাণ্ড আবতর্নের প্রতীকী রূপ এই সুদর্শন চক্র
(৩) পদ্ম
অর্ধ প্রস্ফূটিত পদ্ম জীবনে আত্মধ্যাতিক চেতনা বিকাশকে তুলে ধরে। দেবীকে পদ্ম প্রদান করে ব্রহ্মা সেই যুদ্ধবিদ্যার পাঠ দিয়েছিলেন।
(৪) তির ও ধনুক
তির ও ধনুক হল প্রাণশক্তির প্রতীক। তির নির্দেশ করে গতিময়তাকে। আর ধনুক দেখায় দিশা, সম্ভাব্য ক্ষমতা। পবনদেব এই অস্ত্র প্রদান করেন।
(৫) অসি
অসি দ্বারা বোঝানো হয় জ্ঞান ও দীপ্তি। এই অস্ত্র মা দুর্গাকে দিয়েছিলেন গণেশদেব।
(৬) বজ্র
বজ্র হল আত্মশক্তির প্রতীক। ইন্দ্রদেব এই বজ্র প্রদান করেছিলেন মা দুর্গাকে। কর্ম থেকে আত্মশক্তি তৈরির প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে বজ্র।
(৭) বর্শা
অগ্নিদেব প্রদান করেছিলেন বর্শা। এটি ঠিক-বেঠিকের তফাৎ শিখিয়ে দিতে সাহায্য করে।
(৮) সর্প
নাগরাজ অস্ত্র হিসাবে মা দুর্গাকে প্রদান করেছিলেন সাপ। সাধনা ও তার দ্বারা উন্মেষিত চেতনার প্রতীক হল সাপ।
(৯) শঙ্খ
বরুণদেব দিয়েছিলেন শঙ্খ। যার ধ্বনি মঙ্গলময়তাকে বোঝায়। এতে সমস্ত অশুভ শক্তি ভীত হয়ে পড়ে।
(১০) গদা বা কালদণ্ড
গদা বা কালদণ্ড হলো মহা প্রীতি ও আনুগত্যের প্রতীক। দেবী দুর্গার বাম হাতে গদা বা কালদণ্ড থাকে। ধর্মরাজ যম গদা বা কালদণ্ড মহিষাসুর নিধন যজ্ঞে দেবী মহামায়াকে এই অস্ত্র প্রদান করেন।
উপসংহার :- সাম্য-সম্প্রীতির ঐতিহ্যে মহীয়ান প্রিয় মাতৃভূমি আমাদের বাংলাদেশ। এ সাম্য-শান্তির বাণী নিয়ে যুগে যুগে মর্ত্যধামে আগমন অসুর বিনাশিনী ‘শক্তিরূপেণ’ দেবী দুর্গার। অশুভ শক্তিকে নির্মূল করার মধ্য দিয়ে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শক্তিরূপে দেবী দুর্গার আগমন যুগে যুগে। তাই বলা হয়েছে, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা…’।
(FAQ) দেবী দুর্গা (Devi Durga) সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আদিশক্তি, মহিষাসুরমর্দিনী, ভগবতী, ভবানী, জগদম্বা।
সিংহ।
অত্যাচারী দানব মহিষাসুরকে হত্যা করেছিলেন বলে।
বিষ্ণু বা নারায়ণ।
ত্রিশূল।