মাৎস্যন্যায়

মাৎস্যন্যায় -এর অর্থ, মাৎস্যন্যায় কী, কৌটিল্যের অভিমত, স্বাভাবিক নিয়ম বিলুপ্ত, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, মাৎস্যন্যায়ের সময়কাল, আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্ৰন্থের বর্ণনা, রামচরিত কাব্যের বর্ণনা, শশাঙ্কের মৃত্যু, অরাজকতা ও কুশাসন, গৌড়তন্ত্র, বাংলায় চীনা-তিব্বতী আধিপত্য, যশোবর্মনের বাংলা জয়, মুক্তাপীড়ের বাংলা অধিকার, বিজেতাদের আক্রমণ ও লুণ্ঠন, অর্থনৈতিক দুর্গতি, গোপালের নির্বাচন ও মাৎস্যন্যায়ের অবসান সম্পর্কে জানবো।

মাৎস্যন্যায়

ঐতিহাসিক ঘটনামাৎস্যন্যায়
সূচনাকালআনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ
সমাপ্তিকাল৭৫০ খ্রিস্টাব্দ
শশাঙ্ক -এর মৃত্যু৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ
গোপাল-এর নির্বাচন৭৫০ খ্রিস্টাব্দ
মাৎস্যন্যায়

ভূমিকা :- পাল সাম্রাজ্য-এর পূর্ববর্তী সময়ের বাংলার অসীম নৈরাজ্যকর অবস্থাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে অভিহিত করা হয়। আর প্রচলিত অর্থে মাৎস্যন্যায় বলতে সেই সময়ের অরাজক অবস্থাকেই বোঝায়।

মাৎস্যন্যায়ের অর্থ

সংস্কৃত শব্দ ‘মাৎস্যন্যায়’-এর আক্ষরিক অর্থ ‘মাছের ন্যায়। মাছেদের জগতে বড় মাছ কর্তৃক ছোট ছোট মাছভক্ষিত হয়। দুর্বল নিমেষেই হয়ে যায় সবলের গ্রাস। মাছেদের জগতে যদিও বা এটাই নিয়ম, কিন্তু মানবসমাজে তা ঘোরতর অন্যায়।

মাৎস্যন্যায়ের সংজ্ঞা

রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থার অবস্থা যখন মাছদের জগতের মতো ছোটরা বড়দের হাতে, দুর্বলরা সবলদের হাতে, কিংবা ক্ষমতাহীনরা শোষিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে তখন তাকে মাৎসন্যায় বলে।

মাৎসন্যায় সম্পর্কে কৌটিল্যের অভিমত

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য -এর প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য -এর অর্থশাস্ত্র -এ মাৎসন্যায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন বিচারের অভাবে ক্ষমতাবান দুর্বলকে গ্রাস করে, যেমন বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে, এমন অবস্থাকে বলা যায় মাৎস্যন্যায়।

মাৎসন্যায় অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়ম বিলুপ্ত

এই মাৎসন্যায় অবস্থায় অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলা গ্রাস করে পুরো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে। সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়ম কিংবা সমতা।

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস

প্রাচীন বাংলার ইতিহাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –

  • (১) প্রথম ভাগে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য-এর শাসন পর্যন্ত সময়কাল।
  • (২) দ্বিতীয় ভাগে গুপ্ত পরবর্তী কাল থেকে শশাঙ্কের শাসন পর্যন্ত সময়কাল।
  • (৩) তৃতীয় ভাগে শশাঙ্ক পরবর্তী বিশৃঙ্খলার যুগ থেকে পাল ও সেন বংশ-এর শাসন পর্যন্ত সময়কাল।

মাৎস্যন্যায়ের সময়কাল

প্রকৃতপক্ষে মাৎস্যন্যায়ের সময়টি ছিল বাংলার ইতিহাসে তৃতীয় ভাগের শুরুর দিকে। অধিকাংশের মতে মোটামুটিভাবে ৬৫০ থেকে ৭৫০ সালের মধ্যবর্তী প্রায় ১০০ বছর বাংলায় মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি ছিল।

আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্ৰন্থে মাৎস্যন্যায়ের বর্ণনা

আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থ অনুযায়ী৬৩৭ সালে রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বাংলার আকাশে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। শুরু হয় এক অভাবনীয় বিশৃঙ্খলার যুগ মাৎস্যন্যায়।

রামচরিত কাব্যে মাৎস্যন্যায়ের বর্ণনা

সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে পাল বংশের অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ের বাংলার নৈরাজ্যকর অবস্থাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে উল্লেখ করা হয়।

শশাঙ্কের মৃত্যু

৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলার রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে পড়ে। কজাঙ্গাল,পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্ত, সমতট বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায় বাংলা।

অরাজকতা ও কুশাসন

বৌদ্ধ আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প গ্রন্থ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বণিক যে যেভাবে পারে ক্ষমতা অধিকার করে। হত্যা, গৃহযুদ্ধ, দুর্বলের ওপর বলবানের অত্যাচার বাংলায় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলার অরাজকতা ও কুশাসন যেন একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়।

গৌড়তন্ত্র

উত্তর ভারত-এ বাংলার এই অরাজকতাকে “গৌড়তন্ত্র” অর্থাৎ গৌড় দেশের নিয়ম বলে ব্যঙ্গ করা হত। বাংলার এই দুরবস্থার সুযোগে কিছু দিনের জন্যে হর্ষবর্ধন পশ্চিম বাংলা ও কামরূপের ভাস্কর বর্মন পূর্ব বাংলা দখল করেন।

জয়নাগ কর্তৃক বাংলা অধিকার

শেষ পর্যন্ত জয়নাগ বলে এক ব্যক্তি ৬৪৭ খ্রীস্টাব্দের পর গৌড় অধিকার করে বৈদেশিক অধিকার হতে বাংলাকে কিছুদিনের জন্যে মুক্ত করেন। বাংলার বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া তার অধিকারে ছিল বলেমনে করা হয়।

চীনা-তিব্বতী আধিপত্য

জয়নাগের মৃত্যুর পর বাংলায় প্রায় এক শতক ধরে ঘোর অরাজকতা দেখা দেয়। ইতিমধ্যে হর্ষের মৃত্যু ঘটায় পূর্ব ভারতে ঘোর অরাজকতা দেখা দেয়। চীনা দূত হিউয়েন সাঙ তিব্বতীয়দের সাহায্যে পূর্ব ভারতে চীনা-তিব্বতী আধিপত্য স্থাপনে সচেষ্ট হন।

পরবর্তী গুপ্তবংশ

৭০২ খ্রীঃ নাগাদ তিব্বতী আক্রমণের অবসান হয়। এর পর কিছুকাল পরবর্তী গুপ্তবংশীয় আদিত্য সেনগুপ্ত ও তাঁর তিন উত্তরাধিকারী মগধ শাসন করেন।

খড়গ বংশ

এই সময় বাংলার বঙ্গ ও সমতট (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) অধিকার করে খড়গ রাজবংশ।

যশোবর্মনের বাংলা জয়

কনৌজ -এর যশোবর্মন পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলার কিছু অংশ জয় করেন। যশোবর্মনের এই জয়ের কথা কবি বাকপতি রাজের গৌড়বহো কাব্যে পাওয়া যায়।

মুক্তাপীড়ের বাংলা অধিকার

কাশ্মীরের মুক্তাপীড় ললিতাদিত্য যশোবর্মনকে পরাস্ত করে গৌড়দেশ অধিকার করেন। যদিও রাজতরঙ্গিনী গ্ৰন্থে কলহন ললিতাদিত্যের বাংলা অধিকারের কোন প্রত্যক্ষ মত দেননি, তিনি কয়েকটি ঘটনার কথা বলেছেন যার থেকে পরোক্ষভাবে ললিতাদিত্যের বাংলায় অধিকার স্থাপিত হয় বলে মনে করা হয়।

বিজেতাদের আক্রমণ ও লুণ্ঠন

এই সকল বিজেতারা বাংলার ওপর স্থায়ী অধিকার স্থাপন করতে পারেননি। কিন্তু তাদের আক্রমণ ও লুণ্ঠনে বাংলা ছারখার হয়। বাংলার এই ভাঙা মঙ্গলচণ্ডীর যুগে দেখা দেয়।

অর্থনৈতিক দুর্গতি

এই যুগে বাংলার এমন অর্থনৈতিক দুর্গতি হয় যে, সমকালীন কোনো রৌপ্যমুদ্রা এখনও পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়। তাম্রলিপ্ত বন্দর এই যুগে ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলা বাণিজ্য লক্ষ্মীর প্রসাদ হতে বঞ্চিত হয়।

খলিমপুর লিপির বর্ণনা

বাংলার এই সর্বনাশা অবস্থা উপলব্ধি করে বাংলার “প্রকৃতিপুঞ্জ” বাংলার সিংহাসনে গোপালকে নির্বাচন করে বলে খলিমপুর তাম্রপট্ট লিপি থেকে জানা যায়।

গোপালের নির্বাচন

গোপাল ছিলেন বাংলার সামন্ত রাজাদের অন্যতম। কীলহর্ণ খলিমপুর লিপির ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, গোপালকে “প্রকৃতিপুঞ্জ” অর্থাৎ জনসাধারণ নির্বাচন করেছিল।

আধুনিক পণ্ডিতদের সন্দেহ

আধুনিক পণ্ডিতেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, ৭৫০ খ্রীঃ বাংলার জনসাধারণের পক্ষে সংগঠিত হয়ে গোপালকে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

মাৎসন্যায় দূর করার চেষ্টা

দামোদরপুর, মল্লরসুল, জয়নগর লিপি থেকে বাংলায় সামন্ত শ্রেণীর উদ্ভবের কথা জানা যায়। এই সামন্তশ্রেণী তাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা ছেড়ে মাৎস্যন্যায় দূর করার জন্য স্ব ইচ্ছায় গোপালকে নির্বাচন করে (৭৫০ খ্রীঃ) বলে মনে করা হয়।

মাৎসন্যায়ের অবসান

বিদেশী শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশ যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্নতখন বাংলাদেশ-এর প্রবীন ও প্রাজ্ঞ নেতারা আত্মকলহ ত্যাগ করে, গোপাল নামে এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করে মাৎসন্যায়ের অবসান ঘটান।

উপসংহার :- এই গোপাল থেকেই বঙ্গদেশে পাল বংশের শুরু হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপাল তাঁর রাজত্ব শুরু করেন। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাল বংশ বাংলাদেশ শাসন করেছিল

(FAQ) মাৎসন্যায় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মাৎসন্যায় কী?

রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থার অবস্থা যখন মাছদের জগতের মতো ছোটরা বড়দের হাতে, দুর্বলরা সবলদের হাতে, কিংবা ক্ষমতাহীনরা শোষিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে তখন তাকে মাৎসন্যায় বলে।

২. কোন সময়কালে বাংলায় মাৎসন্যায় অবস্থা বর্তমান ছিল?

আনুমানিক ৬৫০-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

৩. গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের মৃত্যু হয় কখন?

৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে।

৪. পাল বংশের সূচনা হয় কখন?

৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রকৃতপুঞ্জের দ্বারা গোপালের নির্বাচনের মাধ্যমে।

Leave a Comment