ইউরোপে আধুনিক যুগ

ইউরোপে আধুনিক যুগ, যুগের সময়সীমা সর্বত্র এক নয়, ইউরোপে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে সামন্তপ্রথার ভাঙন, কৃষিকার্যে পরিবর্তন, শিল্পে নতুন শস্যের প্রভাব, বাণিজ্যের বিকাশ, শহরে স্বাধীন চিন্তা, যুক্তিবাদের বিকাশ, পুঁজিবাদের আবির্ভাব ও জাতিরাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে জানবো।

আধুনিক ইউরোপে আধুনিক যুগ প্রসঙ্গে আধুনিক যুগ কাকে বলে, আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য, আধুনিক যুগের সময়সীমা সর্বত্র এক নয়, ইউরোপে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সামন্ত্রতন্ত্রের ভাঙন, কৃষিকার্যে পরিবর্তন, শিল্পে নতুন শস্যের প্রভাব, ইউরোপে বাণিজ্যের বিকাশ, যুক্তিবাদের বিকাশ, পুঁজিবাদের আবির্ভাব ও জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি।

ইউরোপে আধুনিক যুগ

বিষয়ইউরোপে আধুনিক যুগ
সূচনাকাল১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ
উল্লেখযোগ্য ঘটনাকনস্ট্যান্টিনোপলের পতন
প্রধান বৈশিষ্ট্যযুক্তিবাদের বিকাশ
ফরাসি বিপ্লব১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ
ইউরোপে আধুনিক যুগ

ভূমিকা:- ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতনের ফলে ইউরোপ -এ মধ্যযুগের সমাপ্তি ও আধুনিক যুগের সূচনা হয়। অনেকে আবার ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার আবিষ্কার ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন -এর সূচনার মধ্যে মধ্যযুগের সমাপ্তি দেখতে পান।

আধুনিক যুগের সময়সীমা সর্বত্র এক নয়

  • (১) মধ্যযুগের সময়-সীমা পৃথিবীর সর্বত্র এক নয়। সামন্ততন্ত্র ও ভূমিদাস প্রথার অবসান আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে বিচার করলে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের পরেও ইউরোপের বহু দেশে মধ্যযুগ প্রচলিত ছিল।
  • (২) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স -এ সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ হয়। প্রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা ধ্বংস হয় উনিশ শতকের প্রথ দিকে। রাশিয়ায় তা বিলুপ্ত হয় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। ইউরোপের চেয়ে এশিয়া মহাদেশে মধ্যযুগের স্থায়িত্ব ছিল বেশি দিন।
  • (৩) পৃথিবীর সর্বত্র মধ্যযুগ একই ধাঁচে গড়ে ওঠেনি বা তার বিকাশ সর্বত্রই সমান তালে সংঘটিত হয় নি। মধ্যযুগের সূচনায় ইউরোপে নান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, কিন্তু রাজনৈতি পরিবর্তনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন।
  • (৪) পৃথিবী অন্যান্য অংশে কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এত উল্লেখযোগ্য ছিল না সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলিও ইউরোপের বাইরে অন্যান্য দেশে স্পষ্টভাবে বিকশিত হয় নি।

ইউরোপে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য

ইউরোপে আধুনিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য গুলি হল নিম্নরূপ –

(ক) সামন্ত প্রথায় ভাঙন

  • (১) আধুনিক যুগের সূচনায় পুরোনো সামন্তপ্রথায় ভাঙন ধরে ও সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সমাজ ভেঙে পড়তে থাকে। কর্মহীন চাষিদের বেকারত্ব একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। অনেকে শহরে গিয়ে মজুরে পরিণত হয়।
  • (২) গিল্ড প্রথায় ভাঙন ধরে। স্বাধীন কারিগর অন্যের মজুরে পরিণত হয়ে দাসত্বের স্তরে নামতে থাকে। ছোটো ছোটো কারখানাগুলি শিল্প বিপ্লব -এর পথ প্রসারিত করে। আর্থিক বৈষমে উপর ভিত্তি করে সমাজে মূলধনী ও শ্রমিক – এই দুটি শ্রেণির সৃষ্টি হয়।

(খ) কৃষিকার্যে পরিবর্তন

  • (১) এই সময় কৃষিকার্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। খাদ্যের প্রয়োজনে জঙ্গলাকীর্ণ স্থান পরিষ্কার করে কৃষিকার্য শুরু হয়। খনিবিদ্যা ও ধাতুবিদ্যার উন্নতির ফলে কৃষি-যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে।
  • (২) পুরোনো কাঠের হাতিয়ারের বদলে কৃষিকার্যে লোহার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত মানের কোদাল, লাঙলের ফাল, লোহার মই, খুরপি ও কাস্তের ব্যবহার কৃষিকার্যে অগ্রগতির সূচনা করে।
  • (৩) ক্রুসেডের পরবর্তীকালে ইউরোপে যব, আখ, তুলো, পাট, শন, বাজরা, পীচ, লেবু জাতীয় নানা ফল, রেশমগুটি ও নানা সুগন্ধি লতাগুল্মের ব্যাপক চাষ শুরু হয়।
  • (৪) ভৌগোলিক আবিষ্কার -এর ফলে আমেরিকা থেকে নতুন শস্য শালগম ও আলুর চাষ ইউরোপে প্রবর্তিত হয় এবং আলু ইউরোপবাসীর অন্যতম প্রধান খাদ্যে পরিণত হয়।

(গ) শিল্পে নতুন শস্যের প্রভাব

  • (১) এই সময় শিল্পের বিকাশ হতে থাকে। শিল্পে কাঁচামালের চাহিদা মেটাবার জন্য ব্যাপক কৃষিকার্য শুরু হয় এবং বহু অগম্য স্থানে মনুষ্য বসতি নির্মিত হতে থাকে।
  • (২) পশম শিল্পের চাহিদা মেটাবার জন্য ইংল্যান্ড, ফ্ল্যান্ডার্স, টাস্কানি, লম্বার্ডি ও জার্মানির নানা স্থানে গ্রামের জমিগুলি দখল করে বিরাট এলাকা জুড়ে ভেড়ার চাষ শুরু হয়।
  • (৩) যব, তুলো, রেশমগুটি, আখ, জিরে, মৌরি, শন, পাট, পশুপালন, আঙুরের চাষ নানাভাবে ইউরোপের কাগজ, সিল্ক, সুতি ও পশম বস্ত্র, চর্মশিল্প এবং মদের কারখানাগুলিকে সমৃদ্ধ করে। শহরের প্রয়োজন মেটাবার জন্য দুগ্ধশালা, পশু প্রজনন, পশুপালন কেন্দ্র ও ব্যাপক সব্জির চাষ শুরু হয়।

(ঘ) বাণিজ্যের বিকাশ

  • (১) মধ্যযুগে কৃষি ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। আধুনিক যুগের সূচনায় শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। এর ফলে মানুষের জীবিকার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়।
  • (২) জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে ইউরোপে প্রচুর শহর গড়ে উঠতে থাকে। ইতালির ভেনিস, জেনোয়া, পিসা প্রভৃতি শহরগুলি এবং ফ্রান্সের মার্সাই শহর কেবলমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যকে ভিত্তি করে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।

(ঙ) শহরে স্বাধীন চিন্তা

অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তনের ফলে গ্রামাঞ্চলে স্বাধীন কৃষক শ্রেণি ও শহরাঞ্চলে বণিক শ্রেণির উদ্ভব হয়। শহরের মানুষরা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করত। তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল স্বচ্ছল। তারা সামন্তপ্রভু ধর্মযাজকদের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। এইসব কারণে তারা অনেক বেশি যুক্তিবাদী, আত্মবিশ্বাসী ও কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে।

(চ) যুক্তিবাদের বিকাশ

  • (১) বিভিন্ন শহরে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। শিল্পচর্চা মানুষকে যুক্তিবাদী, আত্মবিশ্বাসী ও ধর্মনিরপেক্ষ করে নতুন জীবনদর্শনের সন্ধান দেয়।
  • (২) গির্জা-নির্ভর ধর্মাশ্রয়ী শিল্প-সাহিত্যচর্চা নয়—মানুষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে নতুন সাহিত্য-সৃষ্টি শুরু হয়। কেবলমাত্র শহরই নয়—এইসব চিন্তাধারা গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত হয়।
  • (৩) ধনবান বণিক সম্প্রদায় দেশের প্রকৃত নিয়ামকে পরিণত হয়। ইউরোপের নানা স্থানে বিশেষ বিশেষ পরিবারের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফ্লোরেন্সের মেডিচি বংশ এবং জার্মানির ফুগার বংশ অর্থের লেনদেন করে শহরের শাসকে পরিণত হয়।
  • (৪) টাকার লেনদেন ছিল গির্জার নিয়ম-বিরুদ্ধ। ফলে গির্জার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে, শুরু হয় নবজাগরণ।

(ছ) পুঁজিবাদের আবির্ভাব

  • (১) ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের ফলে বণিক ও শিল্পপতিদের হাতে বিশাল পুঁজি জমতে থাকে। বণিকরা এই পুঁজি নিজেরা ভোগ না করে শিল্প ও বাণিজ্যে পুনরায় তা বিনিয়োগ করতে থাকে। এইভাবে তাদের হাতে পুঁজির পাহাড় জমে যায়। সমাজে পুঁজিবাদের আবির্ভাব হয়।
  • (২) ফিশার বলেন যে, মধ্যযুগের সমাজে দুই শ্রেণির লোক ছিল—যাজক ও সাধারণ মানুষ, কিন্তু আধুনিক যুগে হল নতুন দুটি শ্রেণি—ধনী ও দরিদ্র।

(জ) জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি

  • (১) মধ্যযুগে বহু জাতি নিয়ে বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। আধুনিক যুগে সেই বহুজাতিক বিশাল বিশাল সাম্রাজ্যের স্থলে গড়ে উঠল জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে গঠিত জাতীয় রাষ্ট্র।
  • (২) ফ্রান্সে বুরবোঁ, ইংল্যান্ড -এ টিউডর ও স্টুয়ার্ট, নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডে অরেঞ্জ, সুইডেনে ভাসা, প্রাশিয়ায় হোহেনজোলান, অস্ট্রিয়ায় হ্যাপসবার্গ, রাশিয়ায় রোমানভ প্রভৃতি রাজবংশের অধীনে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে।

উপসংহার:- মধ্যযুগে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আধুনিক যুগে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল স্বরূপ জলপথে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বাণিজ্যের আকর্ষণে বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতি পৃথিবীর নানা অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তার করতে থাকে। ঐতিহাসিক রামসে মুর (Ramsay Muir) বলেন যে, এইভাবে ইউরোপের বিস্তৃতি ঘটে।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ইউরোপে আধুনিক যুগ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) ইউরোপে আধুনিক যুগ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটে কখন?

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে।

২. ইউরোপে আধুনিক যুগ শুরু হয় কখন?

১৪৫৩ কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর।

৩. ইউরোপে আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কি ছিল?

যুক্তিবাদের বিকাশ ও সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়।

অন্যান্য ঐতিহাসিক যুগগুলি

Leave a Comment