সামন্ততন্ত্রের পতন

সামন্ততন্ত্রের পতন প্রসঙ্গে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের সংকট, বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিস্তারের ফলে সামন্ততন্ত্রের পতন, মরিস ডব-এর অভিমত, পল সুইজির অভিমত, পোস্টানের মতামত, ব্রেনারের মতামত ও সামন্ততন্ত্রের পতনে কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের পতন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন, পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন ও পূর্ব ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, সামন্ততন্ত্রের পতনে কৃষক বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্রের পতনে বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিস্তার ও সামন্ততন্ত্রের পতনে কৃষি উৎপাদনের রক্ষণশীলতা সম্পর্কে জানব।

সামন্ততন্ত্রের পতন

ঐতিহাসিক ঘটনাসামন্ততন্ত্রের পতন
বাণিজ্যিক তত্ত্বপল সুইজি
জনসংখ্যা বিষয়ক তত্ত্বপোস্টান
জ্যাকুয়ারী বিদ্রোহফ্রান্স
সামন্ততন্ত্রের পতন

ভূমিকা :- অ্যাডাম স্মিথ তাঁর “The Wealth of Nations” গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রকে অবক্ষয়ের সাময়িক অধ্যায় বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সামন্ততন্ত্র স্থায়ী ব্যবস্থা একেবারেই ছিল না। শিল্প, উৎপাদন ব্যবস্থা, শহরের সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের পতনের সূচনা হয়। তা-সত্ত্বেও মধ্যযুগের ইউরোপ-এ সামন্ততন্ত্র একটা প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করেছিল।

সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের সংকট

  • (১) বোলাঁভিয়ের সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন এবং সামন্ততন্ত্রের ভালো দিকগুলিকেই দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব-এর অন্যতম নেতা ইমানুয়েল সিয়েস তার “হোয়াট ইজ্ থার্ড এস্টেট” গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করে এই মধ্যযুগীয় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছিলেন।
  • (২) মধ্যযুগের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার হাত থেকে সাময়িকভাবে সামন্ততন্ত্র শান্তির বাতাবরণ তৈরি করেছিল। সম্রাট সামন্ততন্ত্রের উপরের অংশে এবং নাইট সামন্ততন্ত্রের নিচের দিকে অবস্থান করলেও এদের স্তরবিন্যাসের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল।
  • (৩) লর্ডদের শাসনব্যবস্থার প্রতি নিষ্ঠাবোধ ও ভ্যাসালদের দায়িত্বশীলতার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, নগরের সমৃদ্ধির কারণে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়েছিল।

বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিস্তারের ফলে সামন্ততন্ত্রের পতন

  • (১) রডনি হিল্টন সম্পাদিত “Transition from Feudalism to Capitalism” গ্রন্থে সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের উদ্ভব প্রসঙ্গে আলোচনায় মার্কসবাদী ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের, যেমন – এরিক হবসবম, সি হিল প্রমুখের লেখায় সামন্ততন্ত্রের পতনের সাময়িক চিত্র ফুটে উঠেছিল।
  • (২) সামন্ততন্ত্রের পতনের মধ্যে দিয়েই পুঁজিবাদের উদ্ভব একথা সত্য। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের পতনে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ছিল অন্যতম। অন্যদিকে বাজারমুখী উৎপাদন অর্থাৎ বাজারের চাহিদার দিকে নজর রেখে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তে বাণিজ্যিক অর্থনীতি সামন্ততন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।

সামন্ততন্ত্রের পতনে মরিস ডবের অভিমত

  • (১) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরিস ডবের ‘Studies in the Development of Capitalism’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থটিতে সামন্ততন্ত্রের পতনের দিকগুলি ব্যাখ্যা করা হয়। তার মতে, সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ছিল ভূমিদাস প্রথা বা ভূমিদাসদের শ্রমের উপর। কিন্তু দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভূমিদাসদের প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছিল।
  • (২) ভূমিদাসদের পতন সামন্ততন্ত্রের পতনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভূমিদাসপ্রথাকে কেন্দ্র করেই সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্যের বিস্তার ও বাণিজ্যিক আদান প্রদান সামন্ততন্ত্রের পতনে সাহায্য করেছিল। ভূমিদাসরাও লর্ডদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ম্যানরগুলি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল।
  • (৩) লর্ডরা কিন্তু এই পরিস্থিতিকে সামলে দিতে করের পরিমাণ বাড়াতে শুরু করেছিল। কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ নগদ অর্থ কর আদায় চলেছিল। কৃষকরা এই করের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ম্যানর ছেড়ে চলে যেতে থাকে। এইভাবে ভূমিদাস প্রথার অবসান ও সামন্ততন্ত্রের পতন হয়।
  • (৪) লর্ডরা ভূমিদাসদের উপর কর আদায়ের চাপ বৃদ্ধি করলেও একথা মানতে রাজি ছিল না যে, সাধারণ প্রযুক্তি দিয়ে প্রচুর উৎপাদন সম্ভব ছিল না। উৎপাদন ও চাহিদা সামন্ততন্ত্রের মধ্যে অন্তর্বিরোধ সৃষ্টি করেছিল। তার ফলেই পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন হয়েছিল।
  • (৫) মরিস ডব সামন্ততন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অন্তর্বিরোধের কথা বলেছিলেন। যদিও বাণিজ্যিক অগ্রগতি ও বাণিজ্যিক বিপ্লব যে সামন্ততন্ত্রের পতনে দায়ী ছিল তাও স্বীকার করেছিলেন।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের পতনে পল সুইজি অভিমত

  • (১) পল সুইজি “Science and society” -এর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের একটি সংখ্যায় “Feudalism : A Critique” নামক প্রবন্ধে সামন্ততন্ত্রের পতনে “বাণিজ্যিক তত্ত্বের” কথা তুলে ধরেছিলেন। ইতালিয় বণিকশ্রেণীরা পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ করেছিল বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নিয়ে। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দ্বাদশ শতকে পশ্চিম ইউরোপে বহু নগর গড়ে উঠেছিল। এই নগরগুলি গড়ে ওঠার ফলে সামন্ততন্ত্রের পতন হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
  • (২) ম্যানর থেকে ভূমিদাসরা পালিয়ে গিয়ে নগরে বিকল্প জীবিকার সন্ধান করতে থাকে। ফলে নগরের জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সামন্ততন্ত্রের পতন হলেও পূর্ব ইউরোপে সামন্ততন্ত্র শক্তিশালী ভিত্তির উপর গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। যদিও পল সুইজি সামন্ততন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক দিকটির বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

সামন্ততন্ত্রের পতনে পোস্টানের মতামত

  • (১) মাইকেল এম পোস্টান তার “The Medieval Economy and Society” গ্ৰন্থে মরিস ডব এবং পল সুইজির থেকে ভিন্ন মতামত পোষণ করেছিলেন। তিনি “জনসংখ্যা বিষয়ক তত্ত্ব” আলোচনা করে সামন্ততন্ত্রের পতনকে ব্যাখ্যা করেছেন। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে খাদ্যদ্রব্যের দামও বেড়ে যায়, কৃষকশ্রেণীও লর্ডদের উপর নির্ভর করতে থাকে।
  • (২) লর্ডরা কৃষকশ্রেণীর আশা ভরসার শেষ জায়গা হলেও লর্ডদের অত্যাচার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অন্যদিকে জমির উর্বরতা, ব্ল্যাক ডেথ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির জন্য চতুর্দশ শতকে ইউরোপে জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল। বাণিজ্যিক অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি এবং ভূমিদাস প্রথার অবসানের ফলেই সামন্ততন্ত্রের পতন হয়েছিল।

সামন্ততন্ত্রের পতনে ব্রেনারের মতামত

  • (১) রবার্ট ব্রেনার “Past and Present” পত্রিকাতে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে “Agrarian Class Structure and Economic Development in pre-industrial Europe” নামক প্রবন্ধে সামন্ততন্ত্রকে পতনের ক্ষেত্রে পল সুইজির বাণিজ্যিক তত্ত্ব ও পোস্টানের জনসংখ্যা তত্ত্বকে মানতে চান নি।
  • (২) কারণ, পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বিপরীত অবস্থা কেন হয়েছিল এই আলোচনা তারা করেন নি। পূর্ব ইউরোপে পশ্চিম ইউরোপের মত অবস্থা হল না কেন? সামন্ততন্ত্রের পতনে সাহায্য করেছিল বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিকাশ।
  • (৩) পশ্চিম ইউরোপে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি অঞ্চলে সামন্ততন্ত্র পতনের ক্ষেত্রে রাজশক্তি ও প্রজাবর্গের মিলিত প্রচেষ্টার কথা বলা যায়। সামন্ততন্ত্রের পতনে অর্থনৈতিক বিষয়ের ক্ষেত্র ছাড়াও তিনি রাজনৈতিক বিষয়ের কথাও বলেছেন।

কৃষক বিদ্রোহের ফলে সামন্ততন্ত্রের পতন

  • (১) সামন্ততন্ত্রে কৃষক ও লর্ডদের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করেও সামন্ততন্ত্র চরম আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল। লর্ডরা অত্যাধিক উৎপাদনের জন্য কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল। কৃষক এবং ভূমিদাসরা কৃষির সঙ্গে আর কোন মতেই যুক্ত হতে চাইছিল না। কৃষিব্যবস্থার ক্ষেত্রে অবক্ষয় সামন্ততন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
  • (২) ফ্রান্সে চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে জ্যাকুয়ারি বিদ্রোহ হয়। এই কৃষক বিদ্ৰোহ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় চরম আঘাত এনেছিল। জ্যাকস বলে পরিচিত ফ্রান্সের কৃষকরা ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ শুরু করেছিল। লর্ডদের প্রতি চরম বিদ্বেষ থেকেই এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল।
  • (৩) লর্ডদের দুর্গ আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও লর্ডরা নিহতও হয়েছিলেন। এই বিদ্রোহ অসংগঠিত ও পরিকল্পনা মাফিক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের প্রতি লর্ডরা অত্যাচার আরও বৃদ্ধি করেছিল। ফ্রান্স ছাড়াও ইংল্যাণ্ডে সামন্তদের বিরুদ্ধে কৃষকবিদ্রোহ হয়েছিল।
  • (৪) আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা প্লেগের মতো মহামারি। যার ফলে ভূমিদাসদের সংখ্যা কমে যায়। লর্ডরা কৃষকদের উপর অত্যাচার বৃদ্ধি করলেও উৎপাদন বাড়ে নি। লর্ডদের দুর্গগুলি ধ্বংস করা হয়।
  • (৫) বোহেমিয়াতেও কৃষক বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। বোহেমিয়াতে বিদ্রোহের ফলে জার্মান আধিপত্য নষ্ট হয়েছিল। একথা ঠিকই যে, কৃষক বিদ্রোহ ইউরোপে সর্বত্র সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে না পারলেও সামন্ততন্ত্রের পতনের ভিত তৈরি করেছিল।

উপসংহার :- মধ্যযুগের ইউরোপের অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে সামন্ততন্ত্রকে চিহ্নিত করা যায়। সামন্ততন্ত্র জনগণের আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার কারণেই গড়ে ওঠে। আর এই বিষয়ে ব্যর্থতাই তার পতন ডেকে এনেছিল।

(FAQ) সামন্ততন্ত্রের পতন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সামন্ততন্ত্রকে অবক্ষয়ের সাময়িক অধ্যায় বলে চিহ্নিত করেছিলেন কে?

অ্যাডাম স্মিথ।

২. সামন্ততন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক তত্ত্বের কথা বলেছিলেন কে?

পল সুইজি।

৩. সামন্ততন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বিষয়ক তত্ত্ব তুলে ধরেন কে?

মাইকেল এম পোস্টান।

৪. জ্যাকুয়ারী কৃষক বিদ্রোহ কখন কোথায় শুরু হয়েছিল?

১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।

Leave a Comment