ম্যানর ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মার্ক ব্লখ-এর ব্যাখ্যা, প্রভু ও কৃষকদের বসবাস, ম্যানর হাউস, ম্যানার ব্যবস্থায় স্থানীয় শাসন, ম্যানর ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ম্যানর প্রভুর আধিপত্য, জমি, চাষবাস, উৎপাদন স্বয়ং সম্পূর্ণতা সম্পর্কে জানবো।
সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় ম্যানর ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ম্যানর ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায়, ম্যানর হাউস, ম্যানর হাউসে প্রভু ও কৃষকদের বসবাস, ম্যানার ব্যবস্থায় স্থানীয় শাসন ও ম্যানর ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানব।
ম্যানর ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | ম্যানর ব্যবস্থা |
অন্য নাম | সিনোরীয় ব্যবস্থা |
প্রভূর গৃহ | ম্যানর হাউস |
প্রাসাদের পর্দা | ‘ট্যাপেস্ট্রি’ |
সম্পত্তি ও বাণিজ্য তদারকি | স্টুয়ার্ড |
আয়-ব্যয়ের হিসাব | বেইলিফ |
ভূমিকা :- সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ম্যানর ব্যবস্থা বা সিনোরীয় ব্যবস্থা। ম্যানর প্রথা ছিল সামন্ততান্ত্রিক কৃষিভিত্তিক সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো। এই প্রথার মাধ্যমে সামন্তপ্রভু নিজের খাসজমি তাঁর অধীনস্থ কৃষকদের দ্বারা চাষ করাতেন এবং এর দ্বারা কৃষকদের ওপর শোষণের ধারা অব্যাহত রাখতেন।
ম্যানর ব্যবস্থা সম্পর্কে মার্ক ব্লখ-এর ব্যাখ্যা
ইতিহাসবিদ মার্ক ব্লখ তাঁর ‘French Rural History’ গ্রন্থে দুটি পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে ম্যানরের অর্থ প্রকাশ করেছেন। –
(১) অঞ্চলগত অর্থ
এক্ষেত্রে ম্যানর বলতে এমন এক ধরনের ভূসম্পত্তিকে বোঝায় যার সুনির্দিষ্ট সংগঠন পদ্ধতির ফলে কৃষি উৎপাদনের বড়ো অংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একজন মাত্র প্রভুর হাতে সঞ্চিত হত।
(২) মনুষ্যগত অর্থ
এক্ষেত্রে ম্যানর ছিল এমন এক ধরনের ব্যবস্থা যেখানে একদল মানুষ একজন প্রভুর অধীনস্থ হয়।
ম্যানর ব্যবস্থায় প্রভু ও কৃষকদের বসবাস
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রভুর পরিচালনায় ম্যানরগুলিতে কৃষকদের উৎপাদনকাজ সচল থাকত। ম্যানর এলাকায় কৃষকদের কৃষিকাজ সচল রাখার উদ্দেশ্যে সামন্তপ্রভু স্বয়ং তাঁর কর্মচারীদের নিয়ে সেখানে বসবাস করতেন।
(১) সামন্তপ্রভূর বাসস্থান
সামন্তপ্রভুর বসবাসের জন্য ম্যানরে দুর্গ পরিবেষ্টিত সুরক্ষিত একটি প্রাসাদোপম সুবিশাল বাড়ি থাকত। একে ‘ম্যানর হাউস’ বলা হত। বহিরাগত শত্রুর ওপর নজর রাখার উদ্দেশ্যে সামন্তপ্রভুদের অধিকাংশ বাসগৃহ কোনো ক্ষুদ্র পাহাড় বা উচ্চভূমিতে নির্মিত হত। দুর্গের দেওয়ালে বিভিন্ন ফুটো থাকত যেগুলি থেকে শত্রুর গতিবিধির দিকে নজর রাখা যেত এবং শত্রুর দিকে অস্ত্র নিক্ষেপ করা যেত। দুর্গের প্রবেশপথে পরিখার ওপর একটি টানা সেতু থাকত যা প্রয়োজনে তুলে দিয়ে আক্রমণকারীর হাত থেকে দুর্গকে রক্ষা করা যেত। এখান থেকে প্রভু ম্যানরে বসবাসকারী তাঁর অধীনস্থ প্রজাদের উপর শাসন বজায় রাখতেন।
(২) ভগ্ন কুটির
ম্যানরে বিপুল সংখ্যক কৃষক, ভূমিদাস ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ ভগ্ন কুটিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত।
ম্যানর ব্যবস্থায় ম্যানর হাউস
সামন্তপ্রভু, তাঁর আত্মীয়-পরিজন ও কর্মচারীরা ম্যানর হাউসে বসবাস করতেন। এখানে রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, শোয়ার ঘর, কর্মচারীদের থাকার ঘর, চাকরদের থাকার ঘর, উপাসনা কক্ষ, আস্তাবল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই থাকত। ম্যানর-প্রভু ও অভিজাতরা এখানে সীমাহীন সুখে ও বিলাসিতায় বসবাস করতেন। এই ম্যানর হাউসের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
- (১) ম্যানর হাউস অর্থাৎ ম্যানর-প্রভুর প্রাসাদে আসবাবপত্র খুবই কম থাকত। প্রাসাদের দেওয়ালে নানা কারুকার্যময় ভারী কাপড়ের পর্দা ঝোলানো থাকত যা ‘ট্যাপেস্ট্রি’ নামে পরিচিত। প্রাসাদের দেওয়ালে ঢাল, তরোয়াল, বর্শা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র, শিকার করা পশুর মাথা, শিং, দাঁত, চামড়া ইত্যাদি সাজানো থাকত। চুল্লির সাহায্যে ঘর উত্তপ্ত রাখা হত।
- (২) প্রাসাদের কেন্দ্রস্থলে একটি বিশালাকার খাবার ঘর থাকত। এখানে মশাল ও মোমবাতির আলোয় ভোজসভা বসত। ভোজসভায় প্রচুর পরিমাণ ষাঁড় ও শূকর সহ অন্যান্য পশুর মাংস, মদ, আপেল, পেয়ারা, শালগম, বিট প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকত।
- (৩) প্রাসাদ দুর্গের ভেতরে পাশা খেলা, দাবা খেলা, নাচ-গান, কৃত্রিম যুদ্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে ম্যানর-প্রভু ও অভিজাতরা আনন্দ উপভোগ করতেন।
ম্যানর ব্যবস্থায় স্থানীয় শাসন
মধ্যযুগের ইউরোপ-এ ম্যানরগুলি এক-একটি ছিল রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই ম্যানরগুলির কেন্দ্রে অবস্থান করত ম্যানর হাউস। এখান থেকে ম্যানর-প্রভু তাঁর বিভিন্ন কর্মচারীর সহায়তায় ম্যানরের শাসন পরিচালনা করতেন। সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় শাসনের ভিত্তিই ছিল ম্যানর ব্যবস্থা। স্থানীয় শাসন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ম্যানর-প্রভু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। যেমন –
- (১) ম্যানর-প্রভু তার অধীনস্থ ম্যানর অঞ্চলে বসবাসকারী স্থানীয় কৃষক ও ভূমিদাসদের ওপর সীমাহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেন। অন্যত্র বসতি নির্মাণ, ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেওয়া, সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মনোনীত করা, রাজকীয় আদালতে বিচার প্রার্থনা করা প্রভৃতি বিষয়ে স্থানীয় মানুষকে ম্যানর-প্রভুর অনুমতি নিতে হত।
- (২) প্রভু তাঁর ম্যানর অঞ্চল শাসনের উদ্দেশ্যে ফৌজদারি আইন প্রণয়ন করতেন। বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে ম্যানরের বাসিন্দাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় উদ্যোগ নিতেন।
- (৩) ম্যানর-প্রভু তাঁর ম্যানর এলাকায় রাস্তাঘাট, খাল, সাঁকো, বাঁধ প্রভৃতি নির্মাণ ও মেরামত করতেন। এ ছাড়া তিনি বাজার প্রতিষ্ঠা করতেন, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের সহায়তা করতেন।
- (৪) ম্যানর-প্রভু নিয়মিত বিচারালয় পরিচালনা করতেন এবং সকল স্থানীয় বিবাদের মীমাংসা করতেন। ম্যানরের সকল বাসিন্দা বিচারালয়ে হাজিরা দিতে বাধ্য ছিল। বিচারে জরিমানা, বেত্রাঘাত, বন্দি করা, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হত।
ম্যানর ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ম্যানরপ্রথা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ম্যানরপ্রথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(ক) ম্যানর-প্রভুর আধিপত্য
- (১) ম্যানর ব্যবস্থায় একজন প্রভুর অধীনে ম্যানর এলাকায় একটি অনুগত মানবগোষ্ঠী বসবাস করত। এদের ওপর ম্যানর-প্রভু চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করত। এই অনুগত কৃষকগোষ্ঠী ম্যানর-প্রভুর খাসজমি-সহ অন্যান্য জমিতে উৎপাদনকাজে নিযুক্ত থাকত। ম্যানর-প্রভু এই জমির যাবতীয় উৎপাদন ভোগ করত।
- (২) ম্যানরের প্রশাসন পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি স্টুয়ার্ড, বেইলিফ, রিভি প্রভৃতি উপাধিধারী উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকজন কর্মচারী নিয়োগ করতেন। স্টুয়ার্ড ম্যানর-প্রভুর সম্পত্তি ও বাণিজ্য দেখাশোনা করতেন এবং আদালত পরিচালনা করতেন। বেইলিফগণ উৎপাদন তদারকি করতেন, খাজনা ও জরিমানা আদায় করতেন এবং আয়ব্যয়ের হিসাব রাখতেন। রিভি কৃষকের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি নজর রাখতেন।
(খ) জমি
- (১) প্রতিটি ম্যানরে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি, পশুচারণ ভূমি, পতিত জমি, জঙ্গল, জলাভূমি, কৃষকের বাসগৃহ, শ্রমিক ও কারিগরদের বাসগৃহ, গির্জা ইত্যাদি থাকত। ম্যানরের জমি প্রধানত চার ভাগে বিভক্ত ছিল ডিমিন বা প্রভুর খাসজমি, দরিদ্র কৃষক (ভিলেন) ও ভূমিদাসদের বসবাস ও চাষের জমি, ও স্বাধীন কৃষকদের জমি এবং সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য জঙ্গল, তৃণভূমি, পশুচারণভূমি ইত্যাদি। সামন্তপ্রভু নিজের দখলে রাখা খাসজমিতে কৃষক ও ভূমিদাসদের বেগার খাটিয়ে ফসল উৎপাদন করতেন।
- (২) সামন্তপ্রভু তাঁর জমির বাকি অংশ তাঁর অধীনস্থ কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। ম্যানরে বসবাসকারী বারো থেকে ষাটটি কৃষক পরিবারের মধ্যে এই অবশিষ্ট জমি বণ্টিত হত। দরিদ্র কৃষকরা তাদের প্রভুকে বিভিন্ন ধরনের কর দিয়ে ও বেগার শ্রম দিয়ে এই জমি চাষ করতে পারতেন।
(গ) চাষবাস
- (১) ম্যানর ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক দিক। সামন্তপ্রভুর অধীনে ম্যানরের কৃষক ও ভূমিদাসরা উৎপাদন কার্যে অংশ নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখত। মূলত গ্রামের চাহিদা অনুসারেই উৎপাদন কার্য পরিচালিত হত। প্রথমদিকে ম্যানরের কৃষিজমিতে বছরে দুটি এবং পরে তিনটি চাষ হত।
- (২) অগণিত কৃষক ও ভূমিদাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ম্যানরের জমিতে খাদ্য ফসল। উৎপাদন করত এবং অন্যান্য কাজগুলি সম্পন্ন করে মানুষের জীবনযাত্রা সচল রাখত। অবশ্য অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদনের পরিমাণ কম হত।
(ঘ) উৎপাদন
- (১) ম্যানর-প্রভু নগদ মজুরিতে, ভূমিদাসদের দ্বারা এবং স্বাধীন কৃষকদের বাধ্যতামূলক বেগার শ্রমের মাধ্যমে জমিতে উৎপাদনের কাজ সচল রাখতেন। ম্যানরে কৃষি উৎপাদনে প্রথমদিকে গোরুর ব্যবহার বেশি হলেও দ্বাদশ শতক থেকে ঘোড়ার ব্যবহার বাড়তে থাকে। কোনো কোনো ম্যানরে সমবায়ের মাধ্যমে চাষের কাজ হত।
- (২) কাস্তে, কোদাল, বড়ো চাকাযুক্ত লাঙল প্রভৃতির ব্যবহার করে এবং মাঝেমধ্যে জমিতে চাষাবাদ বন্ধ রেখে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করা হত। ফসলের সঙ্গে ঋতুর সম্পর্ক উপলব্ধি করে ম্যানরে শরৎ ও বসন্তকালে গম ও রাই চাষ করা শুরু হয়। ম্যানরের বনাঞ্চলে শূকর পালন বিশেষ উপযোগী বলে বিবেচিত হত।
(ঙ) স্বয়ংসম্পূর্ণতা
ম্যানরগুলি ছিল এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম। প্রতিটি ম্যানরে বিভিন্ন পেশার মানুষ বসবাস করত এবং তারা ম্যানরের যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করত। প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় সামগ্রীও ম্যানরেই উৎপাদিত বা তৈরি হত। অর্থাৎ ম্যানরের প্রয়োজন বা চাহিদা অনুসারেই যাবতীয় উৎপাদনকার্য চলত।
উপসংহার :- স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিটি ম্যানরই ছিল সাজানো-গোছানো। ম্যানরের একদিকে পথের পাশে তৈরি হত কৃষকের কুঁড়েঘর, বাড়িগুলির চারপাশে থাকত সবজিবাগান, আস্তাবল ও হাঁস-মুরগির খামার। ম্যানরের অন্যদিকে থাকত চার্চ, যাজকদের ঘর ও কবরখানা। এ ছাড়া ম্যানরে কারিগরদের কারখানা, রুটি তৈরির বেকারি থাকত।
(FAQ) ম্যানর ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করত। এই গ্রামগুলিকেই ‘ম্যানর’ বলা হত।
ম্যানরে প্রাসাদের দেওয়ালে নানা কারুকার্যময় ভারী কাপড়ের পর্দা ঝোলানো থাকত যা ‘ট্যাপেস্ট্রি’ নামে পরিচিত।
স্টুয়ার্ড।
বেইলিফ।
রিভি।