স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা, গণতন্ত্রে আঘাত, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে রাষ্ট্রপতি, প্রকৃত শাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা, আইনসভা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র ধর্ম সম্পর্কে জানবো।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা, স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, স্বাধীন বাংলাদেশের গণতন্ত্রে আঘাত, স্বাধীন বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক শাসক রাষ্ট্রপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা, স্বাধীন বাংলাদেশের আইনসভা, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জানব।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাবাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা
স্বাধীনতা লাভ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রি
সংবিধান কার্যকর৪ নভেম্বর ১৯৭২ খ্রি
জাতির জনকবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান
পার্লামেন্টজাতীয় সংসদ
নিয়মতান্ত্রিক শাসকরাষ্ট্রপতি
প্রকৃত শাসকপ্রধানমন্ত্রী
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা

ভূমিকা :- দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বাংলাদেশের সংবিধান রচনা

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান রচনা কমিটি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে খসড়া সংবিধান উত্থাপন করা হয় এবং ৪ নভেম্বর থেকে এই সংবিধান কার্যকরী হয়। এই সংবিধানের সাহায্যেই দেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্‌বুদ্ধ করিয়াছিল – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ সংবিধানের মূলনীতি হইবে।”

বাংলাদেশের গণতন্ত্র আঘাতপ্রাপ্ত

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতির জনক’ শেখ মুজিবর রহমান আততায়ীদের হাতে নিহত হওয়ার পর সেদেশের গণতন্ত্র অস্তিত্বের সংকটে পড়ে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা

বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর সেদেশে প্রথমে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীকালে গণভোটের মাধ্যমে দেশের নাগরিকরা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সপক্ষে মতামত প্রদান করে। এর ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে রাষ্ট্রপতি

সংবিধান অনুসারে বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় দেশের সর্বোচ্চ শাসক হলেন রাষ্ট্রপতি। তবে বাস্তবক্ষেত্রে তিনি হলেন বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসক। তিনি জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি সরকারি কার্যাবলি বণ্টন ও পরিচালনার জন্য নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন। তিনি একসঙ্গে দু-বারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হতে পারেন না।

বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী

সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হলেন বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক। তিনিই হলেন দেশের সরকারের প্রধান। দেশের জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের জন্য এই পদে নির্বাচিত হন। তাঁর পরামর্শক্রমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দেশ পরিচালনা করেন।

ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা

সংবিধানে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি মন্ত্রীসভা থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার বিভিন্ন সদস্যদের নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ অপছন্দের ওপর মন্ত্রীদের পদে থাকা নির্ভর করে। মন্ত্রীসভার সদস্যরা জাতীয় সংসদের কাছে যৌথভাবে দায়ী থাকে।

বাংলাদেশের আইনসভা

সার্বভৌম বাংলাদেশের পার্লামেন্ট বা আইনসভার নাম হল জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদ এক কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদের ৩০০ জন সদস্য নাগরিকদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। ভোটারদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৪৫টি আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও পরবর্তীকালে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদই বাংলাদেশের শাসন পরিচালনার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে।

ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশের বহু দলীয় ব্যবস্থা

  • (১) স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় বহু দলীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP)। উভয় দলের মধ্যে সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক বোঝাপড়া খুবই তিক্ত।
  • (২) ইসলামপন্থী জামাত-ই-ইসলামির মতো দলগুলির সঙ্গে বি.এন.পি. জোট গড়ার চেষ্টা করে। অপরদিকে আওয়ামি লিগ সেদেশের বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে জোট গঠনের আগ্রহ দেখায়।
  • (৩) এ ছাড়া প্রাক্তন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিও বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই খুব সক্রিয় ছাত্র শাখা রয়েছে।

বাংলাদেশের এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা

ভারত-এর মতো বাংলাদেশ আয়তনে সুবৃহৎ এবং বহু জাতি ও ভাষাভাষী অধ্যুষিত নয়। ফলে এদেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন হয় নি। এখানে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত রয়েছে। দেশের রাজধানী ঢাকা থেকে সমগ্র দেশের শাসন পরিচালিত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিচারবিভাগ

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্টের নিম্নস্তরে হাইকোর্ট ও অন্যান্য স্তরের আদালত রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে। রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। বিচারপতিরা ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ও রাষ্ট্রভাষা

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তীকালে সামরিক শাসক মহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করেন। তবে একইসঙ্গে এটাও বলা হয় যে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সহ অন্যান্য ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার সুনিশ্চিত করবে। বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে দেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে সাম্যের অধিকার

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে যে, দেশের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থান ভেদের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না।

বাংলাদেশে মৌলিক অধিকার

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের বেশ কয়েকটি মৌলিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, সরকারি পদে নিয়োগে সমান সুযোগ, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধকরণ, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, সমাবেশের অধিকার, সংগঠনের অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি। মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন আইনসভায় গৃহীত হলেও তা বাতিল বলে গণ্য হয়।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা

স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৩ মাসের জন্য ক্ষমতাসীন হয়ে দেশের সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করে এবং নির্বাচনে জয়ী নতুন সরকারকে ক্ষমতাসীন করে নিজে বিদায় নেয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যায়ন

  • (১) অনেক স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বে বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রেই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাবাহিক আদর্শ তুলে ধরতে বা রাজনৈতিক স্থিরতা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়।
  • (২) ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে (১৫ আগস্ট) রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের সপরিবারে দুষ্কৃতিদের হাতে নিহত হওয়া, সামরিক অভ্যুত্থান, গুপ্তহত্যা প্রভৃতি ঘটনাই এর প্রমাণ। দেশের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ পরবর্তীকালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান, হুসেইন মহম্মদ এরশাদ প্রমুখ রাষ্ট্রপতির দ্বারা বারংবার পদদলিত হয়েছে।

উপসংহার :- যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিঃস্বার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধে কাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদেরই জীবন ও ধর্মের নিরাপত্তা সেখানে সুনিশ্চিত নয় বলে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সংখ্যালঘু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে এসেছে এবং এখনও আসছে।

(FAQ) স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে কবে?

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে।

২. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন?

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

৩. কার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়?

ডঃ কামাল হোসেন।

৪. বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকরী হয় কখন?

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর।

৫. বাংলাদেশের পার্লামেন্ট বা আইনসভার নাম কি?

জাতীয় সংসদ।

৬. বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক বা নাম সর্বস্ব শাসক কে?

রাষ্ট্রপতি।

৭. বাংলাদেশের প্রকৃত শাসক কে?

প্রধানমন্ত্রী।

Leave a Comment