সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের অবস্থান

সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের অবস্থান প্রসঙ্গে সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম, সামন্ততন্ত্রে সার্ফ ও ভিলেনদের অবস্থা, লর্ডের শোষণ, সামন্তন্ত্রের খামার বাড়িতে কৃষকদের অবস্থা, সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা, সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের জীবনযাত্রা, সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের প্রদত্ত কর সমূহ ও কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের অবস্থান প্রসঙ্গে সামন্ততন্ত্রে সার্ফ ও ভিলেনদের অবস্থা, সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম, সামন্তন্ত্রের খামার বাড়িতে কৃষকদের অবস্থা, সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের জীবনযাত্রা, সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের প্রদত্ত কর সমূহ, সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা ও সামন্ততন্ত্রে কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানব।

সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের অবস্থান

ঐতিহাসিক ঘটনাসামন্ততন্ত্রে কৃষকদের অবস্থান
কৃষির কাজসার্ফ
ছোট কৃষকভিলেন
খামার বাড়িম্যানর
ধর্মকরটাইথ
সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের অবস্থান

ভূমিকা :- “An Introduction to World History”-এর লেখক George W. Southgate সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগণ যারা সার্ভ ও অন্যান্য লর্ডের জমিতে কাজ করত অর্থাৎ ভূমিদাস বা সার্ফদের বিষয়টির কথা বলেছেন।

সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম

এই সামন্ততন্ত্র-এ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমিদাস বা সার্ফরাই কৃষির কাজ করত। কৃষকদেরকে অবশ্য অনেকগুলি ভাগে ভাগ করা যায়। ‘ক্রফটার’ ও ‘কটার’ নামক কৃষকদের অবস্থা ছিল সঙ্গিন। তাদের নিজস্ব জমি না থাকার ফলে সামন্তপ্রভু বা লর্ডদের জমিতে তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হত। কিন্তু প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিকের পরিবর্তে তারা শোষণের শিকার হত। তারা ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রে সার্ফ ও ভিলেনদের অবস্থা

  • (১) ছোট কৃষকরা ভিলেন নামে পরিচিত ছিল। ভিলেনরা তাদের জমিগুলি ধনী কৃষকদের দিয়ে আনুগত্য লাভ করত। তারা ছিল স্বাধীনচেতা কৃষক। সার্ফ বা ভূমিদাসরা একেবারেই স্বাধীন ছিল না। জমি ছেড়ে সার্ফরা কোথাও যেতে পারত না। সার্ফ ও ভিলেনরা পরবর্তী সময়কালে অর্থ দিয়ে কিছু পরিমাণ জমির উপর মালিকানাও লাভ করত।
  • (২) সার্ফ ও ভিলেনরা ত্রয়োদশ শতকে একই অবস্থায় ছিল। ‘ভিলা’ বা ম্যানরে’ অবস্থান করার জন্য শ্রমজীবী এক শ্রেণীর কৃষক ‘ভিলেন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। ভিলেনরা দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি অনুযায়ী জমি চাষ করত।

সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের উপর লর্ডের শোষণ

  • (১) লর্ডের জমিতে কৃষকদের মাসে ৮ থেকে ১২ দিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে দিতে হত। লর্ডের অনুমতি ছাড়া এরা মেয়ের বিয়ে দিতে পারত না। এমনকি গরু কিংবা ঘোড়াও বিক্রি করতে পারত না। লর্ড কোনো কৃষককে আহত বা মেরে ফেলতে পারতেন না। কিন্তু কখনো কখনো লর্ড এই ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে ফেলতেন।
  • (২) কৃষকরা লর্ডকে সন্তুষ্ট করার মত রাজস্ব ও শ্রম দিতে পারলে তবেই জমি ভোগ করার অধিকার পেত। জমির ফসল কাটবার সময় উপস্থিত হলে কৃষক অন্ততপক্ষে মাসে ২৫ দিন কাজ করত। ইস্টার উৎসব-এর সময়েও লর্ডকে নির্দিষ্ট সংখ্যক মুরগি দেওয়ার রেওয়াজ কৃষকদের মধ্যে ছিল।
  • (৩) George Duby তাঁর ‘The Early Growth of the European Economy : Warriors and peasants’ গ্রন্থে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকদের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে সামন্তপ্রভু বা লর্ডদের শোষণের দিকটি বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছেন।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্তন্ত্রের খামার বাড়িতে কৃষকদের অবস্থা

  • (১) মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের ক্ষেত্রে ম্যানর বা খামার বাড়ি ছিল উল্লেখযোগ্য বিষয়। লর্ডদের খামারের সঙ্গে যুক্ত জমিগুলির চাষের কাজে নিযুক্ত ছিল ভূমিদাস বা সার্ফরা। খামারবাড়ি বা ম্যানরের বাইরে কৃষিক্ষেত্র ছিল। এই জমিগুলিতে সার্ফরা ছাড়াও কৃষক শ্রেণীও চাষ করত। সামন্তপ্রভুদের কাজ ছিল যুদ্ধবিগ্রহ।
  • (২) পাদ্রিরা গির্জাতে উপাসনা করত। সামন্ত ও পাদ্রিরা ছাড়া অন্য জনগণরা পরিশ্রম করত। এই জনগণের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কৃষকশ্রেণী। সার্ফরা ছাড়া কৃষকরা পরিশ্রম করে যে সামান্য ফসল ও অর্থ রোজগার করত তা তাদের জীবনে শান্তির বাতাবরণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা

  • (১) মধ্যযুগের ইউরোপে স্বাধীন কৃষকদের থেকে সার্ফ বা ভূমিদাসদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। সার্ফদের নিজের অধিকারে কোনো জমি প্রায় ছিল না। এরা লর্ডদের জমিতে বিনা পারিশ্রমিকেই চাষ করে দিত। কৃষিকাজ ছাড়াও এরা লর্ডদের আদেশে অনেকক্ষেত্রেই রাস্তাঘাট সারাইয়ের কাজ বা সেতু মেরামতের কাজও করে দিত।
  • (২) সার্ফরা ছাড়াও কৃষকদের দিয়েও লর্ডরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করিয়ে নিত। বিনা পারিশ্রমিকে কৃষকরা যে শ্রম দিত তা কর্ভি নামে পরিচিত ছিল। লর্ডদের ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষকরা নিজেদের জমির দিকে ভালোভাবে নজর না দেওয়ার ফলে অনেক সময় ফসল উৎপাদন কম হত।
  • (৩) লর্ডের বড় ছেলের নাইট উপাধি গ্রহণের সময় বা লর্ডের বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হত। কৃষক তার ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিতে গেলেও লর্ডকে এক ধরনের কর দিতে হত। এইভাবে লর্ডদের কাছে কৃষকদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। কৃষকরা কর না দিতে পারলে চুনভর্তি গুদামে রেখে দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হত।
  • (৪) লর্ড শিকারে গেলে শিকারের পিছু নিত কৃষকরা। লর্ডরা শিকার করতে গিয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দিলেও কৃষকদের বলার কিছু ছিল না। কৃষকরা ঠিকমত ফসল উৎপাদন না করতে পারলে কোন অজুহাতেই কাজ হত না। বরং লর্ডকে কর পরিশোধ করতে কৃষককে বাধ্য করা হত। সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের ব্যক্তি স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।
  • (৫) কৃষকরা কোনো কারণে কর না দিতে পারলে বা তার মৃত্যু হলেও কৃষকটির পরিবারকে অব্যাহতি দেওয়া হত না। সেই মৃত কৃষকটির ভাল গরু ও মহিষটি লর্ড নিয়ে নেওয়ার পর তার মৃতদেহ সৎকারের অনুমতি পাওয়া যেত। কৃষকদের এই শোচনীয় অবস্থার সাক্ষী ছিল মধ্যযুগের ইউরোপ।

মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের জীবনযাত্রা

  • (১) সামন্ততন্ত্রের কৃষক এবং সার্ফরা ছিল অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু কৃষকদের জীবনযাত্রা ছিল অভ্যস্ত নিম্ন মানের। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, ছোট ছোট ঘরে তাদের বসবাস করতে হত। শীতের সময়ে পরণের বস্ত্রটুকু ছাড়া অতিরিক্ত গরম পোশাকও তাদের জুটত না। কৃষকরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থেকে অন্যদের মুখে খাবার তুলে দিলেও নিজেদের খাবার জুটত না।
  • (২) প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অন্যান্য কারণে জমির ফসল নষ্ট হলে তার দায় কৃষককে বহন করতে হত। সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের অবস্থান বর্ণনা করতে গেলে দেখা যায়, অসহনীয় দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে তাদের জীবনধারণ করতে হত। যদিও সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল এই কৃষক শ্রেণী এবং serf-রা।

সামন্ততন্ত্রে কৃষকদের প্রদত্ত করসমূহ

  • (১) মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকদের উপর নানান ধরনের করের বোঝা চাপানো হয়েছিল। কৃষকরা যা রোজগার করত বা তাদের উৎপন্ন ফসলের অংশ বিশেষ পেত তা কর মেটানোর পর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। কৃষকদের আয়ের ৮৫ শতাংশ অংশই সামন্তপ্রভু বা লর্ডরা বিভিন্ন কর আরোপ করে নিয়ে নিতেন।
  • (২) কৃষকদের করগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বানালিতে। এই কর হাট কর বা পথ কর হিসাবে নেওয়া হত। হাটে গিয়ে ফসল বিক্রি করলে কৃষকদের থেকে এই কর আদায় করা হত। ম্যানরের মধ্যে খামার বাড়ির মধ্যে দিয়ে ফসল নিয়ে কৃষকরা গেলেও লর্ডকে ফসলের একটা অংশ দিতে হত। কারণ, খামারবাড়ি বা ম্যানর নিয়ন্ত্রণ করত লর্ডরা।
  • (৩) গম ও আঙুর পেষানোর যন্ত্র লর্ডদের কাছে থাকায় লর্ডদের ওখানে গম ও আঙুর পিষতে গেলে লর্ডকে কর দিতে হত। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকদের শোষণের অন্যতম হাতিয়ার ছিল প্রেসটেশন নামক কর। এই করটি এক ধরনের আপ্যায়ন কর। যার মাধ্যমে লর্ডকে খোসামোদ করা হত।
  • (৪) কৃষকরা পরিশ্রমের পর যখন ফসল কেটে ঘরে তুলত সেই সময় লর্ডরা তাদের দলবল নিয়ে কৃষকদের ঘরে থাকত। এর ফলে লর্ড ও তাদের সঙ্গে আসা অন্যান্যদের উপযুক্ত আপ্যায়ন করতে গিয়ে কৃষকদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসত। টাইথ নামক এক প্রকার করও কৃষকদের থেকে আদায় করা হত। চার্চকে দেওয়া একটি ধর্মকর ছিল টাইথ। চার্চের যাজকরাও লর্ডদের মতই কৃষকদের শোষণ করতে দ্বিধাবোধ করে নি।
  • (৫) ক্যাপিটাশিও নামক করটি ভূমিদাস পরিবার কিংবা কৃষক পরিবারের প্রত্যেকের কাছ থেকে আদায় করা একটি বাধ্যতামূলক কর ছিল। টাইলে বা মেলায়েজ নামক করটি ছিল কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের উপর ধার্য একটি কর। জমিতে উৎপাদিত ফসল ছাড়াও ডিম, হাঁস-মুরগি, গরুর মাংস-দুধ, মাছ প্রভৃতির ভাগও লর্ডকে দিতে হত। কৃষকরা এইসব কর ছাড়াও যুদ্ধকর ও স্থানীয় নানা রকম কর দিতে বাধ্য হতো।

উপসংহার :- সব মিলিয়ে কৃষকরা ছিল লর্ডের আজ্ঞাবহ দাস, বিশেষ করে যাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও লর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়েই কৃষককে চলতে হত।

(FAQ) সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় কৃষকদের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমিদাসরা কি নামে পরিচিত ছিল?

সার্ফ।

২. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছোট কৃষকরা কি নামে পরিচিত ছিল?

ভিলেন।

৩. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় খামার বাড়ি কি নামে পরিচিত ছিল?

ম্যানর।

৪. সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকরা চার্চকে কি কর দিত?

টাইথ।

Leave a Comment