প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি বিপ্লব

প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি বিপ্লব প্রসঙ্গে কারিগরি বিপ্লব, প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অগ্ৰগতি, কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল, সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল, উৎপাদন শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, উৎপাদন শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার ফলাফল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

কারিগরি বিপ্লব ও প্রযুক্তিবিদ্যা বা প্রযুক্তিগত বিপ্লব প্রসঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল, উৎপাদন শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল এবং এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলাফল বিষয়ে জানব।

প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি বিপ্লব

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি বিপ্লব
বারুদের ব্যবহার১৩২৬ খ্রি
স্পিনিং জেনিহারগ্ৰিভস
উড়ন্ত মাকুজন কে
নিরাপত্তা বাতিহামফ্রে ডেভি
শিল্প বিপ্লবইংল্যান্ড
প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি বিপ্লব

ভূমিকা :- আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বিজ্ঞানের নানা শাখায় গবেষণা শুরু হয়। রজার বেকন, কেপলার, গ্যালিলিও, হুক, গিলবার্ট প্রমুখ বিজ্ঞানী আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করেন। পরবর্তীকালে নিউটন, ল্যাভয়েসিয়ার, চালর্স বয়েল, উইলিয়াম হার্ভে, হারগ্রিভস, ডেভি, জেমস ওয়াট প্রমুখ এই ভিত্তিকে আরও শক্ত করেন।

কারিগরি বিপ্লব

এই সময় থেকে ব্যাবহারিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা শাখায় উন্নতি ঘটতে থাকে। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপ-এ প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি ব্যবস্থায় প্রভূত অগ্রগতি ঘটে। একে ‘কারিগরি বিপ্লব’ বা ‘Technological Revolution’ বলা হয়।

প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অগ্ৰগতি

কৃষি, সামরিক শিল্প, উৎপাদন শিল্প, জাহাজনির্মাণ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অগ্রগতি ঘটে।

কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(ক) উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার

  • (১) পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক নাগাদ ইউরোপে কৃষিব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে যায়। এই সময় কৃষিপণ্যের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। চাহিদা অনুসারে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের ব্যবহার শুরু হয়।
  • (২) পূর্বে লাঙল, বলদ বা ঘোড়া এবং ফসল কাটার যন্ত্র – এই ছিল কৃষি যন্ত্রপাতি। কিন্তু কৃষি বিপ্লবের সময় থেকে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে। কৃষিকাজে জমিতে লাঙল দেওয়া, বীজ বপন করা, ফসল কাটা, ফসল মাড়াই করা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়।
  • (৩) এই যুগে কৃষি প্রযুক্তির উন্নতির প্রধান কয়েকটি দিক ছিল লোহা দিয়ে মজবুত কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ, যেমন – ভারী লাঙল তৈরি, বনভূমি কেটে কৃষিজমি উদ্ধারের জন্য ভারী কুঠার তৈরি, জমির ধরন অনুসারে বিভিন্ন জমিতে পৃথক শস্যচাষের চিন্তাভাবনার প্রসার ইত্যাদি।

(খ) ঘোড়ার ব্যবহার

কৃষি যন্ত্রপাতিগুলি পুরোনো কৌশলে নির্মিত হলেও এই যন্ত্রপাতিগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির কৌশল চালু হয়। বীজ বপনের ক্ষেত্রে ড্রিল লাঙলের ব্যবহার শুরু হয়। বলদ বা ষাঁড়ের পরিবর্তে কৃষিকাজে ঘোড়ার শক্তিকে কাজে লাগানো হয়। জমিতে ঘোড়ায় টানা ‘হ্যারো’ নামে লোহার ফ্রেমে কাঁটা লাগানো এক ধরনের মই-এর ব্যবহার শুরু হয়। কৃষি ও পরিবহণের কাজে অশ্বশক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ঘোড়ার খুরে লোহার ব্যবহার শুরু হয়।

(গ) আবাদি জমি ও জলসেচের প্রসার

এই সময় থেকে কৃষির পদ্ধতিগত দিকেরও অগ্রগতি ঘটতে থাকে। ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও যুদ্ধবিগ্রহের আধিক্য না থাকায় মানুষের মৃত্যুর হার কমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বাড়তি কৃষিজমির প্রয়োজন দেখা দেয়। –

(১) কৃষিজমির প্রসার

বাড়তি কৃষিজমির প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে কৃষিজমির প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমি উদ্ধার করা হয়। সমুদ্রের উপকূলবর্তী দেশগুলি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের উপকূলে বাঁধ দিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার শুরু করে। ১৫৬৫ থেকে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমুদ্রের উপকূল অঞ্চল থেকে প্রায় ৪৪,০০০ হেক্টর জমি উদ্ধার করে তাতে কৃষির প্রসার ঘটানো হয়।

(২) জলসেচ

জমিতে জলসেচ করার পাম্পিং প্রযুক্তির উন্নতি ঘটে। ইউরোপের নিম্নাঞ্চল তথা উত্তর সাগরের নিকটবর্তী বিভিন্ন দেশে অসংখ্য খাল ও নালা তৈরি করে জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়।

(ঘ) উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন

জমির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। জমিতে বারবার একই ফসল চাষ না করে পর্যায়ক্রমিক বা রোটেশন (Rotation) প্রথায় বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শষ্যের চাষ প্রচলিত হয়। নিবিড় প্রথায় চাষের ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। আবার জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কিছুদিন জমি অনাবাদি রেখে তাতে পশুচারণ করার ব্যবস্থা হয়। জমিতে সার প্রয়োগেরও কৌশলগত উন্নতি ঘটে।

কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল

কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল গুলি হল –

(১) উৎপাদন বৃদ্ধি

কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষি পদ্ধতির অগ্রগতির ফলে ইউরোপে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(২) পণ্যমূল্য বৃদ্ধি

এই সময় কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকেরও সুবিধা হয়।

(৩) উদ্‌বৃত্ত উৎপাদন

অধিক উৎপাদনের আশায় কৃষকরা উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হয়। উদ্‌বৃত্ত শস্য বিক্রি করে কৃষকের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে।

(৪) বাণিজ্যের প্রসার

নিজেদের প্রয়োজনীয় ফসল চাষের পাশাপাশি কৃষিজমিতে বাণিজ্য ফসল উৎপাদন শুরু হয়। এর ফলে বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।

(৫) শিল্পবিপ্লবে সহায়তা

শিল্পের কৃষিভিত্তিক কাঁচামাল, বিশেষ করে তুলো উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপে বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটে এবং তা শিল্পবিপ্লবের প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে।

(৬) কৃষক শোষণ

অবশ্য কৃষি, ক্রমে লাভের মুখ দেখতে শুরু করলে এতে ধনী অভিজাত ও ভূস্বামীদের নজর পড়ে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উপর বিভিন্ন পথে শোষণ শুরু হয়।

সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই ঘটনা সামরিক বিপ্লব নামে পরিচিত। ইউরোপে সামরিক বিপ্লব ঘটে গেলে সামরিক প্রযুক্তির অগ্রগতি অনিবার্য হয়ে পড়ে। পুরোনো অস্ত্রশস্ত্রগুলি এই সময় আরও উন্নত হয় এবং নতুন প্রযুক্তিতে বিভিন্ন অগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হতে থাকে।

সামরিক প্রযুক্তির অগ্ৰগতি সম্পর্কে ব্ল্যাক এর মন্তব্য

জেরোমি ব্ল্যাক মনে করেন যে, সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, চিনতুরস্ক-এ সর্বাধিক অগ্রগতি ঘটেছিল।

(ক) বারুদ উৎপাদন

  • (১) খ্রিস্টীয় নবম শতকে চিনে সোরা, কাঠকয়লা ও গন্ধকের সংমিশ্রণে বারুদের আবিষ্কার হয়। চিন থেকে আরবদের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি ইউরোপে পৌঁছোয় এবং পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে বারুদের ব্যবহার বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
  • (২) ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের যুদ্ধে সর্বপ্রথম বারুদের ব্যবহার হয়েছিল বলে একটি ফ্লোরেন্সীয় তথ্য থেকে জানা যায়। ক্রমে সমরাস্ত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বারুদের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই ভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভূত অগ্রগতি ঘটে।

(খ) কামান ও যুদ্ধোপযোগী নৌযানের ব্যবহার

  • (১) সামরিক বাহিনীতে গোলন্দাজ বাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ধাতুবিদ্যার অগ্রগতির ফলে উন্নতমানের এবং বড়ো কামান ও গোলা তৈরি হতে থাকে। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে যুদ্ধে কামান ব্যবহার করে অবরুদ্ধ দুর্গের দেওয়াল ও দরজা ভেঙে ফেলার প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটে।
  • (২) জাহাজে দূরপাল্লার কামান বসানো শুরু হলে নৌযুদ্ধ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ছোটো ছোটো কামান বসানো জাহাজগুলি যুদ্ধের সময় দ্রুতগতিতে ছুটতে বা ঘুরে যেতে পারত। দ্রুতগতিসম্পন্ন ছোটো জাহাজ এবং দূরদূরান্তের নৌযুদ্ধে অংশ নেওয়ার উপযোগী বড়ো জাহাজ নির্মাণে প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটে।

(গ) নতুন দুৰ্গনির্মাণ কৌশল উদ্ভাবন

  • (১) কামানের গোলার সাহায্যে দুর্গের দেওয়াল ভাঙার প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলে নতুন ধরনের এমন দুর্গনির্মাণ কৌশলের উদ্ভাবন ঘটে যাতে কামানের গোলার দ্বারা তা ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুন ধরনের দুর্গনির্মাণকে জেফ্রি পার্কার সামরিক বিপ্লবের অন্যতম অঙ্গ বলে উল্লেখ করেছেন।
  • (২) কামানের আক্রমণ থেকে দুর্গকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ইতালির স্থপতি আরবেরতি করাতের দাঁতের মতো অনিয়মিত রেখায় দুর্গের প্রাকার তৈরি কথা বলেন। এই দুর্গনির্মাণ কৌশল সর্বপ্রথম ইতালিতে শুরু হয়েছিল বলে এই কৌশল ‘ট্রেস ইতালিয়েন’ নামে পরিচিত।
  • (৩) মজবুতভাবে নির্মিত এই দুর্গের অভ্যন্তরে কামান বসানোরও ব্যবস্থা থাকত। এই দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থান করে শত্রুর বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা এবং শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা উভয়ই সুবিধাজনক ছিল।

(ঘ) অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তন

কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের (১৪৫৩ খ্রি.) পর থেকে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের ব্যবহার্য অস্ত্রশস্ত্রেও পরিবর্তন আসতে থাকে। যেমন –

  • (১) সপ্তদশ শতকের মধ্যে সৈনিকের তরোয়াল ও তিরধনুকের প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়।
  • (২) অশ্বারোহী সৈন্যকে প্রতিহত করার জন্য তৈরি হয় এক ধরনের দীর্ঘ বর্শা।
  • (৩) সৈনিকের জন্য নতুন ধরনের হেলমেট তৈরি হয় যা সৈনিকের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে।
  • (৪) এই সময় থেকে ইতালির সৈনিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে ‘যুদ্ধ হাতুড়ি’ (War Hammer) নামে এক ধরনের ভারী ও লম্বা অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে।
  • (৫) ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড ও জার্মানির সৈনিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হাতে বহন করে চালানো যায় এমন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। সৈনিকের হাতে চলে আসে লম্বা নলযুক্ত এক ধরনের নতুন পিস্তল।
  • (৬) ষোড়শ শতকে স্পেনের সৈনিকরা প্রচুর পরিমাণে গাদাবন্দুক ব্যবহার করতে থাকে। উন্নত প্রযুক্তিতে নির্মিত বন্দুক যুদ্ধক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
  • (৭) যুদ্ধে বন্দুকের সাহায্যে তির ছোঁড়া, বুলেট ছোঁড়া প্রভৃতি পদ্ধতি নতুন সামরিক প্রযুক্তির ভিত্তি রচনা করে।

সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল

যুদ্ধক্ষেত্রে বা সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল গুলি হল –

(১) নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরি

সামরিক প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরি হয় এবং মারণাস্ত্রের কার্যকারিতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

(২) যুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি

ফলে যুদ্ধ আগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ধ্বংস, মৃত্যু পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

(৩) অর্থনৈতিক দুরবস্থা

উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণে দেশের প্রভূত অর্থসম্পদ ব্যয়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট চাপ পড়ে। অস্ত্র- প্রযুক্তির ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়।

(৪) অতিরিক্ত কর আরোপ

এর পরিণতিতে নাগরিকদের ওপর প্রত্যক্ষ কর সহ অন্যান্য করের বোঝা বৃদ্ধি পায়।

উৎপাদন শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের ব্যবহার শুরু হয়। ইতিপূর্বে ইউরোপে হাওয়া কল প্রচলিত হলে এই কল ব্যবহার করে উৎপাদনে গতি আসে। এরপর জলচাকার মাধ্যমে জলশক্তির ব্যবহার শুরু হলে এই গতি আরও ত্বরান্বিত হয়। জলশক্তিকে কাজে লাগিয়ে খনিজ উত্তোলন ও ধাতুশিল্পেও অগ্রগতি সম্ভব হয়।

(ক) বয়নশিল্পে অগ্রগতি

  • (১) ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে সুতোকাটার চরকা আবিষ্কৃত হলে বয়নশিল্পে অগ্রগতি ঘটে। পরবর্তীকালে তাঁতের প্রযুক্তিতে রোলারের ব্যবহার শুরু হয় এবং পদচালিত তাঁতের আবিষ্কার হয়। সুতো উৎপাদন ও সুতো কাটার প্রয়োজনে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন ঘটতে থাকে।
  • (২) ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইউরোপে বয়নশিল্পে ‘স্পিনিং হুইল’-এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সাধারণ তাঁতি হারগ্রিভস (Hargreaves), নাপিত আর্করাইট (Arkwright), গ্রাম্য যাজক কার্টরাইট (Kartright) প্রমুখ বয়ন প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন ঘটান।
  • (৩) হারগ্রিভসের স্পিনিং জেনি সুতো কাটার কাজে, আর্করাইটের ওয়াটার ফ্রেম (১৭৬৯ খ্রি.) জলশক্তির সহায়তায় সুতো কাটার কাজে এবং কার্টরাইটের আবিষ্কৃত জলশক্তি-চালিত তাঁত (১৭৮৫ খ্রি.) বয়নশিল্পের প্রভূত উন্নতি ঘটায়।
  • (৪) জন কে (John Key) ফ্লাইং শাটল বা উড়ন্ত মাকুর উদ্ভাবন করলে (১৭৩৩ খ্রি.) বয়নশিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এই সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বয়নশিল্পের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের কায়িক পরিশ্রমও অনেকাংশে লাঘব হয়।

(খ) কারখানা ব্যবস্থায় সার্বিক অগ্রগতি

  • (১) প্রযুক্তির অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপে বিভিন্ন ছোটো ছোটো কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। এইসব কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি হতে থাকে। প্রথমদিকে প্রযুক্তির ব্যবহারে কুটিরশিল্প ধরনের উৎপাদন হলেও পরবর্তীকালে বড়ো বড়ো কারখানা গড়ে উঠতে থাকে।
  • (২) এর চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে সপ্তদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের সময়। এই সময় ইউরোপের বড়ো বড়ো কারখানাগুলিতে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত পণ্যের মানও যথেষ্ট উন্নত হয়। এক কথায়, প্রযুক্তির বিকাশই ইউরোপে শিল্পবিপ্লবকে সম্ভব করেছিল।

(গ) খনিজ উত্তোলন ও ধাতুশিল্পে অগ্রগতি

  • (১) প্রযুক্তিবিদ্যার নানা শাখায় অগ্রগতির ফলে ইউরোপে ধাতু সহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের চাহিদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ফলে খনিজ উত্তোলন প্রযুক্তির অগ্রগতি একপ্রকার অনিবার্য হয়ে পড়ে। খনিজ উত্তোলনে জলশক্তির ব্যবহার শুরু হয়। চতুর্দশ শতকে লোহা ঢালাইয়ের প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলে ধাতুশিল্পে যথেষ্ট উন্নতি ঘটে।
  • (২) জন স্মীটন ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে লোহা, গলাবার চুল্লি বা ব্লাস্ট ফার্নেস আবিষ্কার করেন। ঢালাই লোহা ও ইস্পাত উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হামফ্রে ডেভি Safety Lamp বা নিরাপত্তা বাতি আবিষ্কার করলে খনির কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। শিল্পের প্রয়োজনে কয়লার চাহিদা বৃদ্ধি পেলে খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রযুক্তিও উন্নত হয়।

(ঘ) বাষ্পশক্তি ও পরিবহণে অগ্রগতি

  • (১) ইউরোপে ক্রমে বাষ্পশক্তির প্রযুক্তিও উন্নত হতে থাকে। ডেনিস পেপিন প্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার (১৬৮৮ খ্রি.) করেন। পরবর্তীকালে জেমস ওয়াট আরও উন্নত বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার (১৭৬৯ খ্রি.) করলে এর দ্বারা কলকারখানার বড়ো বড়ো যন্ত্র চালানো সম্ভব হয়।
  • (২) জর্জ স্টিভেনসন ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিন আবিষ্কার করলে পরিবহণ ব্যবস্থায় যুগান্তর আসে। জন ম্যাকাডাম পিচের রাস্তা তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার করলে সড়ক পরিবহণের আরও অগ্রগতি ঘটে।

উৎপাদন শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলাফল

উৎপাদনশিল্পের প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ফলগুলি হল –

(১) কায়িক শ্রম হ্রাস

উৎপাদন শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে নির্মাণকার্যে মানুষের কায়িক পরিশ্রম বহুগুণে হ্রাস পায়।

(২) শিল্পবিপ্লবের পটভূমি

প্রযুক্তির অগ্রগতি ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পটভূমি প্রস্তুত করে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত নতুন ব্যবহার্য সামগ্রী মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

(৩) শ্রমিক শ্রেণির উত্থান

শিল্পবিপ্লবের সূত্র ধরে ইউরোপের শহরগুলির শিল্প-কারখানায় শ্রমিক শ্রেণির উত্থান ঘটে।

(৪) বিলাসিতা বৃদ্ধি

প্রযুক্তিগত উন্নতির পরোক্ষ প্রভাবে মানুষের জীবনে বিলাসিতা বৃদ্ধি পায়।

(৫) বাণিজ্যের প্রসার

এ ছাড়া প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পরোক্ষ প্রভাবে ইউরোপের দেশগুলিতে বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে।

জাহাজনির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি

প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতির ফলে আধুনিক যুগে জাহাজনির্মাণ শিল্পেও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। এর ফলে সুদীর্ঘ জলপথ পেরিয়ে মানুষ নতুন নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছোতে পেরেছিল। একই সঙ্গে এই শিল্পের অগ্রগতি বিভিন্ন দেশের শিল্প, বাণিজ্য, যুদ্ধবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিকেও প্রভাবিত করেছিল।

(ক) জলযানের সহায়ক সামগ্রীর ব্যবহার

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) আগেকার জলযান

আধুনিক জাহাজনির্মাণ প্রযুক্তির অগ্রগতির পূর্বে নদী বা সমুদ্রে জলযানের গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। সে যুগে জলযান চালানোর ক্ষেত্রে দাঁড়, বৈঠা প্রভৃতিই ছিল প্রধান উপকরণ।

(২) কম্পাস ও যান্ত্রিক ঘড়ির ব্যবহার

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে জাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কম্পাসের আবিষ্কার এবং চতুর্দশ শতকে যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কারের ঘটনা সমুদ্র যাত্রা কে সহজ করে দেয়। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে নাবিকগণ বহুদূরের দৃশ্য দেখার সুযোগ পান।

(৩) মানচিত্র

চতুর্দশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে মানচিত্র অঙ্কনে উন্নতির ফলে দূরদূরান্তের মহাসাগরে জাহাজ চলাচলে আরও সুবিধা হয়। জাও-দ্য-বারোস, ফান্-দেন-ব্রুক, পীরি-দ্য-রাইস, ম্যাগেলান প্রমুখ ইউরোপ তথা বিশ্বের নির্ভরযোগ্য মানচিত্র তৈরি করেন।

(৪) আধুনিক প্রযুক্তি

পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজনির্মাণ শুরু হয়।

(খ) জাহাজনির্মাণ প্রযুক্তিতে অগ্রগতি

  • (১) খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতক নাগাদ জাহাজে সর্বপ্রথম হালের ব্যবহার শুরু হলে জলযানের দ্রুত উন্নতি হয়। কিছুকালের মধ্যেই জাহাজে মাস্তুল, পাল, দড়িদড়া প্রভৃতি ব্যবহারের ফলে জাহাজের গতি বৃদ্ধি পায়। এই সময় জাহাজের গতি নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তিও আবিষ্কৃত হয়।
  • (২) বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রয়োজনে জলপথে দূরদূরান্তে যাতায়াতের প্রয়োজনে আরও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে জাহাজনির্মাণ শুরু হয়। চতুর্দশ শতকে নদীপথে লকগেট তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলে জলপথে যোগাযোগের অগ্রগতি ঘটে। পঞ্চদশ শতকে জাহাজনির্মাণ শিল্পে বা জলযান তৈরিতে উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটে।

(গ) ইংল্যান্ডে জাহাজনির্মাণ

  • (১) পঞ্চদশ শতকে ইংল্যান্ডে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজনির্মাণ শুরু হয়। টিউডর বংশের রাজা সপ্তম হেনরি পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে রিজেন্ট ও সভরেন নামে দুটি জাহাজ নির্মাণ করেন। রাজা অষ্টম হেনরির আমলে ইংল্যান্ডে একটি সুদক্ষ নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। ব্যবসায়ী হকিন্স ‘রিভেঞ্জ’ নামে একটি বড়ো জাহাজ তৈরি করেন।
  • (২) তিনি দ্রুতগতিসম্পন্ন ছোটো জাহাজ এবং গভীর সমুদ্রে যাওয়ার জন্য বড়ো জাহাজ তৈরি করে নৌপ্রযুক্তিতে বড়ো ধরনের অগ্রগতি ঘটান। এই সময় গ্রেট হ্যারি নামে ১৫০০ টন ওজনের একটি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা হয়।
  • (৩) এ ছাড়াও এই সময় জাহাজে ভারী কামান বাসানোরও ব্যবস্থা করা হয়। রানি এলিজাবেথ-এর নৌবাহিনীতে ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪টি যুদ্ধজাহাজ ছিল। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে টেমস নদীর উপকূলে কয়েকটি জাহাজনির্মাণ কারখানা ও ডক প্রতিষ্ঠিত হয়।

(ঘ) অন্যান্য দেশে জাহাজ নির্মাণ

পশ্চিম ইউরোপে আধুনিক প্রযুক্তিতে ‘ক্লিঙ্কার-বিল্ট শিপ’ নামে এক ধরনের জাহাজ নির্মিত হতে থাকে। আইবেরীয়দের আবিষ্কৃত ‘ক্যারাভেল’ নামে ত্রিকোণাকৃতির হালকা পোতাশ্রয় সমুদ্রের গভীরে যাতায়াত করতে পারত। পণ্য পরিবহণের জন্য এই সময় ‘ক্যারাক’ নামে ভারী জাহাজনির্মাণের প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়। এ ছাড়া পোর্তুগাল, স্পেন, ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড, আরব, চিন প্রভৃতি দেশেও উন্নত জাহাজনির্মাণ প্রযুক্তির প্রচলন ঘটে।

জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার ফলাফল

জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল গুলি হল –

(১) ভৌগোলিক আবিষ্কার

জাহাজনির্মাণ প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পটভূমি তৈরি হয়। পোর্তুগাল, স্পেন-সহ কয়েকটি দেশের নাবিকরা দূর সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করেন। আবিষ্কার হয় আমেরিকা অর্থাৎ ‘নতুন বিশ্ব’, ব্রাজিল, প্রশান্ত মহাসাগর, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, উত্তমাশা অন্তরীপ ও আরও নতুন ভূখণ্ড।

(২) জলপথ আবিষ্কার

ভারত-সহ বিভিন্ন দেশে পৌঁছোনোর জলপথ আবিষ্কৃত হয়।

(৩) বাণিজ্য বৃদ্ধি

এই ভৌগোলিক সম্প্রসারণের ফলে একদিকে যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৪) প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস

ভৌগোলিক আবিষ্কারের সুরেই সুপ্রাচীন ইনকা, অ্যাজটেক প্রভৃতি সভ্যতাগুলি ধ্বংস হয়।

(৫) ক্রীতদাস আমদানি

তা ছাড়া আফ্রিকা-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপে ক্রীতদাস আমদানি শুরু হয় এই জাহাজের মাধ্যমেই।

অন্যান্য ক্ষেত্রে

প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি পঞ্চদশ শতক ও তার পরবর্তীকালে কৃষি, সমর, জাহাজনির্মাণ প্রভৃতি বিষয়গুলি ছাড়াও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিষয়েও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটতে শুরু করেছিল। যেমন –

(ক) ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরি

প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরি সহজ হয়। যেমন –

(১) আতস কাচ

ইংরেজ বিজ্ঞানী রজার বেকন ত্রয়োদশ শতকে আতস কাচ আবিষ্কার করেন এবং আলোকবিজ্ঞানের ওপর ‘ওপাস মাজুস’ নামে অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন।

(২) ঘড়ি

চতুর্দশ শতকে যান্ত্রিক ঘড়ির উদ্ভাবন হয় এবং ষোড়শ শতকে ইউরোপে ঘড়ির বহুল প্রচলন ঘটে।

(৩) মুদ্রণযন্ত্র

পঞ্চদশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার হলে বইপত্র প্রকাশনার জগতে বিপ্লব আসে। সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞানচর্চার জগৎ উন্মুক্ত হয়।

(৪) সংযোগকারী যান্ত্রিক প্রযুক্তি

এই যুগে বিভিন্ন সংযোগকারী যান্ত্রিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে। নানা ধাতব দণ্ডের সংযোগের দ্বারা অর্থাৎ যন্ত্রাংশের সঙ্গে যন্ত্রাংশ জুড়ে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি তৈরি হতে থাকে। প্রযুক্তিবিদরা পদচালিত যান্ত্রিক প্রযুক্তি, বেল্টের ব্যবহার প্রভৃতির উন্নতি ঘটান।

(৫) পরিবহণে প্রযুক্তি

নব উদ্ভুত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপে পরিবহণ ব্যবস্থায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সেতু তৈরি হয়। নতুন নতুন রাস্তাঘাট তৈরি হয়, লোহার প্রযুক্তি ব্যবহার করে যানবাহন নির্মাণে অগ্রগতি ঘটে।

(৬) অন্যান্য যন্ত্রপাতি

এ ছাড়া মাদক জাতীয় পানীয় উৎপাদন, রুটি প্রস্তুত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

(খ) চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি

চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক কৌশল ও প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়। যেমন –

(১) শারীর-সংস্থানবিদ্যা

অ্যানাটমি বা শারীর-সংস্থানবিদ্যা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইতালিতে শবব্যবচ্ছেদ বিজ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। ইতালির লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এবং বেলজিয়ামের আদ্রিয়া ভেসালিউস শারীরসংস্থানবিদ্যায় অগ্রগতি ঘটান। ভেসালিউসের ‘করপোরি হুমানিস’ এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

(২) রক্তসঞ্চালন

উইলিয়াম হার্ভে শরীরের রক্তসঞ্চালন পদ্ধতি আবিষ্কার করে চিকিৎসাবিদ্যায় নতুন জ্ঞানের সংযোজন করেন। ফ্রান্সের চিকিৎসক আমব্রোয়াজ পারে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ‘লিগেচার’ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

(৩) থার্মোমিটার ও অণুবীক্ষণ যন্ত্র

সাংটোরিয়ুম কর্তৃক থার্মোমিটারের আবিষ্কার এবং অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েন হুক কর্তৃক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার চিকিৎসাবিদ্যায় বিশেষ উন্নতি ঘটায়। অস্ত্রোপচার বিদ্যায় নতুন প্রযুক্তিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি হয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলাফল

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ইউরোপের বিভিন্ন বিষয়কে প্রভাবিত করেছিল। যেমন –

(১) শহরের বিকাশ

কৃষি ও অন্যান্য উৎপাদনমূলক কাজে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে কর্মক্ষেত্রে কর্মীর প্রয়োজন ক্রমে কমতে থাকে। ফলে গ্রামের বহু মানুষ শহরে এসে ভিড় জমাতে শুরু করে। এর ফলে একদিকে যেমন শহরের বিকাশ ঘটে অন্যদিকে তেমনি শহরে শিল্পের প্রয়োজনীয় সস্তা শ্রমিকের জোগান সম্ভব হয়।

(২) কায়িক পরিশ্রম হ্রাস

প্রযুক্তিগত কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে মানুষ কৃষি, খনিজ, শিল্প প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব করেছিল। প্রযুক্তির উন্নতি বিভিন্ন পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলিতে মানুষের কায়িক পরিশ্রম বহুলাংশে হ্রাস করেছিল।

(৩) আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার

পরিসংখ্যানবিদ্যা, গতিবিদ্যা প্রভৃতির তত্ত্ব পোপ ও বাইবেলের প্রচলিত চিন্তাভাবনায় আঘাত হেনেছিল। ফলে ইউরোপে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল।

উপসংহার :- বিজ্ঞান পুরোনো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষের জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছিল। এর ফলে পোপ ও চার্চের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে মানুষ ধর্মসংস্কারের পথে অগ্রসর হতে পেরেছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ইউরোপে মার্টিন লুথার-এর ধর্মসংস্কার আন্দোলন-এর পথ প্রস্তুত করেছিল।

(FAQ) প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি বিপ্লব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সর্বপ্রথম বারুদের ব্যবহার হয় কখন?

১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের যুদ্ধে।

২. স্পিনিং জেনি আবিষ্কার করেন কে?

হারগ্ৰিভস।

৩. নিরাপত্তা বাতি আবিষ্কার করেন কে?

হামফ্রে ডেভি।

৪. নতুন বিশ্ব কাকে বলা হয়?

আমেরিকা।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment