ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ মার্টিন লুথার প্রসঙ্গে তার জন্য পরিচয়, শিক্ষা ও কর্মজীবন, মার্টিন লুথার কর্তৃক রোমান চার্চের অন্যায়ের সমালোচনা, মার্কিন লুথার কর্তৃক ইনডালজেন্স বিক্রির প্রতিবাদ, মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস বা ৯৫ টি প্রশ্ন মার্টিন লুথারের জনসমর্থন, পোপের উদ্দেশ্যে লুথারের পুস্তক, লুথার কর্তৃক চার্চের বক্তব্যের প্রতিবাদ, লুথারের গ্রন্থ, পোপ কর্তৃক লুথারকে ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহারের নির্দেশ, লুথারের মৃত্যুদন্ডের আদেশ, লুথারের জনসমর্থন বৃদ্ধি, পোপ ও লুথারকে সমর্থনের প্রশ্নে বিদ্রোহ, জার্মান ভাষায় মার্টিন লুথারের বাইবেল অনুবাদ, মার্টিন লুথারের মৃত্যু ও লুথারবাদের প্রতিষ্ঠা।
জার্মান ধর্মযাজক মার্টিন লুথার প্রসঙ্গে ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মার্টিন লুথার, ধর্মতাত্ত্বিক মার্টিন লুথার, পুরোহিত মার্টিন লুথার, লেখক মার্টিন লুথার, সুরকার মার্টিন লুথার, অগাস্টিনিয়ান সন্ন্যাসী মার্টিন লুথার, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের প্রধান ব্যক্তিত্ব মার্টিন লুথার সম্পর্কে আলোচনা।
মার্টিন লুথার
ঐতিহাসিক চরিত্র | মার্টিন লুথার |
পরিচিতি | ধর্মসংস্কারক |
জন্ম | ১০ নভেম্বর ১৪৮৩ খ্রি |
দেশ | জার্মানি |
উচ্চ শিক্ষা | এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় |
৯৫ থিসিস | উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় |
গ্ৰন্থ | ব্যাবলনীয় বন্দিত্ব |
ভূমিকা :- জার্মানির ধর্মীয় নেতা মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রি.) ছিলেন এমনই বিরল একজন মানুষ যিনি ইতিহাসের বয়ে চলা গতিপথকে নিজ ইচ্ছায় পরিবর্তনে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলন-এর প্রাণপুরুষ, বিপ্লবী ও পথপ্রদর্শক।
মার্টিন লুথারের জন্ম
১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের ইসলীবেন গ্রামের এক কৃষক পরিবারে লুথার জন্মগ্রহণ করেন।
ধর্মীয় নেতা মার্টিন লুথারের শিক্ষা ও কর্মজীবন
এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর তিনি ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসী সংঘে যোগদান করেন। পরের বছর তিনি উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।
মার্টিন লুথার কর্তৃক রোমান চার্চের অন্যায়ের সমালোচনা
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রোম ভ্রমণের সময় পোপ ও কার্ডিনালদের দুর্নীতি দেখে হতাশ হন এবং জার্মানিতে ফিরে এসে রোমান চার্চের অন্যায়ের সমালোচনা শুরু করেন।
সংস্কারক মার্টিন লুথার কর্তৃক ইনডালজেন্স বিক্রির প্রতিবাদ
মার্টিন লুথার বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের সকল পরিণতি তার কর্মের দ্বারা ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব-নির্ধারিত। কেউ এর পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। রোম-এ সেন্ট পিটার গির্জা সংস্কারের কাজ শুরু হলে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আদায় করতে পোপ দশম লিও-র প্রতিনিধি টেটজেল ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে এসে ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র বিক্রি শুরু করেন। মার্টিন লুথার চার্চের এই অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
ধর্মীয় নেতা মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস বা ৯৫টি প্রশ্ন
পোপের অন্যায় কাজকর্মের বিষয়ে লুথার ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ৯৫ টি প্রশ্ন রচনা করে তা উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় ঝুলিয়ে দেন এবং পোপের উত্তর দাবি করেন। লুথারের উত্থাপিত এই ৯৫টি প্রশ্ন ‘৯৫ থিসিস’ (95 Thesis) নামে পরিচিত। লুথারের ‘৯৫ থিসিস’ -এর প্রশ্নগুলি জার্মানির সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
লুথারের জনসমর্থন
মার্টিন লুথারের ৯৫টি প্রশ্নাবলির প্রত্যুত্তরে টেটজেল ১০৬টি অ্যান্টি থিসিস বা পালটা প্রশ্ন ছাপিয়ে প্রচার শুরু করলে জার্মান ছাত্ররা তা আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়।
পোপের উদ্দেশ্যে লুথারের পুস্তিক
ইতিমধ্যে মেলাঙ্কথন নামে একজন সংস্কারক লুথারের সঙ্গে যোগ দিলে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি পায়। লুথার পোপের উদ্দেশ্যে ‘রেজোল্যুশন্স’ (Resolutions) বা ‘প্রস্তাবগুচ্ছ’ নামে এক পুস্তিকা ছাপিয়ে প্রচার করেন।
লুথার কর্তৃক চার্চের বক্তব্যের প্রতিবাদ
পোপ দশম লিও মার্টিন লুথারের কাজকর্মকে ধর্মবিরোধী বলে ঘোষণা করলে লুথার চার্চের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ‘জার্মানির খ্রিস্টান অভিজাতদের উদ্দেশ্যে আবেদন’ (An Appeal to the Christian Nobility of the German Nation) প্রকাশ করেন। তিনি প্রচার করেন যে, পোপ, যাজক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। চার্চ নিজের স্বার্থে সমাজে এই পার্থক্য বজায় রেখেছে। ধর্মকরের নামে জার্মানির অর্থ রোমে চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি প্রতিবাদ জানান।
লুথারের গ্ৰন্থ
‘ব্যাবিলনীয় বন্দিত্ব’ (Babylonian Captivity) নামে এক গ্রন্থ প্রকাশ করে তিনি বলেন যে, ইহুদি জাতি দীর্ঘকাল পর যেভাবে ব্যাবিলনীয় বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পায়, জার্মান জাতিও শীঘ্রই রোমান পোপের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পাবে। তাঁর প্রশ্নাবলি, পত্র ও পুস্তিকাগুলি জনমানসে প্রবল আলোড়ন তোলে।
পোপ কর্তৃক লুথারকে ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহারের নির্দেশ
প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লুথারের প্রতিবাদের ফলে ক্রুদ্ধ পোপ দশম চার্লস তাঁকে ‘ধর্মচ্যুত’ বলে ঘোষণা করেন। পোপের নির্দেশে সম্রাট পঞ্চম চার্লস ওয়ার্মস’ নামক স্থানে এক ধর্মসভা ডেকে লুথারকে তাঁর ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
লুথারের প্রাণদণ্ডের আদেশ
কিন্তু লুথার তার বক্তব্য প্রত্যাহারে অসম্মত হলে পোপ তাঁকে ‘ধর্ম-বহির্ভূত’ বলে ঘোষণা করে জার্মান সম্রাটকে লুথারের শাস্তির ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। পোপের নির্দেশে রাজা লুথারের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন।
লুথারের সমর্থন বৃদ্ধি
কিন্তু ইতিমধ্যে ক্যাথোলিক ধর্ম ছেড়ে বহু জার্মান সামন্ত রাজা ও সাধারণ মানুষ লুথারের অনুগামী ও সমর্থকে পরিণত হন। জার্মানির প্রাশিয়া, স্যাক্সনি, ব্রান্ডেনবার্গ, হেস, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি অঞ্চলে লুথারের মতবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
পোপ ও লুথারকে সমর্থনের প্রশ্নে বিদ্রোহ
ফলে লুথার ও পোপকে সমর্থনের প্রশ্নে জার্মানিতে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। কৃষকরা লুথারের সমর্থনে ১৫২৪-২৬ খ্রিস্টাব্দে জঙ্গি আন্দোলন শুরু করে। তারা ক্যাথোলিক চার্চের সম্পত্তি নষ্ট করে এবং বহু মানুষকে হত্যা করে। শহরের শ্রমিকশ্রেণিও কৃষকদের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগ দেয়।
বিদ্রোহ দমন
সম্পত্তি ধ্বংসের ফলে জার্মান সম্রাট ও পোপপন্থী সামন্তপ্রভুরা শীঘ্রই কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন।
জার্মান ভাষায় মার্টিন লুথারের বাইবেল অনুবাদ
লুথার জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করলে জার্মানরা পোপতন্ত্রের অনাচার সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠে।
মার্টিন লুথারের মৃত্যু
গৃহযুদ্ধ চলাকালেই ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের মৃত্যু হয়।
লুথারবাদের প্রতিষ্ঠা
শেষপর্যন্ত ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘অগাসবার্গের সন্ধি’-র দ্বারা জার্মানিতে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। সন্ধি অনুসারে ‘রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম’ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ফলে উত্তর জার্মানিতে স্যাক্সনি, প্রাশিয়া, ব্রান্ডেনবার্গ, হেস, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি অঞ্চলে লুথার প্রবর্তিত ‘লুথারবাদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার :- লুথারের অনুগামীরা ‘প্রোটেস্টান্ট’ নামে (Protestant) পরিচিতি পায়। প্রচলিত ক্যাথোলিক-ধর্ম ও পোপতন্ত্রের অনাচারের বিরুদ্ধে লুথার ‘প্রতিবাদ’ বা প্রোটেস্ট (Protest) করেছিলেন বলে তাঁর মতবাদ ‘প্রোটেস্টান্টবাদ’ (Protestantism) নামে পরিচিত হয়।
(FAQ) মার্টিন লুথার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশে।
১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পোপের প্রতিনিধি টেটজেল।
জার্মানির উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
ব্যাবিলনীয় ‘ব্যাবিলনীয় বন্দিত্ব’।