প্রাচীন ভারতের রাজপুত জাতি

প্রাচীন ভারতের রাজপুত জাতি প্রসঙ্গে ভারতে রাজপুত যুগ, রাজপুত জাতির অবদান, ভিনসেন্ট স্মিথের মন্তব্য, ভারতে রাজপুত জাতির উৎপত্তি-বিতর্ক, ভারতের বিভিন্ন রাজপুত বংশ হিসেবে চৌহান বংশ, চালুক্য বংশ, গাহড়বাল বংশ, চান্দেল্ল বংশ, পারমার বংশ ও অন্যান্য রাজপুত বংশ সম্পর্কে জানবো।

ভারতের রাজপুত জাতি প্রসঙ্গে ভারতে রাজপুত জাতির উৎপত্তি-বিতর্ক, ভারতে রাজপুত যুগ, ভারতের রাজপুত চৌহান বংশ, ভারতের রাজপুত চালুক্য বংশ, ভারতে রাজপুত চান্দেল্ল বংশ, ভারতে রাজপুত পারমার বংশ ও ভারতে রাজপুত জাতির অবদান সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন ভারতের রাজপুত জাতি

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রাচীন ভারতে রাজপুত জাতি
রাজপুত যুগ৭১২-১১৯২ খ্রি
অগ্নিকুল তত্ত্বচাঁদ বরদাই
আর্য জাতি তত্ত্বগৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা
মিশ্র জাতিভিনসেন্ট স্মিথ
পৃথ্বীরাজ চৌহানচৌহান বংশ
প্রাচীন ভারতের রাজপুত জাতি

ভূমিকা :- প্রাচীন ভারত-এ জাতি ব্যবস্থার প্রচলনের সূত্রে যে সকল জাতির উদ্ভব ঘটে সেই সব জাতি গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রাজপুত জাতি।

ভারতে রাজপুত যুগ

হর্ষবর্ধন-এর পরবর্তীকালে উত্তর ভারতে সামাজিক মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাজপুত জাতির উত্থান ভারতের ইতিহাসের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এজন্য ৭১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ভারতের ইতিহাসে ‘রাজপুত যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়।

ভারতে রাজপুত জাতির অবদান

এই সময়, বিশেষ করে আদি-মধ্য যুগে (৬৫০-১২০০ খ্রি.) উত্তর ভারতে বেশ কয়েকটি রাজপুত রাজবংশের উত্থান ঘটে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে উত্তর ভারতে মুসলিম আক্রমণ প্রতিহত করে হিন্দুধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে রাজপুত জাতির অবদান অসামান্য।

রাজপুতদের সম্পর্কে স্মিথের মন্তব্য

ড. ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, অষ্টম ও দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজপুতদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতে রাজপুত জাতির উৎপত্তি-বিতর্ক

আদি-মধ্য যুগে ভারতে জাতি হিসেবে রাজপুতদের উত্থান সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমতগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল –

(ক) বাণভট্টের মত

হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট বলেছেন যে, উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয় সন্তানরাই ‘রাজপুত’ নামে পরিচিত। তাঁর মতে, রাজপুতরা ছিলেন সূর্য বা চন্দ্রের বংশজাত।

(খ) অগ্নিকূল তত্ত্ব

  • (১) ব্রাক্ষ্মণ কবি চাঁদ বরদাই তাঁর পৃথ্বীরাজ রাসো কাব্যে বলেছেন যে, বশিষ্ঠ মুনি মাউন্ট আবু পাহাড়ে চোদ্দো দিন ধরে যজ্ঞ করে বীরের প্রার্থনা করেছিলেন। বশিষ্ঠ মুনির এই যজ্ঞের আগুন থেকেই রাজপুত জাতির উৎপত্তি হয়েছে বলে চাঁদ বরদাই উল্লেখ করেছেন।
  • (২) তাঁর লেখা থেকে জানা যায় যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ড থেকেই প্রতিহার, চৌহান, পারমার, চালুক্য, কলচুরি, শোলাঙ্কি প্রভৃতি রাজপুত বীরের জন্ম হয়েছে। রাজপুত জাতির উৎপত্তি-সংক্রান্ত এই মতবাদ ‘অগ্নিকুল তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। অবশ্য বর্তমানকালের ঐতিহাসিকরা ‘অগ্নিকুল তত্ত্ব’-কে সম্পূর্ণ অবাস্তব বলে মনে করেন।

(গ) আর্য জাতি তত্ত্ব

পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা তাঁর ‘History of Rajputana’ গ্রন্থে অভিমত দিয়েছেন যে, রাজপুতরা হল খাঁটি আর্য জাতির সন্তান। পণ্ডিত ওঝার এই অভিমত অনেক নৃতত্ত্ববিদ পরীক্ষার ভিত্তিতে সমর্থন করেন। প্রচলিত কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে পণ্ডিত ওঝা, ভি. বৈদ্য প্রমুখ রাজপুতদের সূর্য ও চন্দ্রবংশীয় বলে দাবি করেছেন। মেবারের রাজপুত রানারা নিজেদের রামচন্দ্রের বংশধর বলে দাবি করতেন।

(ঘ) বিদেশি জাতির বংশধর

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক কর্নেল টড তাঁর ‘Annals and antiquities of Rajasthan’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, শক, হুন, কুষাণ, গুর্জর প্রভৃতি বিদেশি যোদ্ধৃ জাতির মানুষ ভারতে অনুপ্রবেশ করে ক্রমে ভারতীয় জনসমাজে মিশে যায়। ভারতীয়দের সঙ্গে এই বিদেশি জাতিগুলির বৈবাহিক সূত্রে মিশ্রণের ফলে রাজপুতানার বিভিন্ন অঞ্চলে সৃষ্টি হয় দুর্ধর্ষ বীর জাতির। এরাই রাজপুত নামে পরিচিত। ড. ভাণ্ডারকর, উইলিয়াম ক্রুক প্রমুখ মনে করেন যে, বিদেশি জাতিগুলি থেকেই ভারতে রাজপুত জাতির উদ্ভব হয়েছে।

(ঙ) মিশ্র জাতি

ড. ভিনসেন্ট স্মিথ ‘রাজপুত’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করে রাজপুতানার কোনো কোনো অঞ্চলের ক্ষত্রিয় সামন্ত বা জায়গিরদারদের অবৈধ সন্তানদের রাজপুত বলে উল্লেখ করেছেন। ড. স্মিথ রাজপুতদের আর্যজাতির বংশধর বলে মনে করেন না। তাঁর মতে, রাজপুতরা সতীদাহ, জহরব্রত, সূর্য-আরাধনা প্রভৃতি আর্য রীতিনীতি গুলি পালন করত বলে অনেকে রাজপুতদের আর্য বলে ভুল করেন। তিনি রাজপুতদের একটি মিশ্র জাতি বলে উল্লেখ করেছেন।

ভারতের বিভিন্ন রাজপুত রাজবংশ

হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর (৬৪৭ খ্রি.) পরবর্তীকালে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রাজপুত রাজবংশ শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এই রাজবংশগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল। আজমীর ও দিল্লির চৌহান বংশ, গুজরাটের চালুক্য বংশ, কনৌজ-এর গাহড়বাল বংশ, বুন্দেলখণ্ডের চান্দেল্ল বংশ, মালবের পারমার বংশ, চেদীর কলচুরি বংশ প্রভৃতি।

(ক) চৌহান বংশ

দিল্লি ও আজমীরের চৌহান বংশ ছিল শক্তিশালী রাজপুত রাজবংশ। আজমীরের চৌহান শাসক চতুর্থ বিগ্রহরাজ দিল্লি, পূর্ব পাঞ্জাব, দক্ষিণ রাজপুতানা প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে সাম্রাজ্য-এর প্রসার ঘটান। এই বংশের শেষ শাসক এবং উত্তর ভারতের শেষ শক্তিশালী হিন্দু রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহান কালিঞ্জর, আনহিলবার, রোহিলখণ্ড, মনবা প্রভৃতি স্থান জয় করেন। তিনি তরাইনের প্রথম যুদ্ধ-এ জয়লাভ করলেও তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ-এ (১১৯২ খ্রি.) তুর্কি আক্রমণকারী মহম্মদ ঘুরীর কাছে পরাজিত হন।

(খ) চালুক্য বংশ

পশ্চিম ভারতের রাজপুত রাজবংশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল গুজরাটের চালুক্য বংশ। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন জয়সিংহ। চালুক্য বংশের রাজধানী ছিল আনহিলবার। চালুক্যরা আজমীরের চৌহান বংশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত হলে তাদের শক্তি হ্রাস পায়। ফলে চালুক্য রাজ্য থেকে মালব, মেবার প্রভৃতি অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ পায়।

(গ) গাহড়বাল বংশ

  • (১) কনৌজের গাহড়বাল বংশ ছিল অপর উল্লেখযোগ্য রাজপুত রাজবংশ। চন্দ্রদেব ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এলাহাবাদ, বারাণসীপাঞ্চাল অধিকার করেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা গোবিন্দচন্দ্র উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করেন।
  • (২) এই বংশের শেষ রাজা জয়চন্দ্র তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১১৯২ খ্রি.) তাঁর শত্রু আজমীরের চৌহান বংশীয় তৃতীয় পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে মহম্মদ ঘুরীকে সাহায্য করেন। ফলে পৃথ্বীরাজ পরাজিত ও নিহত হন। পরবর্তীকালে জয়চন্দ্রও ঘুরীর হাতে পরাজিত ও নিহত হন (১১৯৪ খ্রি.)।

(ঘ) চান্দেল্ল বংশ

খ্রিস্টীয় নবম শতকে যশোবর্মন বুন্দেলখণ্ডে চান্দেল্ল নামে একটি রাজপুত রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দিল্লির চৌহান বংশীয় পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করেন। পরমাদদেব ছিলেন চান্দেল্ল বংশের উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী রাজা। এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন পেরামল। এই বংশের রাজারা শিল্প-স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। চান্দেল্ল রাজাদের নির্মিত খাজুরাহোর মন্দিরগুলি আজও শিল্পরসিকদের বিস্ময় সৃষ্টি করে।

(ঙ) পারমার বংশ

খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত মালবের পারমার নামে রাজপুত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ভোজ (১০১৮-১০৮০ খ্রি.)। সুদক্ষ যোদ্ধা, সুশাসক ও সংস্কৃতির অনুরাগী ভোজ ধারার সংস্কৃত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ভোজ নামে এক হ্রদ খনন করেন।

(চ) অন্যান্য রাজপুত বংশ

এ ছাড়া, এই যুগের অন্যান্য রাজপুত রাজবংশগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জব্বলপুরের কলচুরি বংশ, কাথিয়াবাড়ের সোলাঙ্কি বংশ, গোদাবরীর তীরবর্তী চেদী বংশ প্রভৃতি।

উপসংহার :- তবে রাজপুত জাতির যথেষ্ট বীরত্ব সত্ত্বেও রাজপুত শক্তিগুলি সর্বদা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত থেকে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে তুর্কি আক্রমণকারীরা উত্তর ভারত আক্রমণ করলে রাজপুত শক্তিগুলির একে একে পতন ঘটে।

(FAQ) প্রাচীন ভারতের রাজপুত জাতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে অগ্নিকুল তত্ত্বের প্রবক্তা কে ছিলেন?

ব্রাহ্মণ কবি চাঁদ বরদাই।

২. রাজপুত জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে আর্য জাতি তত্ত্বের প্রবক্তা কে ছিলেন?

পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা।

৩. তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় কখন?

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. চৌহান বংশের শেষ শক্তিশালী রাজা কে ছিলেন?

তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহান।

Leave a Comment