পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযান প্রসঙ্গে অনুকূল পরিবেশ, প্রিন্স দ্য হেনরির ভূমিকা, ক্যাওর-এর ভূমিকা, পাইভার ভূমিকা , বার্থেলোমিউ দিয়াজের ভূমিকা, ভাস্কো-দা-গামার ভূমিকা, আলবুকার্কের ভূমিকা, কেব্রালের ভূমিকা ও সমুদ্রে পোর্তুগালের একাধিপত্য হ্রাস সম্পর্কে জানবো।
ইউরোপ মহাদেশের পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযান প্রসঙ্গে পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানে প্রিন্স দ্য হেনরির ভূমিকা, পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানে বার্থেলোমিউ দিয়াজের ভূমিকা, পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানে ভাস্কো-দা-গামার ভূমিকা ও পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানে আলবুকার্কের ভূমিকা সম্পর্কে জানব।
পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযান
ঐতিহাসিক ঘটনা | পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযান |
কেউটা দখল | ১৪১৫ খ্রি |
সাগ্ৰেস | প্রিন্স হেনরি |
ঝড়ের অন্তরীপ | বার্থেলোমিউ দিয়াজ |
উত্তমাশা অন্তরীপ | দ্বিতীয় জন |
ভারত-এ পদার্পণ | ভাস্কো ডা গামা |
ব্রাজিল আবিষ্কার | কেব্রাল |
ভূমিকা :- ইউরোপীয় দেশগুলির ভৌগোলিক অভিযান প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ জে. এইচ. প্যারি পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালকে ‘প্রাথমিক নিরীক্ষণ’-এর যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই সময়ের মধ্যে পোর্তুগাল, স্পেন, নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নিয়ে বিভিন্ন নতুন ভূখণ্ড ও নতুন জলপথ আবিষ্কার করে। এদের মধ্যে অগ্ৰণী ছিল পোর্তুগাল।
পোর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযান
পর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযানের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(ক) অনুকূল পরিবেশ
ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগে সর্বপ্রথম পোর্তুগাল সামুদ্রিক অভিযান-এ উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল। কয়েকটি অনুকূল পরিস্থিতি পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযানে সহায়ক হয়েছিল। যেমন –
(১) শান্তি ও সুস্থিতি
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে পোর্তুগালে যে রাজনৈতিক শান্তি ও সুস্থিতি বিরাজ করছিল তা পোর্তুগালকে সামুদ্রিক অভিযানে মনোনিবেশ করার সুযোগ দিয়েছিল।
(২) নৌ-প্রযুক্তিতে দক্ষতা
আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় নৌ- প্রযুক্তিতে পোর্তুগাল যথেষ্ট দক্ষ ছিল।
(৩) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেষ্টা
সামুদ্রিক অভিযানের মাধ্যমে বিদেশের সোনা ও সম্পদ হস্তগত করে পোর্তুগাল নিজের দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাতে চেয়েছিল।
(৪) প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা
পোর্তুগালের নাবিকরা মূলত পূর্বদিকে সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নেওয়ায় তাদের বিশেষ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয় নি।
(৫) ইসলামের প্রসার রোধের চেষ্টা
পোর্তুগিজ নাবিক রাজকুমার হেনরির আফ্রিকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানোর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেখানে ইসলামের প্রসার রোধ করা।
(খ) কেউটা দখল
পোর্তুগিজ নাবিকরা চতুর্দশ শতকের মধ্যেই দাবি করেছিল যে, তারা ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু পরে এই স্থান নিয়ে স্পেনের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাধে। পোর্তুগিজ নাবিকরা ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার কেউটা (Ceuta) দখলের মাধ্যমে ভৌগোলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সূত্রপাত ঘটায়। কেউটা জয়ে পোর্তুগিজদের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার উপকূলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
(গ) প্রিন্স হেনরির ভূমিকা
হেনরি দ্য নেভিগেটর (Henry the Navigator) নামে পরিচিত পোর্তুগিজ নাবিক প্রিন্স হেনরি বা রাজকুমার হেনরি (প্রকৃত নাম ইনফ্যান্টি হেনরি (১৩৯৪-১৯৬০ খ্রি.) ভৌগোলিক অভিযানে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। যেমন –
(১) আফ্রিকার উপকূলে অভিযান
তিনি আফ্রিকার উপকূল অঞ্চল ও দক্ষিণ সমুদ্রের বিস্তীর্ণ এলাকায় অভিযান চালান এবং প্রাচ্যে আসার জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। তিনি অ্যাজোর্স, গিনি, মাদেইরা ও অন্যান্য কয়েকটি স্থান আবিষ্কার করেন।
(২) বোজাদোর অন্তরীপে পদার্পণ
হেনরি ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে অভিযান শুরু করে দুর্গম বোজাদোর অন্তরীপে (Cape Bojador) পৌঁছে যান। তাঁর নির্দেশিত পথ ধরে পোর্তুগিজ জাহাজ আফ্রিকার সেনেগাল নদী এবং আরও পরবর্তীকালে ঘানার নিকটবর্তী অঞ্চলে পৌঁছে যায়। নাবিক হেনরি সমুদ্রপথের একটি মানচিত্র তৈরি করেন এবং ‘সাগ্রেস’ নামে একটি নৌ-বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
(ঘ) ক্যাওর-এর ভূমিকা
নাবিক দিয়োগো ক্যাওর ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার কঙ্গো আবিষ্কার করেন এবং ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান নামিবিয়া পর্যন্ত অভিযান করেন।
(ঙ) পাইভার ভূমিকা
আলফানসো ডি পাইভা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইথিওপিয়ায় পৌঁছোন। এর ফলে সমুদ্রপথে ভারতে আসার জলপথের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁদের যাত্রাপথ পরবর্তীকালের নাবিকদের অভিযানে সুবিধা করে দেয়।
(চ) বার্থেলোমিউ দিয়াজের ভূমিকা
প্রিন্স হেনরির নৌ- বিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভ করে যে নাবিক সর্বপ্রথম সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছিলেন তিনি হলেন বার্থোলোমিউ দিয়াজ (১৪৫০-১৫০০ খ্রি.)। –
(১) উত্তমাশা অন্তরীপ
তিনি ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণতম প্রান্তে পৌঁছোন। তিনি এই অঞ্চলের নাম দেন ‘ঝড়ের অন্তরীপ’ (Cape of Storm)। পরে পোর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন আশা করলেন যে, এই ঝড়ের অন্তরীপের পথ ধরেই ভারতে পৌঁছোনো যাবে। তাই তিনি ঝড়ের অন্তরীপের নতুন নামকরণ করেন ‘উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope)।
(২) ভারত মহাসাগর
দিয়াজের জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরে এসে পৌঁছোয়। তিনি ভারত মহাসাগরের পথে এশিয়ায় পৌঁছোনোর আভাস দেন এবং ব্রাজিল অভিযানেও অংশ নেন।
(ছ) ভাস্কো-দা-গামার ভূমিকা
তার অভিযানের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) অভিযান
নাবিক ভাস্কো-দা-গামা (১৪৬৯-১৫২৪ খ্রি.) পোর্তুগালের রাজা এমানুয়েল দ্য ফরচুনেটার সহায়তায় সামুদ্রিক অভিযানে বের হন। তিনি ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে চারটি ছোটো ছোটো জাহাজ নিয়ে পোর্তুগালের রাজধানী লিবসন থেকে যাত্রা শুরু করেন।
(২) ভারতে পদার্পণ
তিনি উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে আরবের নাবিক আহমেদ ইবন মাহির -এর সহায়তায় ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন। তিনি ওই বছর ১৭ মে ভারতের কালিকট বন্দরে পদার্পণ করেন। তিনি এরপরও কয়েকবার ভারতে এসে এখান থেকে প্রচুর মশলাপাতি ইউরোপ-এ নিয়ে যান।
(জ) আলবুকার্কের ভূমিকা
- (১) পোর্তুগিজ নাবিক আলফানসো ডি আলবুকার্ক (১৪৫৩-১৫১৫ খ্রি.) প্রথমে আরবের বিভিন্ন স্থানে এবং অটোমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে কয়েকটি নৌ-অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে ইথিওপিয়ার নিকটবর্তী হরমুজ বন্দর দখল করেন এবং আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গোয়ায় পৌঁছোন।
- (২) তিনি ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে ভারত মহাসাগরের নিকটবর্তী মালাক্কা দখল করেন এবং ভারতের কয়েকটি স্থানে পোর্তুগিজ উপনিবেশ স্থাপন করেন। তিনি ভারতে পোর্তুগিজ গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারতে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখতেন।
- (৩) তিনি চিন-এর ম্যাকাও বন্দরে পোর্তুগিজদের বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। আলবুকার্ক The Terrible, The Great, The Caesar of the East, Lion of the Seas প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত হন।
(ঝ) কেব্রাল-এর ভূমিকা
পোর্তুগিজ নাবিক পেড্রো আলভারেজ কেব্রাল (১৪৬৭-১৫২০ খ্রি.) দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে অভিযান চালান এবং এই অঞ্চলে পোর্তুগালের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
(১) ব্রাজিল আবিষ্কার
তিনি ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ব্রাজিল (পোর্ট সেগুরো) আবিষ্কার করেন।
(২) ভারতে আগমন
তিনি সামুদ্রিক ঝড় উপেক্ষা করে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ঝড়ে তাঁর ১৩টি জাহাজের মধ্যে বেশ কয়েকটি ধ্বংস হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত তিনি ভারতের কোচিনে এসে পৌঁছোন এবং এখানে তিনি পোর্তুগিজদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন। তিনি ভারত থেকে প্রচুর মশলা নিয়ে পোর্তুগালে পৌঁছোন।
(ঞ) সমুদ্রে একাধিপত্য হ্রাস
পরবর্তীকালে স্পেন, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নিলে পোর্তুগালের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। ফলে সমুদ্রে পোর্তুগালের একাধিপত্য হ্রাস পায়। এরপর সেদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে তাদের সামুদ্রিক অভিযান দারুণভাবে ব্যাহত হয়।
উপসংহার :- সফল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি, বিশেষ করে নাবিক রাজকুমার হেনরি দিয়োগো ক্যাওর, বার্থেলোমিউ দিয়াজ, ভাস্কো- দা-গামা, আলবুকার্ক, কেব্রাল ও অন্যান্য নাবিকরা পোর্তুগালের বিভিন্ন ভৌগোলিক অভিযানে সাফল্য এনে দিয়েছিল।
(FAQ) পোর্তুগালের সামুদ্রিক অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে।
প্রিন্স হেনরি বা রাজকুমার হেনরি।
পর্তুগিজ নাবিক বার্থেলোমিউ দিয়াজ।
পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন।
পেড্রো আলভারেজ ক্যাব্রাল ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে।
১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে।