মুঘল সম্রাট আকবর -এর জন্ম, শৈশব, সিংহাসনে আরোহণ, পারিবারিক জীবন, সাম্রাজ্যের বিস্তার, পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ, হলদিঘাটের যুদ্ধ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি, রাজপুত নীতি, ধর্মনীতি, দাক্ষিণাত্য নীতি, সমন্বয় নীতি, মনসবদারি প্রথা সম্পর্কে জানবো।
মুঘল সম্রাট আকবরের জন্ম, শৈশব, বিবাহ, পারিবারিক জীবন, অভিষেক অনুষ্ঠান, সমস্যা, সাম্রাজ্য বিস্তার, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি, দাক্ষিণাত্য নীতি, রাজপুত নীতি, সমন্বয় নীতি, শাসন ব্যবস্থা, ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর
ঐতিহাসিক চরিত্র | আকবর |
জন্ম | ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ |
পিতামাতা | হুমায়ুন ও হামিদা বানু বেগম |
মৃত্যু | ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ |
পরিচিতি | সর্বশ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট |
রাজত্বকাল | ১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ |
পূর্বসূরি | হুমায়ুন |
উত্তরসূরি | জাহাঙ্গীর |
ভূমিকা :- ভারতবর্ষ -এর সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে জালাল উদ্দিন মহম্মদ আকবর অন্যতম একজন। পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম মহামতি আকবর নামেও পরিচিত। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট।
মুঘল সম্রাট আকবরের জন্ম
সিন্ধুপ্রদেশের অন্তর্গত অমরকোটের রাজপুত রাজা বীরশালের গৃহে হুমায়ুন পত্নী হামিদা বানু বেগমের গর্ভে ১৫ অক্টোবর, ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের জন্ম হয়। হুমায়ুন যখন পারস্যে চলে যান তখন আকবরের বয়স মাত্র ১ বছর।
মুঘল সম্রাট আকবরের শৈশব
শিশু আকবর কাকা আসকরির কাছে (কামরান-এর কাছে) লালিত পালিত হন। আকবরের ধাত্রী মাতা ছিলেন মহম অনাঘা। ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন পারস্যের সাহায্যে কাবুল ও কান্দাহার দখল করে নেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের বিবাহ
হিন্দলের কন্যা রাকিয়া বেগমের সাথে আকবরের বিবাহ হয়।
মুঘল সম্রাট আকবরের পারিবারিক জীবন
রাজপুতদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার স্বার্থে আকবর বিভিন্ন রাজবংশের রাজকন্যাদের বিয়ে করেন। তবে তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচাইতে আলোচিত হলেন যোধা বাঈ।
গজনির শাসনকর্তা আকবর
১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুনের অপর ভ্রাতা হিন্দল-এর মৃত্যু হলে আকবরকে গজনির শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আকবর
১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে আকবরকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
দিল্লির বাদশাহ আকবর
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি হুমায়ুনের মৃত্যু হলে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বৈরাম খান ১৩ বছর ৪ মাস বয়সে নাবালক বালক আকবরকে পাঞ্জাবে দিল্লির বাদশা বলে ঘোষণা করেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের অভিষেক অনুষ্ঠান
কালানৌরে সমবেত মুঘল অভিজাতবর্গ আকবরের সিংহাসনে অভিষেকের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
আকবরের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি
নাবালক উত্তরাধিকারী সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী এই ধারা বাবর সূত্রপাত করেন। আকবরের সিংহাসন আরোহণ কালে মুঘলল সাম্রাজ্য দিল্লি, আগ্রা ও পাঞ্জাব অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল।
মুঘল সম্রাট আকবরের সামনে সমস্যা
- (১) হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুতে শূরবংশীয় আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু দিল্লির দিকে অগ্রসর হন এবং দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে নিজেকে স্বাধীন নরপতিরূপে ঘোষণা করে ‘রাজা বিক্রমাদিত্য’ উপাধি ধারণ করেন।
- (২) সুলেমান মির্জা কাবুল অধিকার করেন। আফগান সর্দার সিকান্দর শূর শিবালিক পর্বতমালা থেকে পাঞ্জাব আক্রমণের উদ্যোগ নেন।
- (৩) তাদিবেগ-এর কাছে সংবাদ পেয়ে আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান পীর মহম্মদ শেরওয়ানিকে সেনাসহ তাদিবেগকে সাহায্যের জন্য দিল্লির দিকে পাঠিয়ে দেন। হিম তুঘলকাবাদের যুদ্ধে তাদিবেগকে পরাস্ত করে দিল্লি অধিকার করেন।
- (৪) কর্তব্যে গাফিলতির জন্য বৈরাম খান তাদিবেগকে হত্যা করেন এবং আবুল মুয়ালিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ
ইতিমধ্যে বৈরাম খান ও আকবর হিমুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রান্তরে মুঘল বাহিনী ও হিমুর মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফল
এই যুদ্ধে আকবরের সেনাপতি ছিলেন আলিকুলি খান। হিমুর একটি চোখ তীরবিদ্ধ হয় এবং বৈরাম খাঁ নিজ হাতে হিমুর মাথা কেটে ফেলেন। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি পুনরায় দৃঢ় হয়।
আদিল শাহের হত্যা
হিমুর প্রভু মহম্মদ আদিল শাহকে হত্যা করেন বাংলার সুলতান খিজির খান।
সিকান্দর শূরের পরাজয়
সিকান্দর শুরু শিবালিক পার্বত্য থেকে পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। বৈরাম খান তার বিরুদ্ধে অভিযান পাঠালে মানকোট দুর্গে ৬ মাস আত্মরক্ষার পর সিকান্দর শূর আত্মসমর্পণ করেন।
সুলেমান মির্জার পলায়ন
মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের আক্রমণে সুলেমান মির্জা কাবুল ছেড়ে চলে যান।
জৌনপুর ও গোয়ালিয়র দুর্গ দখল
জৌনপুর-এর আফগান শাসক ইব্রাহিম শূর পরাজিত হন। ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাহিনী গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ করে।
আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান
- (১) বৈরাম খান ছিলেন পারস্যের বাদাকশান নিবাসী এবং শিয়া ধর্মাবলম্বী। তিনি হুমায়ুনের অধীনে চাকুরি নেন। হুমায়ুন আকবরের অভিভাবক হিসাবে বৈরাম খানকে নিয়োগ করেন।
- (২) বৈরাম খান ‘খান-ই-খানান’ উপাধি নেন। তিনি ভকিল উজিরের পদমর্যাদা গ্রহণ করেন।
- (৩) সিংহাসন আরোহণের পর আকবর প্রথম চার বছর (১৫৫৬-১৫৬০ খ্রিঃ) বৈরাম খানের প্রভাবাধীন ছিলেন। বৈরাম খানের ঔদ্ধত্য আকবরের অসহ্য লাগে।
- (৪) বৈরাম খান মক্কা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে সাম্রাজ্যের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকবর পীর মহম্মদকে নিয়োগ করেন। তবে অপমানিত হয়ে বৈরাম খাঁ বিদ্রোহ করেন সম্রাট আকবর তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করে মক্কা যাত্রার অনুমতি দেন।
- (৫) গুজরাতের পাটনে জনৈক আফগান পূর্ব শত্রুতাবশত বৈরাম খানকে ৩১ জানুয়ারি ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৫৬০) হত্যা করে।
- (৬) বৈরাম খানের পুত্র আবদুর রহিমকে আকবর পুত্রস্নেহে পালন করেন এবং পরে তাকে উচ্চ সামরিক পদে নিয়োগ করে ‘খান-ই-খানান’ উপাধিতে সম্মানিত করেন।
- (৭) ঐতিহাসিক উলসি হেগ মন্তব্য করেছেন আকবর তাঁর সিংহাসনের জন্য বৈরাম খানের কাছে ঋণী। স্মিথ বলেছেন আকবর বৈরামের প্রতি ন্যায্য ব্যবহার করেননি।
আকবরের আমলে অন্তঃপুরিকার শাসন (১৫৬০-৬৪)
বৈরাম খানের মৃত্যুর পর (১৫৬০ খ্রিঃ) দরবারের অধিকাংশ কাজ মহম অনাঘা ও তাঁর পুত্র আদম খানের নির্দেশে পরিচালিত হয়। এজন্য ভিনসেন্ট স্মিথ ১৫৬০-৬৪ খ্রিস্টাব্দের শাসনকালে “Petticoat Government” বা অন্তঃপুরিকার শাসনকাল বলে অভিহিত করেছেন।
আকবরের সময়ে অন্ত:পুর চক্র
অন্তঃপুরের যে চক্রটি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল তাতে ছিলেন আকবরের ধাত্রীমাতা মহম অনাঘা, তাঁর পুত্র আদম খান, রাজমাতা হামিদা বানু, মুনিম খান এবং দরবারের প্রভাবশালী অভিজাতরা। বৈরাম খান ছিলেন মহম অনাঘা ও তাঁর পুত্র আদম খানের প্রধান শত্রু। ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর নিজ হাতে শাসনভার তুলে নেন।
আকবরের আমলে ভকিল পদ
বৈরাম খানের মৃত্যুর পর ভকিল পদ নিয়ে রেষারেষি শুরু হয়।
- (১) প্রথম দাবিদার ছিলেন আকবরের ধাত্রীমাতা মহম অনাঘার পুত্র আদম খান, দ্বিতীয় দাবিদার ছিলেন শামসউদ্দিন আতকা খান।
- (২) আকবর শেষপর্যন্ত মুনিম খানকে ভকিল পদে বহাল করেন। মুনিম খানের পদচ্যুতির পর শামসউদ্দিন আতকা খান ভকিল পদে নিযুক্ত হন।
- (৩) ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আদম খান শামসউদ্দিন আতকা খানকে প্রকাশ্যে হত্যা করলে আকবরের নির্দেশে আদম খানকেও হত্যা করা হয়। মুনিম খান পুনরায় ভকিল পদে বহাল হন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার
১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বৈরাম খানের পতনের পর আকবর তাঁর রাজ্য বিস্তার নীতির সূচনা করেন।
(ক) আকবরের মালব অভিযান
- (১) ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে আদম খান ও পীর মহম্মদের নেতৃত্বে মুঘলরা মালবের সুলতান বাজবাহাদুরকে পরাস্ত করে মালব অধিকার করে। বাজবাহাদুর ছিলেন কাব্য ও সঙ্গীত প্রিয়।
- (২) আকবর পীর মহম্মদকে মালবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পীর মহম্মদের দুর্বলতার সুযোগে বাজবাহাদুর মালব পুনরুদ্ধার করেন।
- (৩) শেষপর্যন্ত আকবরের সেনাপতি আবদুল্লা খান উজবেগ বাজবাহাদুরকে পরাস্ত করে ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে মালব অধিকার করে প্রত্যক্ষ মুঘল শাসন স্থাপন করেন।
(খ) আকবরের গন্ডোয়ানা অভিযান
- (১) এলাহাবাদে আকবরের সেনাপতি আসফ খান ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের গড় কাটাঙ্গা আক্রমণ করে।
- (২) এই রাজ্যের রাজা দলপৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র বীরনারায়ণের অভিভাবিকা রূপে মাতারানি দুর্গাবতী গড়-কাটাঙ্গা শাসন করেন।
- (৩) যুদ্ধে বীরনারায়ণ ও মহারাণী দুর্গাবতী প্রাণ দেন এবং রাজপুত রমণীগণ আত্মরক্ষার্থে ‘জহরব্রত’ পালন করেন।
- (৪) আকবর শেষপর্যন্ত গড়-কাটাঙ্গার শাসনভার দলপৎ শাহের বংশের চন্দ্র শাহকে দেন। চন্দ্র শাহ মুঘলদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করেন।
(গ) খান-ই-জামালের বিদ্রোহ দমনে আকবরের ভূমিকা
আদিল শাহের পুত্রের নেতৃত্বে বিহারে আফগান শক্তি বিদ্রোহ করেন। জৌনপুরের মুঘল শাসনকর্তা খান-ই-জামান এই বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু নিজে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেন। আকবর ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে চুনার দুর্গ দখল করেন এবং খান-ই-জামাল বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়।
(ঘ) আকবরের অম্বর অভিযান
- (১) আকবর ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে সুফি সন্ত মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে আজমির যাত্রার সময় অম্বর বা জয়পুরের রাজা বিহারীমল বা ভারামলের বশ্যতা লাভ করেন।
- (২) আকবর ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে বিহারীলালের কন্যা মানবাঈকে বিবাহ করেন। বিহারীমলের পুত্র ভগবান দাস ও পৌত্র মানসিংহকে মনসবদার রূপে দরবারে নিয়োগ করা হয়।
- (৩) আকবর বিহারীমলের কন্যাকে বিবাহ করে রাজপুত মৈত্রীর প্রথম ধাপ তৈরি করেন। আকবর বিকানিরের রাজকন্যাকে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিবাহ করেন। আকবর ভগবান দাসের কন্যার সাথে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র জাহাঙ্গিরের ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বিবাহ দেন।
(ঙ) গক্করদের দমনে আকবরের ভূমিকা
আকবর গক্করদের অধিপতি সুলতান আদমকে হিতালের যুদ্ধে পরাজিত করেন। কামাল খান আকবরের প্রতি বশ্যতা জানিয়ে গক্কর অঞ্চলে আধিপত্য পান।
(চ) উজবেগী দমনে আকবরের ভূমিকা
আকবর সীতাপুরের যুদ্ধে ইস্কান্দার মির্জা খানকে পরাস্ত করায় উজবেগী খানেরা বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় উজবেগীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফতেপুর পাশোকীয় যুদ্ধে আকবর উজবেগী বিদ্রোহ সম্পূর্ণ দমন করেন। মুনিম খানকে উজবেগী জাগির শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
(ছ) আকবরের গুজরাট অভিযান
- (১) হস্তশিল্প ও কৃষি উৎপাদনের দিক থেকে গুজরাট ছিল সমৃদ্ধ। গুজরাটের শাসক ছিলেন তৃতীয় মুজাফ্ফর শাহ। তৃতীয় মুজাফ্ফরের মন্ত্রী বা উজির ইতিমাদ খান আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন।
- (২) আকবরের বিদ্রোহী ‘মির্জা’ উপাধিধারী অভিজাতরা গুজরাটে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে আকবর গুজরাট অভিযান করেন।
- (৩) আকবরের নেতৃত্বে মুঘলবাহিনী ১১ দিন ৪৫০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আমেদাবাদ অধিকার করে। আকবর ক্যাম্বে বন্দরে এলে পর্তুগিজরা তাঁর প্রতি বশ্যতা জানায়।
- (৪) ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে আকবর সুরাট জয় করে গুজরাটকে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত করেন। আকবর সবরমতী নদীর তীরে এসে হাজির হন এবং সেখানে তাঁর নামে খুৎবা পাঠ করা হয়।
- (৫) এরপর আকবর ফতেপুর সিক্রিতে ফিরে আসার পর গুজরাটে পুনরায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। আকবর ফতেপুর সিক্রি থেকে তিন হাজার মুঘলবাহিনী নিয়ে আমেদাবাদে চলে আসেন এবং গুজরাট স্থায়ীভাবে মুঘল সুবায় পরিণত হয়।
- (৬) গুজরাট দখলের মাধ্যমে আকবর সর্বপ্রথম পোর্তুগিজদের সংস্পর্শে আসেন। সমুদ্র উপকূলের সাথে সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় মুঘলরা নৌবাহিনী গড়ে তোলার সুযোগ পায় এবং গুজরাটের মধ্য দিয়ে দাক্ষিণাত্যের দরজা মুঘলদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
- (৭) টোডরমল গুজরাটে তাঁর রাজস্ব সংস্কারের প্রথম পরীক্ষা চালান। আরব সাগরের বুকে আকবর নৌকাবিহার করেন।
(জ) আকবরের বাংলা অভিযান
- (১) শূর বংশের পতনের পর সুলেমান কররানী (১৫৬৪) বাংলায় আধিপত্য স্থাপন করেন। সুলেমান কররানীর মৃত্যুর পর তার পুত্র দাউদ কররানী বা দাউদ খান মুঘলদের অধীনতা অস্বীকার করেন।
- (২) আকবর প্রথমে দাউদের বিরুদ্ধে সেনাপতি মুনিম খানকে পাঠান। আকবর পাটনার নিকট হাজিপুর দুর্গ অধিকার করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুনিম খান ও টোডরমল তুকরাই বা তুর্কার যুদ্ধে দাউদকে পরাস্ত করেন। তাঁর ধর্মান্তরিত সেনাপতি ‘কালাপাহাড়’ যুদ্ধে আহত হন। টোডরমল দাউদকে বন্দি করে মুঘল শিবিরে নিহত করেন।
- (৩) দাউদের পতনের পর বাংলায় স্বাধীন সুলতানি বংশের অবসান ঘটে এবং বাংলার ইতিহাসে আফগানযুগ শেষ হয়।
- (৫) বাংলার কেন্দ্রীয় শাসন মুঘলদের হাতে আসে কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে বহু সময় লাগে। বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ঈশা খান।
- (৬) ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর রাজা মানসিংহকে বাংলায় পাঠান। মানসিংহের চেষ্টায় বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় মানসিংহ অসুস্থ আকবরকে দেখতে আগ্রা যাত্রা করেন।
- (৭) পূর্ববঙ্গকে মুঘলরা বলত ‘ভাটি’। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে র্যালফ (Ralph) ফিচ নামে জনৈক ইংরেজ বণিক ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য শুরু করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে পূর্ববঙ্গে ভ্রমণ করেছিলেন।
(ঝ) আকবরের মেবার (চিতোর) অভিযান
মেবার -এর শিশোদিয়া রানাদের স্বাধীনতা স্পৃহা ও আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল।
- (১) মেবারের রানা উদয়সিংহ আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। আকবর ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে চিতোর দুর্গ অবরোধ করেন।
- (২) রানা উদয় সিংহ জয়মল ও পুত্ত নামে দুই সেনাপতির হাতে চিতোরের দায়িত্ব দিয়ে নিজে আরাবল্লি পর্বতে আশ্রয় নেন।
- (৩) আকবর মাটির ভেতর গর্ত করে তাতে বারুদ দিয়ে আগুনের সাহায্যে দুর্গ প্রাচীরের একাংশ ভেঙে ফেলেন। দুর্গের অন্যতম সেনাপতি জয়মল গুলিতে নিহত হন। বীর রাজপুতরা মাথায় জাফরানি পাগড়ি বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকবরের নির্দেশে ৩০ হাজার দুর্গবাসীকে হত্যা করা হয়।
- (৪) ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে চিতোর দুর্গের পতন ঘটে। আকবর সেনাপতি আসফ খানকে মেবারের শাসনভার অর্পণ করে আগ্রা ফিরে আসেন।
- (৫) মেবারের পরাজয়ের পর রাজপুতনার অবশিষ্ট রাজ্যগুলি মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে রণথম্বোরের হারা বংশীয় শাসক সুজন সিংহ (সারজনহারা) বশ্যতা জানান। সুজন সিংহকে বারাণসী ও চুনারের শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করা হয়।
- (৬) ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে কালিঞ্জর শাসক রামচন্দ্র বশ্যতা স্বীকার করেন। তাঁকে এলাহাবাদের কাছে জায়গির দেওয়া হয়। কালিঞ্জরের শাসনভার দেওয়া হয় মুঘল সেনাপতি মাজন খানের হাতে। মারবাড়ের অধিপতি চন্দ্রসেনও ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বশ্যতা স্বীকার করেন।
রানা প্রতাপ সিংহ
মেবারের রানা উদয়সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রানা প্রতাপ সিংহ মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেন নি। আকবর রানা প্রতাপ সিংহের বিরুদ্ধে সেনাপতি আসফ খান ও মানসিংহকে প্রেরণ করেন।
আকবর ও রাণা প্রতাপ সিংহের মধ্যে হলদিঘাটের যুদ্ধ
১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ জুন হলদিঘাটের যুদ্ধ -এ মুঘল বাহিনীর সাথে রানা প্রতাপ সিংহ -এর তুমুল যুদ্ধ হয়। রানা প্রতাপ পরাজিত হন।
রাণা প্রতাপ সিংহের মেবার পুনরুদ্ধার
মৃত্যুর পূর্বে রানা প্রতাপ চিতোর ও আজমির ছাড়া প্রায় সমগ্র মেবার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রানাপ্রতাপের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অমর সিংহের সময় আকবর মেবার জয়ের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাংলা অভিযানে ব্যস্ত থাকায় সম্রাটের পক্ষে মেবার জয় সম্ভব হয়নি।
সম্রাট আকবরের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি
- (১) কাবুল নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে কান্দাহার ও হিরার্টের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন প্রয়োজন ছিল। কান্দাহারের উপর দিয়েই পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে আসার পথ গেছে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সাথে স্থল বাণিজ্য এই পথেই হয়।
- (২) উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতিদের দমন করতে হলে কাবুল, কান্দাহার ও হিরাটে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের বৈমাত্রেয় ভাই মির্জা মহম্মদ হাকিমের মৃত্যু হলে কাবুল মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
- (৩) আকবরের ঘনিষ্ঠ বিদূষক বীরবল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এক অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় মারা যান।
- (৪) ১৫৮৬-১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে আকবর প্রথম কাশ্মীর পরিদর্শন করেন।
- (৫) ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর কান্দাহার দখল করেন। মুঘল সম্রাট আকবর ও উজবেগ প্রধান আবদুল্লার একটা অলিখিত বোঝাপড়া হয়েছিল যে, হিন্দুকুশ পর্বত উভয় সাম্রাজ্যের সীমানা হিসাবে পরস্পর মেনে নেবে।
- (৬) ইসমাইল খান ও রাজসিংহকে বিদ্রোহী বালুচ উপজাতিকে দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জৈন খান কোকার ওপর সোয়াট ও বাজাউর অঞ্চলের ইউসুফজাই ও মান্দার উপজাতিকে দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- (৭) ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর ভাকার দুর্গ অধিকার করেন। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে আকবরের নির্দেশে মুলতানের মুঘল শাসনকর্তা আব্দুর রহমান আট্রা (নিম্ন সিন্ধু) দখল করার জন্য অগ্রসর হন।
- (৮) ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের নির্দেশে মীর মাসুম বেলুচিস্তানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। মুঘল বাহিনী বেলুচিস্তানের সিরি দুর্গটি আক্রমণ করে আফগানদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।
মুঘল সম্রাট আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি
- (১) ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে আহমেদনগরের সুলতান বুরহান-উল-মুলক -এর মৃত্যু হলে তার ভগ্নী ও বিজাপুরের বিধবা মহিষী চাঁদ বিধি ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর-এর সমর্থনে আহম্মদনগরে উপস্থিত হন।
- (২) আকবর যুবরাজ মুরাদ ও আবদুর রহিম খান-ই-খানানের নেতৃত্বে একটি মুঘলবাহিনী আহম্মদনগরে এসে উপস্থিত হয়। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘলবাহিনী আহম্মদনগর দুর্গ অবরোধ করে।
- (৩) ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের মধ্যে সন্ধি হয়। বাহাদুর শাহকে আহম্মদনগরের সুলতান হিসাবে মুঘল পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চাঁদবিবি ও বাহাদুর শাহ মুঘলদের প্রতি বশ্যতা জানান এবং বেরার প্রদেশ মুঘলকে ছেড়ে দেন।
- (৪) আহম্মদনগরের এক শ্রেণীর অভিজাত এই সন্ধির ঘোর বিরোধিতা করে। বিজাপুর, গোলকুন্ডা ও আহমেদনগরের সম্মিলিত বাহিনী বেরার আক্রমণ করলে ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে গোদাবরীর তীরে সুপার যুদ্ধে মোগল সেনার কাছে তারা পরাজিত হয়। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মুঘলরা আহম্মদনগর অধিকার করে।
- (৫) আবুল ফজল -এর ভ্রাতা সভাকবি ফৈজী দূত হিসাবে খান্দেশ যান। সেখানকার নৃপতি রাজা আলি খান মুঘল আনুগত্য মেনে নেন। দক্ষিণের খান্দেশ রাজ্যের প্রতি আকবর-এর সর্বপ্রথম দৃষ্টি ছিল। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘলরা খান্দেশের রাজধানী বুরহানপুর দখল করে।
- (৬) দক্ষিণের অন্যতম দুর্গ আসিরগড় অবরোধ করেন আকবর নিজেই ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে। আসিরগড় দুর্গ রক্ষায় পোর্তুগিজরা মীরন বাহাদুর শাহকে সাহায্য করে। আকবর ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে আসিরগড় দুর্গ দখল করেন। এটিই ছিল আকবরের শেষ সামরিক অভিযান।
- (৭) আকবর দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে নিয়ে আহম্মদনগর, বেরার ও খান্দেশ এই তিনটি সুবা গঠন করেন এবং পুত্র দানিয়েলকে তার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে ফিরে আসেন।
সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি
- (১) আফগানরা ছিল মুঘলদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। পারস্যের শাহ তহমাস্প হুমায়ুনকে বলেছিলেন রাজপুত-আফগান মৈত্রী ভেঙে রাজপুত শক্তিকে মোগলের পক্ষে না আনলে ভারতে মুঘলের ভবিষ্যত নেই।
- (২) হুমায়ুন মৃত্যুর আগে আকবরকে রাজপুত মৈত্রী গঠনের পরামর্শ দেন। আকবর সেই পরামর্শ গ্রহণ করেন।
- (৩) অধ্যাপক সতীশচন্দ্র আকবরের রাজপুত নীতির তিনটি স্তর লক্ষ করেছেন। প্রথমপর্ব ১৫৬২-৭২ খ্রিস্টাব্দ। এই ইসময় রাজপুতরা মিত্র ছিলেন। দ্বিতীয় পর্ব ১৫৭২-৭৬ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। এই সময় রাজপুতদের সামরিক দক্ষতার ওপর আকবর নির্ভরশীল ছিলেন। তৃতীয় পর্ব ১৫৭৮-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে এইসময় রাজপুতরা ছিল আকবরের বিশ্বস্ত অঙ্গ।
- (৪) ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আজমির যাত্রার পথে আকবর সর্বপ্রথম রাজপুত রাজা বিহারীমল-এর সংস্পর্শে আসেন এবং তার কন্যাকে বিবাহ করেন। বিহারীমলের এই কন্যা ‘মরিয়ম জমানি’ উপাধিতে ভূষিতা ছিলেন। এই বিবাহজাত সম্ভান যুবরাজ সেলিমকে (জাহাঙ্গির) আকবর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন।
- (৫) বিহারীমলের পুত্র ভগবান দাস ও পৌত্র মানসিংহকে যথাক্রমে পাঁচ হাজার ও সাত হাজারি মনসবদারের পদ দেন। কাবুল ও লাহোরের মতো সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের দায়িত্ব মানসিংহ ও ভগবান দাসকে দেন।
- (৬) টোডরমল, বীরবল ছিলেন আকবরের অপর রাজপুত সভাসদ। টোডরমল ছিলেন সুদক্ষ সেনাপতি ও রাজস্ব বিশারদ।
- (৭) অম্বর, বিকানির জয়সলমির, যোধপুর প্রভৃতি রাজপুত রাজপরিবারের সাথে আকবরের বৈবাহিক সম্পর্ক কখনোই বাধ্যতামূলক ছিল না। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের গুজরাট অভিযান -এর সময় বিহারীমলকে আগ্রায় মুঘল রাজপরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুঘল সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতির দিক
আকবরের রাজপুত নীতির দুটি পথ ছিল। বৈবাহিক নীতি ও বলপ্রয়োগ নীতি।
(১) আকবরের বৈবাহিক নীতি
অম্বর, যোধপুর, জয়পুর, বিকানির, বুন্দি, কোটা প্রভৃতি রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে আকবর বিবাহ নীতির পথ গ্ৰহণ করেন। টোডরমল জাবতি প্রথা প্রবর্তন করে আকবরের রাজস্ব ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেন। মানসিংহ বাংলার বারো ভুইয়ার বিদ্রোহ দমন করেন।
(২) আকবরের বলপ্রয়োগ নীতি
মেবার ও রণথম্বোর রাজ্যের ক্ষেত্রে আকবরকে বলপ্রয়োগের পন্থা নিতে হয়। আকবরই ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক যিনি রাজপুতদের সাথে সংঘাতের হলে সমঝোতাকেই প্রাধান্য দেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সমন্বয় নীতি
সমন্বয় নীতির ক্ষেত্রে আকবর বেশ কিছু পন্থা অবলম্বন করেন। যেমন –
(১) আকবরের কর লোপ
আকবর ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তীর্থযাত্রীদের ওপর থেকে তীর্থকর তুলে দেন। ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে জিজিয়া কর লোপ করেন। পাগড়ি পরিধানের জন্য কর লোপ করেন।
(২) আকবরের ক্রীতদাস প্রথা রদ
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ক্রীতদাস প্রথা লোপ করেন। হিন্দু যুদ্ধবন্দিদের দাসে পরিণত করার প্রথা রদ করেন। ‘দাস’ কথাটির বদলে ‘চেলা’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
(৩) হিন্দু উৎসবে আকবরের যোগদান
আকবর হিন্দু উৎসব দীপাবলি, হোলি বা দোলযাত্রা, বিজয়া দশমী বা দশেরাতে যোগ দেন। হিন্দুদের জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদে বিশ্বাসী ছিলেন আকবর। আকবর সতীদাহ প্রথা নিয়ন্ত্রিত করার জন্য সচেষ্ট হন।
(৪) আকবরের আমলে ইলাহী সম্বৎ
কাফি খানের মতে, ভারতের ঋতু, জলবায়ু ও ফসলের মরশুমের কথা বিবেচনা করে আকবর চান্দ্র মাস ও চান্দ্র বছরের স্থলে ভারতবর্ষের প্রচলিত সৌরবর্ষের সম্বৎ গ্রহণ করেন। তিনি এই সম্বতকে ইলাহী সম্বৎ’ নাম দেন।
(৫) আকবরের আমলে যোগ্যতার মাপকাঠি
আকবর সর্বপ্রথম মুসলিম শাসক যিনি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চপদগুলিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের নীতি চালু করেন।
(৬) আকবরের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নীতি
হিন্দু বিবাহজাত পুত্রকে সিংহাসনে বসাবার প্রথা আরম্ভ করেন আকবর। এই প্রথা শাহজাহান পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। হ্যাভেলের মতে, “আকবর ছিলেন ভারতীয়দের মধ্যে ভারতীয়।”
(৭) আকবরের সভা পণ্ডিত
আকবরের সভায় ২১ জন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের মধ্যে নয়জনই ছিলেন হিন্দু। তাঁর সভায় ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন, রসিক বীরবল, চিত্রকর মহেশ দাশ।
(৮) সাহিত্য অনুবাদে আকবরের উৎসাহ প্রদান
আকবর আবদুল কাদির বদাউনির সাহায্যে রামায়ণের ফার্সি অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। আকবরের উদ্যোগে বত্রিশ সিংহাসন, অথর্ববেদ, মহাভারত, রামায়ণ, ভগবদ্গীতা, হরিবংশ, পুরাণ, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, নল দময়ন্তীর উপাখ্যানের ফার্সি অনুবাদ করান। কলহণের রাজতরঙ্গিনী ও ভাস্করাচার্যের গণিত শাস্ত্রের ওপর রচিত গ্রন্থ লীলাবতী ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়।
(৯) চিত্র নির্মাণে আকবরের উৎসাহ প্রদান
আকবর রামায়ণের বহু ঘটনাকে অবলম্বন করে চিত্রাঙ্কনে উৎসাহ দেন। যেমন রাবণের জটায়ু বধ, দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ প্রভৃতি চিত্র।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসন ব্যবস্থা
- (১) আকবর ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে মহজরনামা ঘোষণার পর আইন রচনার সার্বভৌম অধিকার নিজ হাতে নেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার আকবরের শাসনব্যবস্থাকে ‘ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে আরবীয় ও পারসিক ব্যবস্থা” বলে অভিহিত করেছেন।
- (২) ঐতিহাসিক রিজভী মনে করেন শাসনব্যবস্থায় আকবর শেরশাহ -এর কাছে ঋণী। মোরল্যান্ড আকবরের শাসনব্যবস্থাকে ‘একান্তভাবে বাস্তব’ বলে মন্তব্য করেছেন।
- (৩) জনগণের আবেদন ও অভিযোগের শুনানি হত ‘দেওয়ানি আম’ অর্থাৎ প্রকাশ্য দরবারে।
- (৪) অপরাহ্নে পুরো দরবারে জায়গিরদার, মনসবদারদের সাথে মিলিত হয়ে রাজকার্য করতেন। সন্ধ্যাকালে মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করতেন এবং দেওয়ানি খাসে বৈদেশিক নীতি ও জরুরি বিষয়ে পরামর্শ করতেন।
- (৫) তিনি গড়ে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতেন। সন্ধ্যার দরবারে গোপন বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হত। আকবর সপ্তাহে একদিন দরবারে আপিলের বিচার করতেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের কেন্দ্রীয় শাসন
কেন্দ্রে সম্রাটকে সাহায্য করার জন্য ৪টি প্রধান দপ্তর ৪ জন মন্ত্রীর অধীনে রাখা হত।
(ক) আকবরের আমলে ভকিল বা প্রধানমন্ত্রী
বৈরাম খান ভকিলের পদে নিযুক্ত হন। মধ্য এশিয়ার প্রচলিত ব্যবস্থা অনুসারে ভকিলের স্থান সম্রাটের পরেই ছিল। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর আকবর নিজেই নিজের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতেন।
(খ) আকবরের আমলে উজির
ভকিলের পরেই ছিল উজির বা অর্থমন্ত্রী বা দেওয়ান। এই পদটিকে আকবর বিশেষ গুরুত্ব দেন। ভকিলের বহু দায়িত্ব। উজিরের হাতে দেওয়া হয়। উজিরের পদে মুজাফফর খান, টোডরমল ও শাহ মনসুর খুবই নাম করেন। উজিরের অধীনে দপ্তরের ছয়টি শাখা ছিল
(১) দেওয়ান ই-খালসা
সম্রাটের খালিসা জমির দেখাশোনা করত দেওয়ান ই-খালসা।
(২) দেওয়ান-ই-জায়গির
জায়গিরগুলি দেখাশোনা করত দেওয়ান-ই-জায়গির।
(৩) দেওয়ানা-ই-তোজি
সামরিক বিভাগের খরচের দেখাশোনা করত দেওয়ান-ই-তোজি।
(৪) দেওয়ান-ই-বয়ুতাৎ
কারখানাগুলির তত্ত্বাবধান করত দেওয়ান-ই-বয়ুতাৎ।
(৫) মুশরিফি
খাজনা কোষাধ্যক্ষ ছিলেন মুশরিফি।
(৬) দেওয়ান-ই-সাদাৎ
দাতব্য বিভাগ ছিল দেওয়ান-ই সাদাৎ।
(গ) আকবরের সামরিক মন্ত্রী মীর বকসী
উজিরের পরেই ছিল মীর বকসী। মীর বকসী ছিলেন সামরিক বিভাগের মন্ত্রী। সুলতানি যুগে দেওয়ান-ই-আরজ যে ক্ষমতা ভোগ করত মুঘল যুগে মীর বকসী সেই ক্ষমতা পান। মীর বকসী দরবারে সম্রাটের ডানদিকে বসতেন।
(ঘ) আকবরের ধর্ম বিষয়ে সদর-উস-সুদুর
- (১) মীর বকসীর পরেই ছিলেন সদর-উস-সুদুর। ইনি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ইনি দাতব্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। ইনি প্রধান কাজি বা প্রধান বিচারকের কাজ করতেন।
- (২) সদর-উস-সুদুর শরিয়তি আইনের প্রধান ব্যাখ্যাকার হিসাবে সম্রাটকে পরামর্শ দিতেন। ইনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, মাদ্রাসায় নিষ্কর জমি দানের ব্যাপারে সম্রাটকে সুপারিশ করতেন।
- (৩) আকবর পরবর্তীকালে সদর-উস-সুদুরের ক্ষমতা হ্রাস করেন। আকবরের মাহজরনামা ঘোষণার পর সদর-উস-সুদুরের ক্ষমতা হ্রাস পায়। আকবর সদর-উস-সুদুরের আইন রচনায় পরামর্শ দানের অধিকার লোপ করেন।
(ঙ) আকবরের অন্যান্য মন্ত্রী
এই চারজন মন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন মীর সামান রাজকীয় কারখানার পরিচালক ও প্রাসাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংগ্রহ কারক। দারোগা-ই ওসলখানা সম্রাটের সচিবের কাজ করত। আরিজ-ই-মুকাবর সম্রাটের ফরমানগুলি রচনা করতেন। মুহতাসিব ছিলেন জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম ও নৈতিকতা প্রচারের ভারপ্রাপ্ত।
মুঘল সম্রাট আকবরের প্রাদেশিক শাসন
আকবর প্রাদেশিক শাসনের জন্য তাঁর সাম্রাজ্যকে ১৫টি (মতান্তরে ১৮টি) সুবায় বা প্রদেশে ভাগ করেন।
- (১) প্রত্যেকটি ‘সুবা’ কয়েকটি সরকার এ, প্রত্যেকটি ‘সরকার’ কয়েকটি ‘পরগনায়’ এবং প্রতিটি ‘পরগনা’ আবার কয়েকটি ‘গ্রাম’-এ বিভক্ত করা হয়।
- (২) সুবার প্রধান শাসনকর্তাকে বলা হত ‘সুবাদার’, ‘নাজিম’ বা সিপাহসালার। সকল প্রদেশের সুবাদারদের সমান ক্ষমতা ছিল না। গুজরাটের সুবাদার হিসাবে টোডরমল সন্ধি স্বাক্ষর করতে পারতেন। এই ক্ষমতা অন্য সুবাদারদের ছিল না।
- (৩) প্রতি সুবায় একজন করে দেওয়ান থাকতেন। দেওয়ানের কাজে সাহায্যের জন্য তাঁর অধীনে কর্মচারী ছিল। পেশকার দেওয়ানের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন।
- (৪) দারোগা বাজারগুলির তদন্ত করতেন। তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৪০ টঙ্কা। তহশিলদার ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। তাঁর বেতন ছিল ৪০ টঙ্কা। হুজুর নভিস কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে চিঠিপত্র লেখালেখি করতেন।
- (৫) কোতোয়াল আইনশৃঙ্খলার কাজ করতেন। প্রথমে দেওয়ান সুবাদার কর্তৃক নিযুক্ত হলেও পরে কেন্দ্রের সুপারিশে দেওয়ান নিযুক্ত হয়।
- (৬) প্রতিটি প্রদেশ বা সুবাকে কয়েকটি সরকার বা জেলায় ভাগ করা হয়। সরকারের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন ফৌজদার। সরকার বা জেলা প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য ‘অমল গুজার’ নামে কর্মচারী রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বহন করত। আকবর-এর আমলে ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে ১০৫টি সরকার ছিল বলে ‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে জানা যায়।
- (৭) সরকার বা জেলার নীচে ছিল কসবা বা পরগনা। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সাম্রাজ্যে ২৭৩৭টি পরগনা ছিল। পরগনার সঙ্গে ইংরেজ আমলের মহকুমার তুলনা করা যায়। পরগনায় চারজন সরকারি কর্মচারী ছিল —
(ক) আকবরের প্রাদেশিক কর্মচারী শিকদার
আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিল শিকদার।
(খ) আকবরের প্রাদেশিক কর্মচারী আমিন
রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বে ছিল আমিন। তিনি গ্রামের কৃষক ও গ্রাম প্রধানের সাথে সংযোগ রাখত।
(গ) আকবরের প্রাদেশিক কর্মচারী ফোতেদার
পরগনার সরকারি কোষাধ্যক্ষ ছিল ফোতেদার।
(ঘ) আকবরের প্রাদেশিক কর্মচারী কানুনগো
কানুনগো জরিপ ও তৎসংক্রান্ত কাগজপত্র পাটওয়ারিদের সাহায্যে রক্ষা করত।
মুঘল সম্রাট আকবরের সমাজ সংস্কার
সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে আকবর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন –
(১) বাল্যবিবাহ রোধে আকবরের ভূমিকা
আকবর বাল্যবিবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে বালিকাদের বিবাহের বয়স বাড়ানোর চেষ্টা করেন। ‘তুরবেগ’ নামক কর্মচারী নিয়োগ করে এবিষয়ে দৃষ্টি রাখার ভার দেওয়া হয়। মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত সুন্নৎ-এর জন্য বারো বছর বয়স ঠিক করা হয়েছিল।
(২) মদ্যপানে নিয়ন্ত্রণে আকবরের ভূমিকা
মদ্য উৎপাদন ও বিক্রির জন্য আকবর লাইসেন্স প্রথা প্রবর্তন করেন, যাতে চিকিৎসার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রিত মদ সরবরাহ করা হয়।
(৩) আকবরের অধীনে নাগরিক অধিকার
আকবর এর অধীনে সর্বপ্রথম হিন্দু তথা ‘অ-মুসলমান’ প্রজাগণ নাগরিক মর্যাদা লাভ করেছিল।
(৪) অসম বিবাহ রোধে আকবরের ভূমিকা
অধিক বয়স্কা স্ত্রীলোক ও অল্পবয়স্ক পুরুষের মধ্যে বিবাহ যাতে ঘটতে না পারে সেজন্য আকবর এক শ্রেণীর কর্মচারীর ওপর এবিষয়ে দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব দেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা
আকবর সিংহাসনে আরোহণের প্রথম দশ বছর অর্থাৎ ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শেরশাহ প্রবর্তিত ‘রায়’ প্রথা অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ খাজনা শস্যে হিসাব করলেও নেওয়া হত নগদ টাকায়। একে বলা হত দস্তুর-উল-আমল। আকবর ছিলেন মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তক এবং এই ব্যাপারে তাঁর পথপ্রদর্শক ছিলেন শেরশাহ।
(ক) টোডরমল ব্যবস্থা
রাজস্ব সংস্কার বিষয়ে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা হলেন রাজা টোডরমল। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল রাজস্ব সংগ্রহের নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থা ‘টোডরমল ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত।
(খ) আকবরের আমলে রাজস্ব সংগ্ৰহ পদ্ধতি
টোডরমল ব্যবস্থার ফলে জমি জরিপ করে জমির উৎপাদিকা শক্তি এবং জমিতে কতদিন ধরে চাষ করা হচ্ছে তার ভিত্তিতে তিন ধরনের রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়—
- (১) জাবৎ বা জাবতি বা দহসালা,
- (২) গল্পাবকস,
- (৩) নাসক।
(১) আকবরের আমলে জাবতি ব্যবস্থা
এই রাজস্ব ব্যবস্থার জন্যই টোডরমল বিখ্যাত। “জাবতি” শব্দের অর্থ জমি জরিপ।
(i) জমি জরিপ
জমি জরিপের জন্য দড়ির পরিবর্তে লোহার আংটা দ্বারা আটকানো বাঁশের খণ্ডের দ্বারা জমি জরিপ করা হয়। ৬০ গজ× ৬০ গজ জমির পরিমাণকে এক বিঘা ধরা হয়। জমি জরিপের জন্য ইলাহী গজা নামে মাপের কঠি ব্যবহার করা হয়। বিঘার নীচের পরিমাণ কাঠির ভিত্তিতে ‘কাঠা’ নাম হয়।
(ii) জমি ভাগ
জাবতি প্রথায় জমিতে চার ভাগে ভাগ করা হয় – পোলাজ (যে জমিতে সারাবছর চাষ হয়), পরৌতি (যে জমি কিছুকাল চাষের পর উর্বরতা সঞ্চয়ের জন্য পতিত রাখা হত), চাচর (যে জমি তিন-চার বছরের জন্য পতিত রাখা হয়), ব্রঞ্জর (যে জমি পাঁচ বছরের অধিককাল পতিত রাখা হত)।
(iii) রাজস্ব নির্ধারণ
প্রথম তিনশ্রেণীর জমিকে উত্তম, মধ্যম ও অধম এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত করে উৎপাদনের গড়পড়তা হিসাব তৈরি করে উৎপাদিত শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব স্থির করা হত। রাজস্ব নগদ টাকা বা শস্যে নেওয়া হত।
(iv) প্রচলিত অঞ্চল
জাবতি ব্যবস্থা বিহার, এলাহাবাদ, মালব, অযোধ্যা, দিল্লি, লাহোর, মুলতান, রাজপুতানা অর্থাৎ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।
(২) আকবরের আমলে গল্লাবকস বা বাটাই প্রথা
এই প্রথা অনুসারে জমি জরিপ করা হত না। এই প্রথায় উৎপন্ন ফসলের ১/৩ অংশ সরকারকে দিতে হত। ফার্সি শব্দ ‘গল্লাবকস’ ভাগচাষ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
(i) শস্য ভাগ
এই পদ্ধতি অনুসারে চাষি ও সরকারের মধ্যে তিনভাগে শস্যভাগ করা হত।
(a) রসি বাটাই
শস্য কাটা ও মাড়ানোর পর ভাগাভাগি (বা শস্য কেটে গাদা করার পর ভাগ করাকে বলা হত বাওলি)।
(b) খেত বাটাই
বীজ বপনের পর খেত ভাগ করাকে বলা হত খেত বাটাই।
(c) লাং বাটাই
শস্য কেটে স্তূপীকৃত করার পর ভাগ করাকে বলা হত লাং বাটাই।
(ii) প্রচলিত অঞ্চল
গাল্লাবকস ব্যবস্থা সিন্ধুদেশ, কাশ্মীর, কান্দাহার ও কাবুলে প্রচলিত ছিল।
(৩) আকবরের আমলে নাসক প্রথা
এই প্রথা অনুসারে মোটামুটি একটি অনুমানের উপর রাজস্ব স্থির করা হয়। এই প্রথাকে কিছুটা সংশোধন করে কানকূট বা দানাবন্দি প্রথায় পরিণত করা হয়। ১/৩ ভাগ ফসল ছিল সরকারের প্রাপ্য। এই ব্যবস্থা কাথিয়াবাড়, গুজরাট ও বাংলাদেশে চালু ছিল।
(৪) আকবরের আমলে ঘরওয়ার প্রথা
এছাড়াও আর একটি পদ্ধতি ছিল ‘ঘরওয়ার”। মধ্য এশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত এই ব্যবস্থা অনুসারে একটি গাধার পিঠে যতটা শস্য চাপানো যায় তার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে রাজস্ব নির্ধারিত হত। এই পদ্ধতি কাশ্মীরে প্রচলিত ছিল।
(গ) আকবরের আমলে জমি জরিপের দন্ড
আকবর জমি জরিপের দণ্ড হিসাবে গঞ্জ-ই- সিকন্দরী স্থলে গঞ্জ-ই-ইলাহী প্রবর্তন করেন। এটি ছিল তেত্রিশ ইঞ্চি লম্বা অর্থাৎ পূর্বের চেয়ে চোদ্দ শতাংশ বড়ো। পূর্বের বিঘা ছিল ৬০ গজ × ৬০ গজ। নতুন বিঘার চেয়ে ১০.৫ শতাংশ বড়ো।
(ঘ) আকবরের আমলে রাজস্ব আদায়ের কর্মচারী
রাজস্ব আদায়ের জন্য বহু কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন।
- (১) সরকার বা জেলা প্রশাসনে আমিল গুজার নামে কর্মচারী রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বইত।
- (২) বিটিকচি জেলাস্তরে রাজস্ব আদায়, জমি জরিপের কাজে তদারকি করত।
- (৩) মুকাদ্দম কৃষকের কাছে খাজনা আদায় করে রসিদ দিত।
- (৪) পাটোয়ারি রায়ত পিছু জমির হিসাব ও তার কাছ থেকে আদায় করা খাজনার হিসাব রাখত।
- (৫) কানুনগো পরগনা স্তরে জরিপ ও তৎসংক্রান্ত কাগজপত্র পাটোয়ারিদের সাহায্যে রক্ষা করত।
- (৬) আমিন পরগনা স্তরে রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী। আমিন নিজ হাতে জমি মাপত।
- (৭) আকবর রাজধানীতে একজন প্রধান দেওয়ান ও প্রত্যেক সুবায় (প্রদেশ) একজন করে দেওয়ান নিযুক্ত করে রাজস্ব আদায়ের ভার অর্পণ করতেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সংস্কৃতি
অনুমান করা হয় য, আকবর নিরামিশাষী ছিলেন। তিনি ছিলেন নিরক্ষর। আকবরের মাথায় পাগড়ি থাকত এবং সেই পাগড়ির ভাঁজ হিন্দু ও মুসলিম রীতির মিশ্রণে করা হত। তিনি ফারসিকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালু করেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের নবরত্ন
আবুল ফজল, কবি ফৈজি, বীরবল, সংগীতজ্ঞ তানসেন, আবদুর রহিম খান, রাজা টোডরমল, ফকির আজিওদ্দিন, সেনাপতি মানসিংহ, মোল্লা দো-পেঁয়াজা আকবরের রাজসভা অলংকৃত করতেন। এইসব জ্ঞানী ব্যক্তিরা নবরত্ন বা নওরতন নামে পরিচিত ছিলেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সাহিত্য
রামচরিত মানস রচয়িতা হিন্দি কবি তুলসীদাস ও ভক্তিগীতি সুরসাগর রচয়িতা সুরদাস এই যুগেই খ্যাতিবান হন। আকবর একটি অনুবাদ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গীত
আকবরের দরবারে বহু গায়ক যেমন- তানসেন ও তাঁর পুত্র সুরত সেন, মালবের রাজা বাজবাহাদুর, অন্ধ গায়ক সুরদাস, রামদাস, মুঠিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আকবরের দরবারে হিন্দু, ইরানি, তুরানি, কাশ্মীরি প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির ৩৬ জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন। গোয়ালিয়রের মিঞা তানসেন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ।
মুঘল সম্রাট আকবরের শিল্পকলা
আকবরের রাজত্বকালে শিল্পকলার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।
(১) আকবরের আমলে স্থাপত্য নিদর্শন
আকবরের আমলে নির্মিত ফতেপুর সিক্রি, সেলিম চিস্তির সমাধি, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জামি মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, হুমায়ুনের সমাধি, সেলিম চিস্তির সমাধি, সেকেন্দ্রার সমাধি ভবন উল্লেখযোগ্য। ফতেপুর সিক্রির স্থাপত্যকে ফার্গুসন মহৎ প্রাণের প্রতিবিম্ব’ বলে অভিহিত করেছেন।
(২) আকবরের আমলে চিত্রশিল্প
চিত্রশিল্পের প্রসারের জন্য আকবর-এর রাজত্বকাল উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। আকবর চিত্রশিল্পের প্রসারের জন্য আবদুল সামাদের নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করেন। তিনি প্রায় একশোজন হিন্দু-মুসলিম শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর আমলের ১৭ জন বিখ্যাত শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু। হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন তারাচাঁদ, জগন্নাথ, যশোবন্ত প্রমুখ।
মুঘল সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি
মুঘল শাসকদের মধ্যে আকবরই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সমন্বয় সাধন করতে যত্নবান হন। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকবর্গের মধ্যে আকবরই ছিলেন সর্বাপেক্ষা উদার ও পরধর্মমত সহিষ্ণুতার প্রবর্তক।
(১) জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে আকবরের ভূমিকা
ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম মুঘল শাসক যিনি রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করেন এবং রাষ্ট্রকে উলেমাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভারতে একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে সচেষ্ট হন।
(২) আকবরের উপর উদার ধর্মনীতির প্রভাব
আকবরের উদার ধর্মনীতির মূলে বিভিন্ন প্রভাব কার্যকর ছিল। যেমন – আকবরের মাতা হামিদা বানু শিয়া ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আবদুল লতিফ ও মোল্লা পীর মহম্মদ এবং সুফি সম্প্রদায়ের চিস্তিয়াপন্থী সন্তদের প্রতি অনুরাগ।
(৩) আকবরের উপর চিস্তি সন্ত ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব
১৫৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি নিয়মিতভাবে আজমিরে মৈনউদ্দিন চিস্তির দরগা পরিদর্শনে যেতেন। তিনি সেলিম চিস্তির গুণগ্রাহী ছিলেন। আবুল ফজল ও আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারক ও ভাতা কবি ফৈজির প্রভাব, রাজপুত রমণীদের প্রভাব এবং ষোড়শ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব।
(৪) আকবরের ধর্মমতের পরিবর্তন
১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে সুফি পণ্ডিত শেখ মুবারক আকবরের সংস্পর্শে আসেন। শেষ মুবারকের জ্যেষ্ঠ পুত্র কবি কৈজি ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সভাসদ হন এবং এই বছরের শেষের দিকে আকবরের দরবারে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আবুল ফজল আসেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আকবর-এর ধর্মমতের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
(৫) মুঘল সম্রাট আকবরের ধর্মসভা নির্মাণ
১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে ফতেপুর সিক্রিতে নির্মাণ করেন ইবাদত খানা নামে এক ধর্মসভাগৃহ। এখানে বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিদের ধর্ম আলোচনার জন্য আহ্বান করেন।
(৬) আকবরের ধর্ম সভায় যোগদান
এই সভায় উপস্থিত সুন্নি ধর্মের বিখ্যাত উলেমারা হলেন শেখ আবদুল নবি, শেখ তাজউদ্দিন, আবদুল ফৎ ও নাকির খান। হিন্দু পণ্ডিত দেবী ও পুরুষোত্তন, জৈন পণ্ডিত হরি বিজয় সূরী ও বিজয় সেন সুরি, ভানচন্দ্র উপাধ্যায়, জেসুইট ধর্মযাজক ফাদার একোয়াভাইভা ও মনসারেট উপস্থিত ছিলেন। আকবর জরাথুষ্ট পণ্ডিত দস্তুর মেহেইয়ারজি রানাকে আহ্বান করেন।
(৭) বিভিন্ন ধর্মের রীতি গ্ৰহণ
১৫৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর ইবাদতখানায় ধর্মীয় বিতর্ক বহু করে। দেন। আকবর হিন্দু ধর্মের প্রভাবে জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী হন এবং মহাবীর -এর জৈন ধর্ম -এর প্রভাবে অহিংসানীতির প্রতি অনুরাগী হন। জরাথুস্ট্রীয় প্রভাবে তিনি সূর্য ও অগ্নির উপাসনা আরম্ভ করেন।
(৮) উলেমাদের আকবরকে বিরোধিতা
আকবরের এই আচরণকে গোঁড়া উলেমারা নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকেন এবং তার এই সব কাজ ইসলাম বিরোধী বলে প্রচার করে সম্রাটের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে আরম্ভ করেন। এই কাজে প্রধান ভূমিকা নেন সদর-ই-সুদুর বা প্রধান সদর আবদুল নবি। গোঁড়াপন্থী উলেমাদের সাহায্যে আবদুল নবি আকবরকে ইসলাম বিরোধী বলে প্রচার করেন।
(৯) মুঘল সম্রাট আকবরের ধর্মীয় পদক্ষেপ
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী উলেমাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আকবর দুটি পদক্ষেপ নেন –
- (১) নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও
- (২) মহজরনামা ঘোষণা।
(১০) মুঘল সম্রাট আকবরের মহজরনামা ঘোষণা
১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন আকবর মহজরনামা নামে একটি ঘোষণাপত্র জারি করেন। সভাকবি ফৈজি এই ঘোষণাপত্র রচনা করেন এবং ফতেপুর সিক্রির মসজিদ থেকে আকবর এই খুতবা পড়েন। শেখ মুবারক, আবদুল্লা সুলতানপুরী ও শেখ আবদুল নবিসহ সাতজন প্রথম সারির ইমাম এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। মহজরনামা জারি করে বলেন তিনিই হলেন ইয়াম-ই-জাদিল অর্থাৎ ইসলামিক আইনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকার।
(১১) খলিফার সমমর্যাদা দান
স্মিথ এই ঘোষণাপত্রটিকে অভ্রান্ত নির্দেশনামা” বলে অভিহিত করেছেন। ঘোষণাপত্রে আকবরকে ইসলামের সুলতান, মানবজাতির আশ্রয়স্থল’, বিশ্বাসীদের অধিনায়ক, ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করে খলিফার সমমর্যাদাসম্পন্ন হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। এই দলিলটিকে আকবরের রাজত্বের অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসি’ বলা হয়।
(১২) মুঘল সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন
সম্রাট আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে একেশ্বরবাদী ধর্মমত দীন-ই-ইলাহী‘ প্রচার করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪০ বছর (চল্লিশ)।
(ক) দীন-ই-ইলাহী গঠন
সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে এই ধর্মমত গঠিত এবং এই ধর্মমতে কোনো সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধবিশ্বাস, দেবতা, দেবমন্দির, পুরোহিত বা ধর্মগ্রন্থের স্থান ছিল না। আবুল ফজল ও বদাউনি এই তথাকথিত ধর্মের নামকরণ করেন তৌহিদ-ই-ইলাহী যার অর্থ স্বর্গীয় একেশ্বরবাদ।
(খ) দীক্ষা ও প্রার্থনা
একমাত্র রবিবার দিনটিই ছিল দীক্ষা দেওয়ার দিন। সদস্যদের দিনে তিনবার (প্রত্যুষে, মধ্যাহ্নে ও সন্ধ্যায়) প্রার্থনা করতে হত। কেবলমাত্র ১৮ জন বিশিষ্ট মুসলিম এবং একজন বিশিষ্ট হিন্দু বীরবল এই ধর্মমত গ্রহণ করেন।
(গ) সদস্যদের করণীয়
যেসব ব্যক্তি আকবরের দীন-ই-ইলাহী’ ধর্মমতে দীক্ষা নিত তাদের সম্রাটের প্রতি চারপ্রকার আনুগত্য প্রদর্শন করতে হত—মাল, জ্ঞান, দীন ও ইমান। আকবরের ছবি ইলাহীবাদীকে তার পাগড়িতে রাখতে হত। ইলাহীবাদীদের মধ্যে সাক্ষাৎ হলে আল্লা হ-আকবর’ অর্থাৎ ঈশ্বর মঙ্গলময় এবং প্রত্যূষে জাল্লাজালাল্লাহ বলতে হত।
আকবর ও ইসলাম
- (১) বদাউনি আকবরের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ এনেছেন। জেসুইট পাদরিরা আকবরকে ইসলামের শত্রু ও নির্যাতনকারী বলে অভিহিত করেছেন। এদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে স্মিথ, রভম্যান প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এই অভিমত করেছেন যে, আকবর ইসলাম থেকে সরে এসেছেন।
- (২) বিভারিজ, ভন নোয়ের বাতালি, ঈশ্বরীপ্রসাদ প্রমুখ অনেকেই বদাউনি বা জেসুইট পাদ্রিদের বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেননি। বদাউনি ছিলেন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান। আবদুল্লাহ খান উজবেগকে আকবর যে পত্র লেখেন তাতে তিনি নিজেকে ‘ইসলামের সেবক’ বলে দাবি করেন।
মুঘল সম্রাট আকবরের মনসবদারি ব্যবস্থা
মনসব প্রথাটি ভারতে মুঘল শাসনের আগে থেকেই মুসলিম দেশগুলিতে প্রচলিত ছিল। আব্বাসিদ খলিফাদের শাসনকালে মনসবদারি ব্যবস্থা চালু ছিল। মধ্য এশিয়ার চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙ্গও এই প্রথা চালু করেন।
(১) মুঘল সম্রাট আকবরের মনসব প্রবর্তন
মুঘল যুগে মনসবদারির সংগঠন, নিয়মকানুন আকবর সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন। ‘মনসব’ শব্দের অর্থ পদমর্যাদা। এই পদের অধিকারীকে বলা হত মনসবদার। প্রত্যেক মনসবদারকে পদমর্যাদা অনুসারে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈনিক, ঘোড়া ও হাতি ভরণপোষণ করতে হয়।
(২) মনসবদারদের স্তর
আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল মোট ছেষট্টিটি পদমর্যাদার মনসবদারের উল্লেখ করলেও কার্যক্ষেত্রে ৩৩টি ধাপের মনসবদার ছিল। সর্বনিম্ন পদমর্যাদার মনসবদারকে কমপক্ষে দশ এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে দশ হাজার সৈনিক প্রস্তুত রাখতে হত।
(৩) মনসবদারদের বেতন বা জায়গির দান
মনসবদারদের বেতন নগদে বা জায়গিরে দেওয়া হত। মনসব পদ বংশানুক্রমিক ছিল না। যে সব মনসবদার বেতনের পরিবর্তে বেতনের সমান আয়যুক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বা জায়গির পেতেন তাদের বলা হত জায়গিরদার।
(৪) তনখা জায়গির
মনসবদারদের বেতনের সমপরিমাণ ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য যে নির্দিষ্ট জমি জায়গির হিসাবে দেওয়া হত সেই জায়গিরকে বলা হত তনখা জায়গির।
(৫) মসরুৎ জায়গির
কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে কোনো বিশেষ কাজের জন্য শর্তসাপেক্ষে যে জায়গির দেওয়া হত তাকে বলা হত মসরুৎ জায়গির।
(৬) ওয়াতন জায়গির
মুঘল প্রশাসনের সাথে যুক্ত হিন্দু রাজা ও জমিদারদের যে জায়গির দেওয়া হত, তাকে বলা হত ওয়াতন জায়গির। ওয়াতন শব্দের অর্থ হল মাতৃভূমি। ওয়াতন জায়গির ও তার আয় উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ করা যেত।
(৭) তলব বা মঞ্জুরিকৃত দাবি
জায়গির হস্তান্তরের আদেশগুলিতে প্রথমে প্রাপকের পদমর্যাদা উল্লেখ করা হত। পরে পদমর্যাদা অনুযায়ী বেতনক্রমের নির্ধারিত পরিমাণ দেওয়া থাকত। এটি মুকারয়ারা তলব বা মঞ্জুরিকৃত দাবি নামে পরিচিত ছিল।
(৮) জমা ও হাসিল
কোনো জমি থেকে কত রাজস্ব পাওয়া যেতে পারে সরকারের কাছে তার একটা হিসাব থাকত। এই হিসাবকে বলা হত ‘জমা’। সেই এলাকা থেকে প্রকৃত রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণকে বলা হত হাসিল।
(৯) দাখিল ও আহমদ
মনসবদার ভিন্ন দাখিলী ও আহদী নামে অন্য দুই ধরনের সেনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘দাখিলী’ সেনাবাহিনীর পরিচালনার ভার মনসবদারদের ওপর ন্যস্ত থাকত তবে তারা রাজকোষ থেকে বেতন পেতেন। আহদীদের পরিচালনার ভার আমিরদের হস্তে ন্যস্ত থাকত এবং তারা উচ্চহারে বেতন পেতেন।
(১০) মনসবদারদের বেতন
একশো জাট পদাধিকারী মনসবদারদের বেতন ছিল মাসিক ৫০০ টাকা, এক হাজার পদাধিকারী মনসবদারদের বেতন ছিল ৪৪০০ টাকা এবং পাঁচ হাজারী মনসবদারদের বেতন ছিল মাসিক ৩০০০০ টাকা। এইভাবেই পদ অনুযায়ী বেতনের হার নির্দিষ্ট থাকত।
(১১) জাট ও সওয়ার
মনসবদারি প্রথার সঙ্গে ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ শব্দ দুটি যুক্ত। সাধারণভাবে বলা যায় যে, ‘জাট’ হল মনসবদারদের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা এবং ‘সওয়ার” হল পদমর্যাদা অনুযায়ী তাঁর অধীনে রক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা। ‘জাট’ পদসংখ্যা অনুযায়ী একজন মনসবদার ‘তলব-ই খাস’ বা ব্যক্তিগত বেতন এবং ‘সওয়ার’ সংখ্যা অনুযায়ী ‘তলব-ই-তকিনান’ বা পোষ্যদের জন্য বেতন পেতেন।
(১২) নিয়োগ কর্তা
মনসবদারি ব্যবস্থায় সম্রাট নিজেই ছিলেন নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বময় কর্তা। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী মনসবদাররা অপসারিত হতে পারত।
(১৩) দাগ ও চেহারা প্রথা
মনসবদাররা যাতে নির্দিষ্ট অশ্ব ও অশ্বারোহী রাখতে পারতেন তার জন্য ‘দাগ’ বা চিহ্নিতকরণ বা ‘চেহরা’ বা চিহ্নিত বিবর্তন তালিকা প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়।
(১৪) আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থার ত্রুটি
আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থার কিছু ত্রুটি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রস্তুত করে। যেমন –
- (ক) মনসবদারি প্রথার প্রধান ত্রুটি হল দুর্নীতির প্রতি আকর্ষণ। মনসবদাররা নিজ সৈনিকের সংখ্যা কারচুপি করতেন বলে মুঘল বাহিনীর ভিত্তি দুর্বল হয়।
- (খ) মুঘল সেনাবাহিনীর আনুগত্য ছিল মনসবদারদের প্রতি বাদশাহের প্রতি নয়। তাই এই প্রথা পরবর্তীকালে দুর্বল হয়ে পড়ে।
মুঘল সম্রাট আকবরের মৃত্যু
১৬০৫ সালের ২৭ অক্টোবর মধ্যরাতে মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে (আগ্রা) রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
মুঘল সম্রাট আকবরের সমাধি ক্ষেত্র
এই মহান সম্রাটকে সেকেন্দ্রায় সমাহিত করা হয়।
উপসংহার :- মুঘল সম্রাট আকবরের রাজপুত ও হিন্দুদের স্থিতিশীলতা ও শ্রদ্ধা যেমন তার ভিত্তি ও সাম্রাজ্যকে মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি তার স্থাপত্য, সাহিত্যচিত্র গুলি চিঠি ও পংক্তিতে তরুণ ও বৃদ্ধদের মন জয় করে দিগন্তের পথ প্রশস্ত করেছে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “আকবর” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) সম্রাট আকবর সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মানসিংহ।
আগ্রার সেকেন্দ্রায়।
আবুল ফজল।
হুমায়ুন।
আকবর।
আকবর।