বিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্থান

বিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্থান প্রসঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন ও সমৃদ্ধি শালী চীন, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, শক্তিশালী কমিউনিস্ট শিবির, এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, তৃতীয় বিশ্বের নেতা এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে জানবো।

বিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্থান প্রসঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ইতিহাস, চীনের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, চীনের শক্তিশালী কমিউনিস্ট শিবির, এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শক্তিরূপে চীন, তৃতীয় বিশ্বের নেতা চীন এবং চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক বিষয়ে জানব।

বিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্থান

ঐতিহাসিক ঘটনাবিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের স্থান
তাইপিং বিদ্রোহ১৮৫০-৬০ খ্রি
দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ১৮৫৬-৫৮ খ্রি
বক্সার বিদ্রোহ১৯০০ খ্রি
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা১৯২১ খ্রি
কমিউনিস্ট নেতামাও-সে-তুঙ
বিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্থান

ভূমিকা :- সুদূর অতীতে একদা চীন ছিল প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি। তবে অষ্টাদশ শতকে চিনের পশ্চাদ্‌গামিতা দেশ ও সমাজকে যথেষ্ট পিছিয়ে দিয়েছিল। এই পশ্চাদগামিতার সুযোগে চিনে পশ্চিমি দেশগুলির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। চিনে উন্নত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের নামে এই বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনে ব্যাপক শোষণ ও লুণ্ঠন চালায়।

বিদেশীদের শোষণ

দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের (১৮৫৬-১৮৫৮ খ্রি.) পরবর্তীকালে চিনা বন্দরগুলি বিদেশি শক্তিগুলির কাছে খুলে দেওয়া হলে সমগ্র চিন বিদেশি পণ্যে ছেয়ে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশ চিনে নির্দয়ভাবে শোষণ শুরু করে। এর ফলে চিনের দেশীয় বাণিজ্য ধ্বংস হয় এবং দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।

চিনের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫০-১৮৬০ খ্রি.), বক্সার বিদ্রোহ (১৯০০ খ্রি.) প্রভৃতি ছিল চিনের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেগে ওঠা প্রতিবাদ।

গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠা

চিনের কমিউনিস্ট নেতা মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বা People’s Republic of China-র প্রতিষ্ঠা বিশ্বের আধুনিক ইতিহাস-এর এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান শুধু চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

বিশ্বরাজনীতিতে চিনের স্থান

প্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থানের পর থেকে চিন বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনাগুলি হল –

(ক) স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী চিন

চিনের ওপর বিদেশি শক্তিগুলির শোষণ ও অত্যাচার বন্ধ করে মাও-সে-তুঙ যুদ্ধবিধ্বস্ত, বিভেদদীর্ণ ও হতাশ চিনা জাতির জীবনে আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে আনেন। প্রজাতান্ত্রিক শাসনে চিনাদের জাতীয় জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে এবং বিপুল জনসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী চিন জগৎ সভায় মাথা তুলে দাঁড়ায়।

(খ) সামরিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে চিনে দ্রুত সামরিক, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটতে থাকে। এর ফলে বিশ্বে চিনের মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন –

(১) সামরিক অগ্রগতি

চিন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ১৭টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ২০০ থেকে ৩০০ পরমাণু বোমা তৈরি করে। স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ব্যবস্থায়ও চিন দক্ষতা অর্জন করে। চিন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

(২) বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি

চিনে শিল্প প্রযুক্তি, পরিবহণ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রভূত বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটেছে। চিন বহু আগেই কম্পিউটারের মতো অতি সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে।

(৩) তৈলসম্পদের ব্যবহার

চিনে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে। চিনের ভূগর্ভস্থ সঞ্চিত তেলের পরিমাণ মধ্যপ্রাচ্যের চেয়েও বেশি। জনগণের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে চিন তার এই প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছে।

(গ) শক্তিশালী কমিউনিস্ট শিবির

এক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনা গুলি হল –

(১) দ্বিমেরু বিশ্ব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পরবর্তীকালে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে থাকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত পুঁজিবাদী শিবির এবং অন্যদিকে থাকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত সমাজতান্ত্রিক শিবির। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট চিনের উত্থানের ফলে কমিউনিস্ট শিবিরের প্রবল শক্তিবৃদ্ধি হয়। সোভিয়েত রাশিয়া, চিন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির গড়ে ওঠে।

(২) চিনের প্রাধান্য

কমিউনিস্ট চিনের উত্থানে এশিয়ায় কমিউনিস্টরা প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মার্কিন আধিপত্যের সাহায্য না নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে কমিউনিস্ট চিন নিজের একক শক্তিতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই কারণে কোরিয়া সংকট, ভিয়েতনাম সংকট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংকটের ক্ষেত্রে চিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।

(ঘ) এশিয়ায় গুরুত্বপূৰ্ণ শক্তি

ক্রমে চিন এশিয়ায় গুরুত্বপূৰ্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনা গুলি হল –

(১) এশিয়ায় কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রসার

এতদিন কমিউনিস্ট ভাবধারা ও আধিপত্য মূলত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল। কমিউনিস্ট চিনের উত্থানের ফলে তা এশীয় ভূখণ্ডে সম্প্রসারিত হয়।

(২) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাধান্য

চিনের উত্থানের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশই উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, চিনকে এড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিসাম্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কোরিয়া ও ইন্দোচিন-এর ঘটনাই তার প্রমাণ।

(ঙ) তৃতীয় বিশ্বের নেতা

চিন হল এশিয়া মহাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনা গুলি হল –

(১) নেতৃত্ব

গুরুত্বের জন্য চিন এশিয়া মহাদেশ ও উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। কমিউনিস্ট চিনের প্রতিষ্ঠার পর ভারত, পাকিস্তান, মোঙ্গলিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি এশীয় দেশ এবং তানজানিয়া, মালি, গিনি, কঙ্গো, জাম্বিয়া প্রভৃতি আফ্রিকান দেশ চিনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

(২) জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভূমিকা

ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ব্রহ্মদেশ, লাওস, কম্বোডিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চিন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘পঞ্চশীল’ ও ‘দশশীল’-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পাশাপাশি চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই-এর অবদানও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জেনেভা সম্মেলন (১৯৫৪ খ্রি.) এবং বান্দুং সম্মেলন (১৯৫৫ খ্রি.) চিনকে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা দান করে।

(৩) আন্তর্জাতিক সংকটে সক্রিয়তা

চিন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনায় যথেষ্ট সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশর-এর ওপর ইজরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যৌথ আক্রমণ শুরু হলে চিন মিশরের প্রতি সমর্থন জানায়। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত রাজনীতিতে চিন আরব জাতীয়তাবাদকে সমর্থন জানায়।

(চ) রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) সাম্যবাদী শক্তি বৃদ্ধি

কমিউনিস্ট চিনের উত্থানে রাশিয়া খুশি হয় এবং কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পরই রাশিয়া চিনকে স্বীকৃতি দেয়। মার্কিন-বিরোধী সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে সাম্যবাদী দুনিয়াকে শক্তিশালী করার উদ্যেগ নেন। উভয় দেশের মধ্যে রেলপথ নির্মাণ, আর্থিক ঋণদান, পারস্পরিক মৈত্রী প্রভৃতি বিষয়ে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এভাবে বৃহৎ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র দুটির মধ্যে মৈত্রী সুদৃঢ় হয়।

(২) রুশ-চিন বিরোধ

অবশ্য এক দশকের মধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে চিনের সম্পর্কের অবনতি হয়। সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ পশ্চিমি পুঁজিবাদী দেশগুলির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ঘোষণা করলে চিন ক্ষুদ্ধ হয়। ক্রুশ্চেভ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা সফরে গেলে চিন এই ঘটনাকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি রাশিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করে। ক্ষুব্ধ রাশিয়া চিনকে অর্থসাহায্য বন্ধ করে এবং রুশ বিশেষজ্ঞদের চিন থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত সমস্যাও সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।

উপসংহার :- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট চিনের ভূমিকা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। প্রসঙ্গত জাতিপুঞ্জ-এর নিরাপত্তা পরিষদের পঞ্চম স্থায়ী সদস্য হিসেবে চিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

(FAQ) বিশ্ব রাজনীতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের স্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. চীনে বক্সার বিদ্রোহ সংঘটিত হয় কখন?

১৯০০ খ্রিস্টাব্দে।

২. চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় কখন?

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে।

৩. চীনের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতার নাম কি?

মাও-সে-তুঙ।

৪. গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয় কখন?

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে।

৫. চীন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় কখন?

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে।

৬. পঞ্চশীল ও দশ সিল নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল কোন চিনা প্রধানমন্ত্রীর?

চৌ এন লাই।

Leave a Comment