অব উপনিবেশিকরণ

অব উপনিবেশিকরণ প্রসঙ্গে শব্দটির প্রথম ব্যবহার, অব উপনিবেশিকরণের সময়কাল, ফল, ম্যাকমিলানের মন্তব্য, সংজ্ঞা, বিতর্ক, শ্রেণীবিভাগ ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানবো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে অব উপনিবেশিকরণ প্রসঙ্গে অব উপনিবেশিকরণ কী,অব-উপনিবেশীকরণ কথাটির অর্থ, অব উপনিবেশিকরণের সংজ্ঞা, অব উপনিবেশিকরণ শব্দটির প্রথম ব্যবহার, অব উপনিবেশিকরণের সময়কাল ও অব উপনিবেশিকরণের ফলাফল সম্পর্কে জানব।

অব উপনিবেশিকরণ

ঐতিহাসিক ঘটনাঅব উপনিবেশীকরণ
প্রথম উল্লেখ১৯৩২ খ্রি
প্রথম ব্যবহারমরিৎস জুলিয়াস বন
সূচনাকাল১৯৪৫ খ্রি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ১৯৩৯-৪৫ খ্রি
অব উপনিবেশিকরণ

ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশগুলি পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে তীব্র সংগ্রাম শুরু করে এবং অধিকাংশ উপনিবেশই স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনতা থেকে উপনিবেশগুলির মুক্তির ঘটনাকেই ‘অব-উপনিবেশীকরণ’ বা ‘Decolonisation’ বলা হয়ে থাকে।

অব উপনিবেশীকরণ কথার প্রথম ব্যবহার

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে জার্মান পণ্ডিত মরিৎস জুলিয়াস বন সর্বপ্রথম ‘Decolonisation শব্দটি ব্যবহার করেন।

অব উপনিবেশীকরণের সময়কাল

প্রসঙ্গত, বিংশ শতকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ থেকে ঔপনিবেশিক শাসন লুপ্ত হয় অর্থাৎ পৃথিবীতে অব-উপনিবেশীকরণ ঘটে।

অব উপনিবেশীকরণের ফল

অব-উপনিবেশীকরণের ফলে এশিয়া মহাদেশে আন্তর্জাতিক দিক দিয়ে স্বীকৃত রাষ্ট্রের সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৯ খ্রি. আফ্রিকায় স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল মাত্র একটি, কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশকে এই সংখ্যা পঞ্চাশে পৌঁছায়।।

অব উপনিবেশীকরণ সম্পর্কে ম্যাকমিলানের মন্তব্য

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান তাঁর বিখ্যাত ‘Wind of change’ বক্তৃতায় বলেন, “The wind of change is blowing through the continent and whether we like it or not this growth of national policies must take account of it.”

অব-উপনিবেশীকরণের সংজ্ঞা

Springhall তাঁর ‘Encyclopedia of social science’ এর সাম্রাজ্যবাদ শীর্ষক অংশে অব উপনিবেশবাদ বলতে বুঝিয়েছেন ভূতপূর্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক উপনিবেশিগুলির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সমর্পণ অথবা সার্বভৌম ক্ষমতা সাম্রাজ্যের হাত থেকে জাতি রাষ্ট্রগুলির হাতে সমর্পণ করা।

অব উপনিবেশীকরণ সম্পর্কে বিতর্ক

অব-উপনিবেশীকরণ বা স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনটি গ্রহণযোগ্য তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অব-উপনিবেশীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যেক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শাসক তাদের ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে প্রত্যাহার করে নেয়। আবার অন্য একটি ধারণা অনুযায়ী সক্রিয় মুক্তি সংগ্রাম এবং গণআন্দোলনের চাপে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেকটাই সংকুচিত হয়। ‘অব-উপনিবেশিকরণ এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রেই অধিক প্রযোজ্য।

অব-উপনিবেশীকরণের শ্রেণিবিভাগ

অব-উপনিবেশীকরণকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, যেমন –

  • (১) শ্বেতাঙ্গদের বসতিসম্পন্ন দেশগুলিতে স্বশাসনের অধিকার প্রদান। উদাহরণস্বরূপ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের কথা বলা যায়।
  • (২) আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অবসান, যেমন ভারত।
  • (৩) ‘Formal Empire’ এর পরিবর্তে ‘Informal Empire’ এর গঠন যা নব্য উপনিবেশবাদ নামে পরিচিত। যেমন – লাতিন আমেরিকা।
  • (৪) সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবসান এবং তার পরিবর্তে আর একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুপ্রবেশ। যেমন – ইন্দোচিন-এ ফ্রান্স-এর স্থানে আমেরিকার অনুপ্রবেশ।

 অব-উপনিবেশীকরণের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

অব-উপনিবেশীকরণের তিন ধরনের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন –

(ক) জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী

এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেশজ প্রতিরোধ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মাধ্যমে উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা লাভ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা নিপীড়নের সঙ্গে আপোস নীতি গ্রহণ করে। তাঁরা পরিকল্পিতভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটায় বলে মনে করা হলেও এই জাতীয় পদক্ষেপ ছিল অনিবার্য। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারত-এ নিপীড়ন থেকে আপোষ নীতিতে উত্তরণ ঘটেছিল।

(খ) আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও অব-উপনিবেশীকরণ

  • (১) এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বজায় রাখা কার্যত দুরূহ হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আটলান্টিক চার্টারে উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়ার উল্লেখ এবং ১৯৬০ সালের সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ঔপনিবেশিক শাসনকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করার কথা উল্লেখ করা যায়।
  • (২) প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির দুর্বল হয়ে পড়া এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এলিটগোষ্ঠীর স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনও অব উপনিবেশীকরণের পথ প্রশস্থ করে।

(গ) আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা

  • (১) এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদীশক্তির আভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা ও জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে উপনিবেশগুলি অর্থনৈতিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক দিক থেকে অর্থহীন ও বোঝাতে পরিণত হয়।
  • (২) হল্যান্ড (Holland) এর ভাষায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ, “became dis-functional to the operational necessities of the metropole”। এ ছাড়া আভ্যন্তরীণ সমাজতত্ত্ববিদ, রাষ্ট্রনীতিবিদ প্রমুখের চাপ অব-উপনিবেশীকরণে সহায়ক হয়।

উপসংহার:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মতো ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো দুর্বল হয়ে যায়। সেইসাথে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ অব উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে।

(FAQ) অব উপনিবেশিকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. অব উপনিবেশিকরণ বলতে কি বোঝায়?

ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনতা থেকে উপনিবেশ গুলির মুক্তির ঘটনাকে উপনিবেশীকরণ বা ডিকলোনাইজেশন বলা হয়ে থাকে।

২. অব উপনিবেশিকরণ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ কি?

Decolonisation

৩. Decolonisation শব্দটি সর্বপ্রথম কে কখন ব্যবহার করেন?

জার্মান পণ্ডিত মরিৎস জুলিয়াস বন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. অব উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় কখন?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।

Leave a Comment