পবিত্র চুক্তি -র প্রয়োজনীয়তা, উদ্ভাবক, প্রথম আলেকজান্ডারের ধারণা, চুক্তি ঘোষণা, চুক্তির শর্ত, স্বাক্ষরের জন্য আহ্বান, পোপ ও তুরস্ক বাদ, স্বাক্ষরকারী দেশ, চুক্তির উদ্দেশ্য ও ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জানবো।
ইউরোপের ইতিহাসে পবিত্র চুক্তি প্রসঙ্গে পবিত্র চুক্তি কি, পবিত্র চুক্তি বলতে কি বুঝায়, পবিত্র চুক্তির উদ্ভাবক, পবিত্র চুক্তি ঘোষণা, পবিত্র চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ ও রাষ্ট্রনেতা, পবিত্র চুক্তির প্রয়োজনীয়তা, পবিত্র চুক্তির শর্ত, পবিত্র চুক্তির উদ্দেশ্য, পবিত্র চুক্তির ব্যর্থতার কারণ।
২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত পবিত্র চুক্তি
ঐতিহাসিক ঘটনা | পবিত্র চুক্তি |
সময়কাল | ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ |
উদ্ভাবক | রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডার |
চুক্তি বহিষ্কৃত | পোপ ও তুরস্ক |
চুক্তি স্বাক্ষরে অসম্মত | ইংল্যান্ড |
ভূমিকা :- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট -এর পতন ঘটানোর প্রধান ভূমিকা ছিল রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ইংল্যাণ্ডের। এই বিজয়ী শক্তিবর্গ ভিয়েনা সম্মেলন -এ নতুন ভাবে ইউরোপ -এ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। অতঃপর এদের সামনে প্রধান সমস্যা ছিল ভিয়েনা সিদ্ধান্তকে স্থায়ী করা এবং ইউরোপে শান্তি বজায় রাখা।
পবিত্র চুক্তির প্রয়োজনীয়তা
প্রতিটি রাষ্ট্রই অনুভব করেছিল যে, সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারাই তারা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তাই বিজয়ী শক্তিবর্গ একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন উপলব্ধি করে। এই উদ্দেশ্যে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া দু’টি চুক্তির খসড়া রচনা করে। এগুলিই যথাক্রমে ‘পবিত্র চুক্তি’ ও চতুঃশক্তি চুক্তি নামে খ্যাত।
পবিত্র চুক্তির উদ্ভাবক
পবিত্র চুক্তির উদ্ভাবক ছিলেন স্বপ্নবিলাসী, ভাবপ্রবণ, আদর্শবাদী ও ধর্মভীরু রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডার।
প্রথম আলেকজান্ডারের ধারণা
- (১) রুশ জার মনে করতেন যে, ফরাসি বিপ্লব -এর মতো প্রজা-বিদ্রোহ ছিল খ্রিস্টীয় ধর্মশাস্ত্র-বিরোধী।
- (২) ইউরোপের খ্রিস্টান রাজন্যবর্গ খ্রিস্টীয় ধর্মনীতি অনুসারে রাজ্যশাসন না করার ফলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
- (৩) তিনি মনে করতেন যে, রাজন্যবর্গ খ্রিস্টীয় ধর্মশাস্ত্র অনুসারে রাজ্যশাসন ও বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করলে ইউরোপ থেকে সকল অশান্তি দূর হয়ে যাবে।
- (৪) বলা হয় যে, জারের এই ধরনের চিন্তাভাবনার মূলে ছিল ফন ক্রুডেনার নামে জনৈক জার্মান সন্ন্যাসিনীর প্রভাব।
পবিত্র চুক্তি ঘোষণা
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে’ খ্রিস্টীয় রাজধর্ম সম্পর্কে যে সব আদর্শের উল্লেখ আছে, জার ইউরোপীয় রাজন্যবর্গকে সেগুলি পালনের আহ্বান জানান এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে সেপ্টেম্বর পবিত্র চুক্তি-র ঘোষণা করেন।
পবিত্র চুক্তির শর্ত
এই চুক্তিতে বলা হয় যে,
- (১) ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ পরস্পরকে খ্রিস্টীয় সমাজের অধীনে ভ্রাতা হিসেবে বিবেচনা করবেন।
- (২) নিজ নিজ প্রজাদের তাঁরা সন্তান হিসেবে মনে করবেন।
- (৩) তাঁরা ‘ন্যায়, মানবপ্রেম ও শান্তি’-কে অবলম্বন করে রাজ্যশাসন করবেন।
- (৪) দেশ শাসনের সঙ্গে তাঁরা ধর্মের মহান অন্তর্নিহিত সত্যগুলি পালন করবেন।
- (৫) চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি পরস্পরকে ভ্রাতা মনে করে উপরোক্ত আদর্শগুলি নিজ নিজ রাজ্যে কার্যকর করবেন।
স্বাক্ষরের জন্য আহ্বান
পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সকল রাজন্যবর্গকে এই চুক্তিতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
পবিত্র চুক্তি স্বাক্ষরে পোপ ও তুরস্ককে বাদ
খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু পোপ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সমর্থক এবং তুরস্কের সুলতান ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই কারণে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়।
পবিত্র চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ
রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া এই চুক্তিতে প্রথম স্বাক্ষর করে। পরে একে একে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিও এতে যোগ দেয়। ইংল্যান্ড এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে নি।
পবিত্র চুক্তির উদ্দেশ্য
- (১) এই চুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ধর্মের আবরণে ইউরোপে পুরাতনতন্ত্রকে স্থায়ী করা এবং বৈপ্লবিক ভাবধারাকে নির্মূল করা। কারণ বিপ্লবী ভাবধারা খ্রিস্টীয় ভাবাদর্শের বিরোধী।
- (২) পবিত্র চুক্তিকে কোনোও চুক্তি বা রাজনৈতিক সন্ধিপত্র বলা যায় না বরং একে একটি পবিত্র ঘোষণা বা একটি নীতিমূলক ঘোষণা বলা যায়।
- (৩) প্রত্যেক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের কিছু দায়-দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা এবং নির্দিষ্ট কর্মপন্থার উল্লেখ থাকে। সেদিক থেকে পবিত্র চুক্তিপত্র ছিল নিছক একটি ঘোষণাপত্র এবং অবাস্তব, অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে কিছু নীতিবাক্যের সমন্বয়।
পবিত্র চুক্তি বা পবিত্র বা চুক্তি কিছুই না
বলা হয় যে, পবিত্র চুক্তি ‘পবিত্ৰ’ বা ‘চুক্তি’ কোনোটিই ছিল না।
পবিত্র চুক্তি ব্যর্থতার কারণ
এই চুক্তির ব্যর্থতার জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করা যায়। যেমন –
- (১) স্বার্থ-সর্বস্ব রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে খ্রিস্টীয় আদর্শে রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবেন, তা আশা করা যায় না।
- (২) স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলি জারকে খুশি করার জন্যই পবিত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও কোনোও রাষ্ট্রই একে গুরুত্ব দেয় নি। তাই বাস্তবতাবোধ-বিবর্জিত এই চুক্তি এমনিতেই ব্যর্থ হত।
- (৩) অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তিনি এটিকে ‘অর্থহীন বাগাড়ম্বর’ এবং ‘নীতিজ্ঞানের বাহ্যাড়ম্বর’ বলে বিদ্রুপ করতেন।
- (৪) ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসালরি একে ‘আদর্শবাদী অর্থহীন রহস্যাবৃত বাক্যবিন্যাস’ বলে অভিহিত করেন।
- (৫) ফ্রান্সের মন্ত্রী তালেরাঁ-র মতে, এটি ছিল ‘হাস্যাস্পদ চুক্তি’। পোপ সপ্তম পায়াস অভিযোগ করেন যে, পবিত্র চুক্তি খ্রিস্টান ধর্মের নামে ধর্মীয় ভণ্ডামি মাত্র।
- (৬) ইংল্যান্ড ছিল সমকালীন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। ইংল্যান্ড এই চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃত হওয়ায় এর ব্যর্থতা ছিল অবশ্যম্ভাবী।
- (৭) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসালরি এই চুক্তির লক্ষ্যগুলির অস্পষ্টতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। ইংল্যান্ড এই চুক্তিতে যোগ দিলে তাকে কি ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হবে, তার কোনও উল্লেখ না থাকায় তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন।
- (৮) ইংল্যান্ড মনে করেছিল যে, এই চুক্তিতে যোগ দিলে তাকে ‘বিপজ্জনক ও অদৃষ্টপূর্ব দায়িত্বে’ পড়তে হবে। তাই শুরু থেকেই ইংল্যান্ড এর বিরোধিতা করতে থাকে।
- (৯) ইউরোপীয় রাজনীতিকগণ প্রথম থেকেই এই চুক্তিকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া মনে করে যে, এই চুক্তি সমগ্র ইউরোপের উপর প্রথম আলেকজান্ডারের স্বেচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যতীত অন্য কিছু নয়। সুতরাং ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা এই চুক্তির ব্যর্থতাকে অনিবার্য করে তোলে।
- (১০) এই চুক্তির সঙ্গে জনগণের কোনও সম্পর্ক ছিল না, বরং রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় ইউরোপীয় জনগণ একে মানুষের স্বাধীনতা বিনাশের হাতিয়ার বলে মনে করে শুরু থেকেই এর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।
- (১১) ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির যুগে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী রাজ্যশাসন করা ছিল হাস্যকর প্রয়াসমাত্র।
- (১২) রাশিয়ার জার ব্যতীত অন্য কেউ এই চুক্তি সম্পর্কে আন্তরিক ছিলেন না। সুতরাং এই চুক্তিতে গুরুত্বপ্রদানকারী একমাত্র ব্যক্তি জার প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর (১৮২৫ খ্রিঃ) সঙ্গে সঙ্গে এই চুক্তিরও মৃত্যু ঘটে।
উপসংহার :- জার্মানির দার্শনিক গ্যেটে অবশ্য মন্তব্য করেন যে, পবিত্র চুক্তির মতো অধিকতর ও মহান কর্মপন্থা এর পূর্বে আবিষ্কৃত হয় নি।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “পবিত্র চুক্তি” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) পবিত্র চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডারের উদ্যোগে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তি বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি বর্জন করে যে পরস্পর মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে তা পবিত্র চুক্তি নামে পরিচিত।
রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার।
পবিত্র চুক্তি ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।
রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার।
২৬ শে সেপ্টেম্বর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে।
ইংল্যান্ড।
অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্পগুলি
- কেন্দ্রীয় চোল শাসন
- সাম্রাজ্য ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য
- অর্থনীতিতে দাসপ্রথার গুরুত্ব
- রোমের দাসদের মুক্তির উপায়
- রোমান সাম্রাজ্য ও উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগের প্রভাব
- জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ
- রোমান সমাজে নারীর অবস্থান
- বাইজানটাইন সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা দিক
- রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ