রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীনকালে এ দুই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক সংযোগ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে ভারতীয় মসলা, রেশম, রত্ন, এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রপ্তানি হত। সমুদ্রপথ এবং স্থলপথ উভয়ের মাধ্যমেই এই বাণিজ্য চালু ছিল, বিশেষ করে রোমের সাথে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালী ছিল। রোমানদের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীর উৎস, যেখানে ভারতীয় রাজারা রোম থেকে স্বর্ণ এবং রৌপ্য আমদানি করতেন।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ
ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্প | রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ |
প্রধান বাণিজ্য পণ্য | মসলা, রেশম, মূল্যবান পাথর, হাতির দাঁত, স্বর্ণ, রৌপ্য, অলংকার, কাঁচের পণ্য |
বাণিজ্য পথ | রোমান-ভারতীয় বাণিজ্যের জন্য বিশেষ করে সমুদ্রপথ ব্যবহৃত হত; স্থলপথও ব্যবহৃত হয়েছিল, সমুদ্রপথ (আরব সাগর), স্থলপথ (সিল্ক রোড) |
বাণিজ্য কেন্দ্র | মিশর, রোম, কনস্টান্টিনোপল,মুজিরিস, আরিকামেদু, বারিগাজা |
সংস্কৃতি ও কূটনীতি | রোমানরা ভারতীয় দর্শন, ধর্ম এবং শিল্পকলা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল |
ভূমিকা :- সুপ্রাচীন কাল থেকেই রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে যোগাযোগ দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে ভারত-এর কুষাণ সাম্রাজ্য-এর ভৌগোলিক অবস্থান ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বদিকে চিন সাম্রাজ্য আর পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্য, এই দুইয়ের মাঝখানে অবস্থিত কৃষাণ সাম্রাজ্য ছিল সেতুস্বরূপ। রেশমপথ ও কুষাণ সাম্রাজ্যের মধ্যে দিয়েই বিস্তৃত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমান সম্রাট অগাস্টাসের শাসনকালে রোমের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের যোগাযোগের সূচনা ঘটে। কথিত আছে, অগাস্টাসের অনুচরদের মধ্যে একজন ছিল ভারতীয়। আবার দক্ষিণ ভারতের আরিকামেডুতে প্রাপ্ত রোমান মুদ্রাগুলি রোম-ভারত বাণিজ্যের পরিচায়ক। তাই বলা যায় যে, চিন সাম্রাজ্য, কুষাণ সাম্রাজ্য এবং রোম সাম্রাজ্য পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে যেন একস্রোতে মিলিত হয়েছিল।
ভারত ও রোমের রাজনৈতিক যোগাযোগ
রোম-ভারত রাজনৈতিক যোগাযোগ প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণ থাকলেও সবসময় এই শান্তি বজায় ছিল না। রোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের যুগে বাণিজ্যপথগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বেশ কয়েকটি ভারতীয় প্রদেশের সঙ্গে রোমের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তবে এই সংঘর্ষ ছিল সাময়িক এবং তা উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপকে ব্যাহত করে নি। যদিও রোমান সাম্রাজ্যে অশান্তির কারণে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে ভারত-রোম সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্লিনি ও স্ট্রাবো-র রচনায় এবং পেরিপ্লাস গ্রন্থ থেকে ভারত-রোম কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা জানা যায়।
প্রাচীন রোম ও ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ (ভারত-রোম বাণিজ্য)
- (১) খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ভারত-রোম যোগাযোগের সূচনা হলেও রোম-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতকে। প্রাচ্যের বাণিজ্যের ইতিহাসে রোম-ভারত বাণিজ্য ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর পরবর্তী অন্তত চার শতক জুড়ে এই বাণিজ্য গতিশীল ছিল। এই বাণিজ্য চলত স্থল ও জলপথে। রোমান সম্রাটরাও এই বাণিজ্যের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন।
- (২) ভিয়েনা জাদুঘর-এ সংরক্ষিত একটি ঋণের চুক্তিপত্রে ভারত-রোম বাণিজ্যিক যাত্রাপত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এই চুক্তিপত্রে হেরোমাপোল্লন নামের একটি জাহাজের উল্লেখ আছে। এটি মুজিরিস (ক্র্যাঙ্গানোর) বন্দরে অপেক্ষারত ছিল, যার ভিত্তিতে মনে হয় বাংলার গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে মুজিরিস হয়ে আলেকজান্দ্রিয়া-রোম পর্যন্ত একটি বাণিজ্যিক পথ বিস্তৃত ছিল। ভারত-রোম বাণিজ্যের নানা তথ্য পাওয়া যায় গ্রিক ও রোমান লেখকদের বিবরণ থেকে। তাঁদের রচনায় ভারতের নানা বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
- (২) মৌর্যোত্তর যুগের ভারত-রোম বাণিজ্যের কথা বলেছেন অধ্যাপক ই এইচ ওয়ার্মিংটন। কেবল রোম নয়, এ সময় চিনের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। স্ট্রাবোর রচনা প্লিনির ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’, টলেমির ‘জিওগ্রাফিকে হুফেগেসিস’ এবং এক অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিক রচিত ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য ইরিথ্রিয়ান সি’ নামক গ্রন্থ থেকে ভারত-রোম বাণিজ্যিক কার্যকলাপের কথা জানা যায়।
- (৩) রোমান ইতিহাসবিদ স্ট্রাবো যখন মিশরের রোমান প্রশাসক এলিয়াস গ্যাল্লাস-এর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন (খ্রি.পূ. ২০-১৯ অব্দ নাগাদ), তখন তিনি দেখেছিলেন যে, প্রতিবছর অন্তত ১২০টি জাহাজ ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিত। তা ছাড়া রোমে বহুল প্রচলিত অ্যারেটাইন মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে পন্ডিচেরির নিকটবর্তী আরিকামেডু প্রত্নস্থল থেকে। যার ভিত্তিতে অনেকে একে রোমান উপনিবেশ বলে মনে করেছেন। এ ছাড়া রোমান সুরাপাত্রের (amphora) অংশবিশেষ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গেছে। মনে করা হয়, এই মৃৎপাত্রগুলির মাধ্যমে রোমে প্রস্তুত মদ ও জলপাইয়ের তেল ভারতে আনা হত।
- (৪) রোম-ভারত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রামাণ্য উপাদান হল রোমান সম্রাটদের সমৃদ্ধ মুদ্রাভান্ডার, যেগুলি দক্ষিণ- ভারতের নানা প্রত্নস্থলে পাওয়া গেছে। তবে উত্তর ভারতে প্রাপ্ত রোমান মুদ্রার সংখ্যা কম। তাই অনেকে মনে করেন, কুষাণ রাজারা রোমান মুদ্রা গলিয়ে নিজেদের মুদ্রা তৈরি করেছিলেন বলেই রোমান মুদ্রা উত্তর ভারতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। এসময় বাণিজ্যে রোমের ঘাটতি হত। কেননা রোম থেকে রপ্তানি করা পণ্যের থেকে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের মূল্য ছিল অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, প্লিনিসহ অন্যান্য কয়েকজন লেখক রোমান সেনেটে ভারতীয় বিলাসদ্রব্যের প্রতি রোমান সম্রাট ও অভিজাতদের আসক্তি এবং অযথা অর্থ অপচয়ের নিন্দা করেছেন।
- (৫) এই সময় রোমে রপ্তানি করা হত চাল, গম, সুগন্ধি মশলা, চন্দনকাঠ, মসলিন, চিনি, হাতির দাঁত, পশুপাখি ও দামি পাথর আর আমদানি করা হত তামা, সিসা, সোনা, রূপো, মদ, পানপাত্র, ধূপ, তিল, তেল, মধু প্রভৃতি।
- (৬) গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর আমলে ভারত-রোম বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় কেরল ও তামিলনাড়ু থেকে আবিষ্কৃত রোমান মুদ্রা থেকে। এ সময় রোমে রপ্তানি করা হত চাল, গম, সুগন্ধি মশলা, গোলমরিচ, চন্দন কাঠ, মূল্যবান পাথর, নীল, ওষুধ, মৃগনাভি প্রভৃতি, আর ভারতে আমদানি করা হত ঘোড়া, হাতির দাঁত, রেশম, তামা, নীলকান্তমণি, সুরাপাত্র (amphora) ও রক্তিম চকচকে অ্যারেটাইন মৃৎপাত্র। এ ছাড়া রোমান বণিকেরা ভারতে বহু স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা রপ্তানি করেছিল। এইভাবে বাণিজ্যিক সূত্রে রোম-ভারত সখ্য তৈরি হয়েছিল।
ভারত ও রোমের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ
- (১) রোম-ভারত যোগাযোগের ফলে উভয় দেশে নানা সাংস্কৃতিক প্রভাব দেখা যায়। বিশেষ করে ভারতের গান্ধার শিল্প-এ মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে দেহ ও ভঙ্গিমার বৈশিষ্ট্য এসেছিল রোমান শিল্পকলা থেকে। আবার এই শিল্পে গ্রিক শিল্পের প্রভাব দেখে অনেকে এই শিল্পকে গ্রেকো-রোমান শিল্প রূপে অভিহিত করেছেন।
- (২) রোমান সাম্রাজ্য গণিত, চিকিৎসা, ইতিহাস, দর্শনসহ নানা ক্ষেত্রে ভারতীয় সভ্যতার কাছে ঋণী ছিল। অন্যদিকে ভারতীয় পন্ডিতরা রোমান আইন, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
- (৩) সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অপর একটি অঙ্গ ছিল ধর্ম। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ্য, জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম-এর প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। তেমনই রোমে প্রথম দিকে বহুত্ববাদী পেগান ধর্ম এবং পরে খ্রিস্টধর্মের প্রাবল্য দেখা যায়। তবে রোমানদের দেবদেবী ও ভারতীয় দেবতাদের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। এইভাবে ভারত ও রোমের মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটেছিল।
উপসংহার :- রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সম্পর্ক প্রধানত বাণিজ্যিক ছিল, যা দুই অঞ্চলের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। প্রাচীনকালে রোমানরা ভারত থেকে মূল্যবান পণ্য যেমন মসলা, রেশম, এবং রত্ন আমদানি করত, যা রোমান সমাজের অভিজাতদের মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত ছিল। একইভাবে, ভারতীয় উপমহাদেশ রোমান স্বর্ণ ও রৌপ্য আমদানি করে তাদের বাণিজ্যিক ও সামাজিক প্রভাবকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়াও, রোমান সাম্রাজ্যের শিল্প ও সংস্কৃতিতে ভারতীয় প্রভাব দেখা যায়, বিশেষ করে ধর্ম, দর্শন এবং কারুশিল্পের ক্ষেত্রে। যদিও এই দুই শক্তির মধ্যে প্রত্যক্ষ সামরিক বা রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া খুব সীমিত ছিল, তবে বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তা ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
(FAQ) রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বাণিজ্য মূলত সমুদ্রপথে, বিশেষ করে আরব সাগর হয়ে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হত। স্থলপথেও সিল্ক রোড ব্যবহার করে কিছু বাণিজ্য হতো।
ভারত থেকে রোমান সাম্রাজ্যে মসলা, রেশম, মূল্যবান পাথর, হাতির দাঁত এবং বিভিন্ন ধরনের পারফিউম রপ্তানি করা হত।
প্রাচীনকালে রোমানরা ভারত থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, রত্ন, এবং কাঁচের তৈরি জিনিস আমদানি করত।
দক্ষিণ ভারত বিশেষত চোল, চের এবং পাণ্ড্য রাজ্যের বাণিজ্যে রোমান মুদ্রা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত, যা বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ।
সম্রাট আগস্টাসের সময় রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তৃত হয়।