সম্রাট জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ বলতে মূলত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হারক্লিয়ান রাজবংশকে বোঝানো হয়, যা সম্রাট জাস্টিনিয়ান (৫২৭-৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) এর পরে আসে। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে হারাক্লিয়াস প্রথম এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। হারাক্লিয়াসের শাসনামলে সাম্রাজ্যের সংস্কার ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা হয়। তবে পরবর্তী সম্রাটদের সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণ ও বাইরের আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়ে, যা সাম্রাজ্যের পতনের দিকে নিয়ে যায়।
রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ
ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্প | জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ |
হেরাক্লিয়ান রাজবংশ | ৬১০-৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ |
সিরিয়ান রাজবংশ | ৭১৭-৮০২ খ্রিস্টাব্দ |
নিকেফোরিয়ান রাজবংশ | ৮০২-৮১৩ খ্রিস্টাব্দ |
আমোরিয়ান রাজবংশ | ৮২০-৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ |
ম্যাসিডোনিয়ান রাজবংশ | ৮৬৭-১০৫৭ খ্রিস্টাব্দ |
দৌকাস রাজবংশ | ১০৫৯-১০৮১ খ্রিস্টাব্দ |
কমনেনস রাজবংশ | ১০৮১-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ |
অ্যাঞ্জোলোস রাজবংশ | ১১৮৫-১২০৪ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- সম্রাট জাস্টিনিয়ান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজবংশের সম্রাটরা ক্ষমতায় আসেন এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হন। তারা বাইরের শত্রুদের আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হন। এই সময়ে রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হারাক্লিয়াস রাজবংশ, যা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে আরবদের আক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাস্টিনিয়ানের শাসনকালের পর বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে তার গৌরব হারাতে শুরু করে, তবে বিভিন্ন সম্রাটদের শাসনে সাম্রাজ্য কিছু সময়ের জন্য স্থিতিশীলতাও লাভ করে।
হেরাক্লিয়ান রাজবংশ (৬১০-৬৯৫ খ্রি.)
- (১) জাস্টিনিয়ান রাজবংশের শেষ সম্রাট মৌরিস-কে ক্ষমতাচ্যুত করে ফোকাস নামে এক অখ্যাত ব্যক্তি বাইজানটাইন সাম্রাজ্য-এ ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্বল্পকালের শাসনে তার সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হেরাক্লিয়াস ফোকাসকে সরিয়ে হেরাক্লিয়ান রাজবংশের শাসনের সূচনা করে।
- (২) ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে এই রাজবংশ শাসন করে। এই বংশের রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যথা – রোম-পারস্য যুদ্ধ এবং অ্যাভার-বাইজানটাইন যুদ্ধ। দুটি রোম-পারস্য যুদ্ধের ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ অব্দ থেকে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলেছিল। হেরাক্লিয়াসের আমলে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।
- (৩) সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাইজানটাইনের উত্তরে ও দানিয়ুব নদীর দক্ষিণে বলকান অঞ্চলে বসবাসকারী অ্যাভার জাতির সঙ্গে বাইজানটাইনদের দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং যার পরিণতিতে সংঘটিত হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অ্যাভার-বাইজানটাইন যুদ্ধ (৫৬৮ ৬২৬ খ্রি.) নামে পরিচিত। নবম শতকে অ্যাভার জাতি অধিকৃত অঞ্চলে বুলগার জাতি বুলগেরীয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ফলে নবম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাইজানটাইনদের সঙ্গে বুলগেরীয় সাম্রাজ্যের ধন্য ছিল।
- (৪) বাইজানটাইনদের সাথে আরবের ইসলাম শক্তির সঙ্গে যে যুদ্ধ হয়েছিল তা আরব-বাইজানটাইন যুদ্ধ (৬২৯ ১০৫০ খ্রি.) নামে পরিচিত। হেরাক্লিয়ান বংশের শাসনকালে সিরিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা হয়ে স্পেন পর্যন্ত অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে।
কুড়ি বছরের নৈরাজ্য (৬৯৫ ৭১৭ খ্রি.)
হেরাক্লিয়াসের পরবর্তীকালে এই রাজবংশের আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শাসকের নাম পাওয়া যায় না। এই বংশের শেষ শাসক দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ানের (৬৮৫- ৬৯৫ খ্রি.) রাজত্বকালে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই সময় একের পর এক সম্রাট ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু তাঁদের কোনো কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় না। অবশেষে ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় লিও সিংহাসনে আরোহণ করলে সাম্রাজ্যে স্থিরতা আসে। তাই ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭১৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রায় এই দুই দশক সময়কাল কুড়ি বছরের নৈরাজ্য নামে পরিচিত।
ইসৌরিয়ান (সিরিয়ান) রাজবংশ (৭১৭-৮০২ খ্রি.)
বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে কুড়ি বছরের নৈরাজ্যের অবসান ঘটান ইসৌরিয়ান রাজবংশের প্রথম সম্রাট তৃতীয় লিও (৭১৭-৭৪১ খ্রি.)। তিনি সফলভাবে উমাইয়া খিলাফত বা সাম্রাজ্যের হাত থেকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। তাঁর একটি বিখ্যাত কাজ হল ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের মাধ্যমে তিনি বাইজানটাইনের খ্রিস্টানদের যিশু বা তাঁর মা মেরির মূর্তি বা ছবি পূজা নিষিদ্ধ করেন। যা ইতিহাসে বাইজানটাইন আইকোনোক্লাজম (Byzantine Iconoclasm) নামে পরিচিত। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ইসলাম ধর্মের মূর্তিপূজা বিরোধী মনোভাবের প্রভাবে তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই সময় আইকোনোক্লাজম অনুগামীরা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে যিশু বা তাঁর মা মেরির মূর্তি বা ছবির সামনে প্রার্থনা করত এমন খ্রিস্টানদের হত্যা করে। বোধহয় এই সূত্র ধরেই প্রায় দুই শতক পর খ্রিস্টানরা রোমান ক্যাথোলিক ও ইস্টার্ন অর্থোডক্স-এই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা ইতিহাসে ‘মহাবিভেদ’ (Great Schism) নামে পরিচিত। এই রাজবংশের অন্যান্য সম্রাটদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
নিকেফোরিয়ান রাজবংশ (৮০২-৮১৩ খ্রি.)
ইসৌরিয়ান রাজবংশের পর প্রথম নিকেফোরোস নিকেফোরিয়ান বংশের শাসনের সূচনা (৮০২ খ্রি.) করেন। এই রাজবংশ মাত্র ১১ বছর (৮১৩ খ্রি. পর্যন্ত) রাজত্ব করেছিল। ৮১১ খ্রিস্টাব্দে বুলগেরিয়ার সাথে প্লিক্সার যুদ্ধে নিকেফোরোস মারা যান। এই বংশের শেষ সম্রাট ছিলেন প্রথম মাইকেল। তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেন জেনারেল পঞ্চম লিও। মাত্র সাত বছরের মাথায় অপর এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাইজানটাইন সম্রাট হন দ্বিতীয় মাইকেল। ইনিই ছিলেন আমোরিয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
আমোরিয়ান রাজবংশ (৮২০-৮৬৭ খ্রি.)
আমোরিয়ান রাজবংশের সম্রাট দ্বিতীয় মাইকেলের রাজত্বকালে মুসলমানেরা বাইজানটাইনদের কাছ থেকে ক্রীট ও ইতালির সিসিলি দ্বীপ অধিকার করে। এই রাজবংশের অপর দুজন সম্রাট সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
ম্যাসিডোনিয়ান রাজবংশ (৮৬৭-১০৫৭ খ্রি.)
আমোরিয়ান রাজবংশের শেষ সম্রাট তৃতীয় মাইকেলের আত্মীয় ও রাজকর্মচারী প্রথম বাসিল হন বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট। তিনিই হলেন ম্যাসিডোনিয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজবংশ প্রায় দুই শতক রাজত্ব করেছিল। এই বংশের শাসনকালে শেষবারের মতো বাইজানটাইন সভ্যতার কিছুটা পুনরুত্থান ঘটে। তবে এই বংশের সম্রাটদের প্রতিনিয়ত মুসলমান আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। ম্যাসিডোনিয়ান রাজবংশের নবম সম্রাট দ্বিতীয় বাসিল বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছিলেন। তিনি বুলগেরিয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। এ কারণেই তাঁকে বলা হয় বুলগার ঘাতক (Bulgar Slayer)। ম্যাসিডোনিয়ান রাজবংশের শেষ শাসক ছিলেন ষষ্ঠ মাইকেল। তাঁর সিংহাসন ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই এই রাজবংশের পতন ঘটে।
দৌকাস রাজবংশ (১০৫৯-১০৮১ খ্রি.)
এরপর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে দৌকাস রাজবংশের শাসন শুরু হয়। এই বংশের শাসনকালে সেলজুক তুর্কি শাসকরা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের আনাতোলিয়া (বর্তমান তুরস্ক) অধিকার করে।
কমনেনস রাজবংশ (১০৮১-১১৮৫ খ্রি.)
কমনেনস বংশের শাসনের সূচনা হয় ১০৮১ খ্রিস্টাব্দে। এক শতক জুড়ে এই বংশ বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে রাজত্ব করে। এই বংশের পাঁচজন সম্রাট ছিলেন। এই বংশের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। এই বংশের প্রথম সম্রাট প্রথম আলেক্সিওস-এর আমলে প্রথম ক্রুসেড (১০৯৬-১০৯৯ খ্রি.) ও তৃতীয় সম্রাট প্রথম ম্যানুয়েল-এর আমলে দ্বিতীয় ক্রুসেড (১১৪৭-১১৫০ খ্রি.) হয়েছিল। আসলে বাইজানটাইন সম্রাট ধর্মকে হাতিয়ার করে পশ্চিমি দেশগুলিকে ক্রুসেড-এ উৎসাহিত করেন। অন্যদিকে ক্যাথোলিকরা ১০৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিভক্ত হওয়ার ফলে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স ভাবধারার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সেই আহ্বানে সাড়া দেন।
অ্যাঞ্জেলোস রাজবংশ (১১৮৫-১২০৪ খ্রি.)
বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে শেষ ক্ষমতাশালী রাজবংশ ছিল অ্যাঞ্জেলোস রাজবংশ। প্রায় ১৯ বছর এই রাজবংশ ক্ষমতায় ছিল। এই রাজবংশের শাসনকালে তৃতীয় ক্রুসেড (১১৮৯- ১১৯২ খ্রি.) সংঘটিত হয়।
উপসংহার :- চতুর্থ ক্রুসেড (১২০২-১২০৪ খ্রি.) চলাকালীন ক্রুসেডাররা কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করে। ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ তথা বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে কতকগুলি ছোটো ছোটো সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। যেমন- লাতিন সাম্রাজ্য, নাইসিয়া সাম্রাজ্য, এপিরাস ডেসপোটেট সাম্রাজ্য, ট্রেবিজোন্ড সাম্রাজ্য, থেসালনিকা সাম্রাজ্য প্রভৃতি। এইসব সাম্রাজ্যে পরবর্তীকালে লাসকারিস রাজবংশ (১২০৫-১২৬১ খ্রি.) এবং প্যালিওলোগাস রাজবংশের (১২৬৯-১৪৫৩ খ্রি.) সম্রাটরা রাজত্ব করেন।
(FAQ) জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হারাক্লিয়াসের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয় এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংস্কার। তিনি সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন এবং পারস্যের হাত থেকে বাইজেন্টাইন ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করেন।
হারাক্লিয়াসের পরে তার উত্তরাধিকারীরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল রাখতে ব্যর্থ হন। ইসলামিক খিলাফতের আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ কোন্দল তাদের শাসনকে দুর্বল করে দেয়।
কনস্টান্স II সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিরক্ষাকে মজবুত করার জন্য রাজধানী কনস্টান্টিনোপল থেকে সিসিলির সিরাকিউসে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয় নি।
জাস্টিনিয়ান II তার নিষ্ঠুরতা এবং শক্তি ধরে রাখার প্রচেষ্টার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। প্রথমবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন, কিন্তু তার নৃশংস নীতির কারণে আবার ক্ষমতাচ্যুত হন এবং শেষ পর্যন্ত নিহত হন।
হারক্লিয়ান রাজবংশের পতন ঘটে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে, যখন জাস্টিনিয়ান II দ্বিতীয়বার ক্ষমতাচ্যুত হন এবং নিহত হন। এই ঘটনার মাধ্যমে হারক্লিয়ান রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে।