বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া গ্রামের অবস্থান, অভিনবত্বের দাবি, প্রকৃতি মায়ের অকৃপণ দান, অতীত নিদর্শন, দর্শনীয় বস্তু শুশুনিয়া পাহাড়, নরসিংহ মন্দির, জলধারা, শুশুনিয়া লিপি, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত, সুনীতিকুমারের অভিমত, কবি চণ্ডীদাসের জন্মভূমি, শ্রাবণী মেলা, জনশ্রুতি, শুশুনিয়া পাহাড়ের বর্ণনা, অন্যান্য দর্শনীয় বস্তু, থাকার ব্যবস্থা, ভ্রমণের উপযুক্ত সময় ও পাথরের শিল্প সম্পর্কে জানবো।
বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া স্থানটি প্রসঙ্গে শুশুনিয়ার অবস্থান, শুশুনিয়ার অতীত নিদর্শন, শুশুনিয়ার দর্শনীয় বস্তু, শুশুনিয়ার জলধারা, শুশুনিয়ার পাথরের শিল্প, শুশুনিয়া পাহাড়, শুশুনিয়া লিপি, শুশুনিয়ার নরসিংহ মন্দির, কবি চন্ডীদাসের জন্মভূমি শুশুনিয়া, শুশুনিয়া পাহাড়ের ঝরনা, শুশুনিয়া পাহাড়ের শ্রাবণী মেলা, শুশুনিয়া পাহাড়ের বর্ণনা, শুশুনিয়া ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
শুশুনিয়া গ্রাম
ঐতিহাসিক স্থান | শুশুনিয়া |
অবস্থান | বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ |
বিখ্যাত | পর্যটন কেন্দ্র |
বিশেষ দ্রষ্টব্য | শুশুনিয়া পাহাড় |
বিশেষ আকর্ষণ | শ্রাবণী মেলা |
ভূমিকা :- শুশুনিয়া ভারত -এর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার একটা ছোটো পাহাড়ি অঞ্চল। এটি বাঁকুড়া জেলার এক অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
শুশুনিয়ার অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া শহর থেকে আনুমানিক পঁচিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শুশুনিয়া। বাঁকুড়ার মালভূমি অঞ্চলকে রুক্ষ, শুষ্ক ভাবেন অনেকে। কিন্তু সেই ধারণাটা একেবারে বদলে যাবে শুশুনিয়া পাহাড় ভ্রমণ করলে।
শুশুনিয়ার অভিনবত্বের দাবি
নতুন জায়গা, নতুন পাহাড়, মানুষকে সব সময় আকৃষ্ট করে এবং শুশুনিয়া পাহাড়ও সেই দিক থেকে অভিনবত্বের দাবি করতে পারে।
প্রকৃতি মায়ের অকৃপণ দান শুশুনিয়ার জলধারা
এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পর্যটকদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ হল শুশুনিয়া পাহাড়ের আর্টেজীয় কূপের অবিরত জলধারা। শুশুনিয়া পাহাড় পর্যটন করতে আসা মানুষের জন্যে প্রকৃতি মায়ের অকৃপণ দান হল এই জলধারা
শুশুনিয়ার অতীত নিদর্শন
প্রাচীন জনবসতির চিহ্ন পাওয়া যায় বাঁকুড়ায়। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ গড়ে উঠেছিল তাম্র-প্রস্তর যুগ -এর সভ্যতা। প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ও প্রোটো-দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ছিলেন এই জেলার আদি বাসিন্দা। পরে আর্যরা এসে তাঁদের সঙ্গে মিশে যান। সুদূর অতীতের নিদর্শন আপনি দেখতে পাবেন শুশুনিয়া পাহাড়েও।
শুশুনিয়ার দর্শনীয় বস্তু
লাল, মহুয়া,অর্জুন আর পলাশ ঘেরা জঙ্গল ও পাহাড় ঘেরা গ্রাম নিয়ে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিস্ময়কর স্থান। এখানকার দর্শনীয় বিষয়গুলি হল –
শুশুনিয়া পাহাড়
প্রকৃতির অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্য অন্বেষণ করে শুশুনিয়া পাহাড়ে প্রাচীন মুহুর্তগুলিকে পুনরুদ্ধার করা যায়। বাঁকুড়া আর পুরুলিয়ার মাঝখানে ১২০০ ফুট উঁচু এই পাহাড় পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ।এই পাহাড়টি হিমালয়ের চেয়েও প্রাচীন বলে মনে করা হয়। ইতিহাস অনুসারে, এই পাহাড়ে রাজা চন্দ্রবর্মণের দুর্গ ছিল। পাহাড়টি দুর্দান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক মান বহন করছে।জিরাফ, এশিয়াটিক সিংহ, হায়েনা এবং আরও অনেক প্রাণী প্রজাতির মতো অনেক প্রাচীন জীবাশ্মের আবাস। শুশুনিয়া পাহাড় বিভিন্ন ধরণের ঔষধি গাছের একটি দুর্দান্ত সংরক্ষিত ভূমি। আপনার অবসর দিনগুলি উদ্ভিদের বিশাল শামিয়ানাকে আলিঙ্গন করে প্রকৃতির শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যে ব্যয় করুন।
শুশুনিয়ার নরসিংহ মন্দির
পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করছে ‘নরসিংহ’ এর একটি উন্মুক্ত মন্দির। প্রতিমাটি পাথরের তৈরি এবং অন্য হিন্দু দেবীর মতো দেখায় না। নরসিংহ’র একপ্রস্তরস্তম্ভটির দৈত্যিক চেহারা পুরাণের বর্ণনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেখে মনে হয় এই অঞ্চলের আদিবাসী যেমন সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, ভিল প্রমুখ আদিবাসীরা এই প্রতিমার পূজা করতেন।
শুশুনিয়ার জলধারা
‘নরসিংহ’ মন্দিরের নিকটে ঝর্ণার জল একটি পাথর থেকে বেরিয়ে আসছে যার ঔষধি গুনাগুণ রয়েছে এবং এটি অন্যান্য পানীয় জলের গুণমানের চেয়ে তুলনায় আরও ভাল। তবে জলের প্রকৃত উৎস এখনও জানা যায়নি।
শুশুনিয়া লিপি
শুশুনিয়া পাহাড়টিও ঐতিহাসিক মূল্যমান সমৃদ্ধ। এখানে একটি শিলালিপি প্রত্যক্ষ করা যায়,যা পশ্চিমবঙ্গের ‘প্রাচীনতম’ শিলালিপি হিসাবে বিবেচিত। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, রাজা চন্দ্রবর্মণ এই স্থানে তাঁর দুর্গটি তৈরি করেছিলেন তবে বর্তমানে এই দুর্গের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর শিলালিপিগুলি অনুসারে এই স্থানের নাম পুষ্করণ রাখা হয়েছিল। পুষ্করণ বা পখন্না চন্দ্রবর্মণের রাজ্যের রাজধানী ছিল। লোকেরা বিশ্বাস করে যে এই রাজা, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।প্রাচীন শিলালিপিতে দুটি অংশ এবং একটি বিশিষ্ট ‘চক্র’ (চাকা) প্রজ্জ্বলিত প্রান্তযুক্ত আছে। প্রথম অংশটি ইঙ্গিত দেয় যে শিলালিপিটি রাজা চন্দ্রবর্মণের কাজ এবং দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে যে চোষগ্রাম গ্রামটি চক্রস্বমিন-এ স্থানান্তরিত হয়েছিল
শুশুনিয়ার লিপি সম্পর্কে রাখালদাসের অভিমত
প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “সমুদ্র গুপ্ত -এর প্রশস্তি ও শুশুনিয়া লিপির চন্দ্রবর্মা এবং দিল্লির স্তম্ভ লিপির চন্দ্র যে অভিন্ন, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নাই।”
শুশুনিয়ার লিপি সম্পর্কে সুনীতিকুমারের অভিমত
ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে “দ্য ওল্ডেস্টব্রাহ্মি ইনক্রিপশন ইন বেঙ্গল” (বাংলার সব থেকে পুরোনো ব্রাহ্মি লিপি)।
কবি চণ্ডীদাসের জন্মভূমি শুশুনিয়া
শুশুনিয়া পাহাড়ের একপারে বড়ু চণ্ডীদাসের জন্মভিটে ছাতনা আর অন্যদিকে আদিবাসী ঘেরা গ্রাম।
শুশুনিয়া পাহাড়ে উৎসব শ্রাবণী মেলা
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস শুশুনিয়া পাহাড়ে বাস করেন মহাদেব শিব। দূরে চোখে পড়ে পাঞ্চেত পাহাড়। শুশুনিয়ার পাথর খোদাই শিল্প খুবই বিখ্যাত। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে এখানে বসে শ্রাবণী মেলা। মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে শুশুনিয়ার ঝরণা থেকে জল সংগ্রহ করতে ছুটে আসেন অগনিত ভক্ত। এক মাস ব্যাপি চলে মেলা।
শুশুনিয়া পাহাড়ের ঝর্ণা সম্পর্কে জনশ্রুতি
পাহাড়ে ওঠার মুখে একটি ঝর্ণা আছে। সেই ঝরনার মুখে একটি প্রাচীন পাথরের নরসিংহ মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই ঝর্ণায় স্নান করলে আপনার শরীর-মন দুই ভালো হয়ে যাবে, আবার এই ঝরনার জল পান করলেহজমের সমস্ত সমস্যা দূর হয়ে যায়। কিন্তু এই জল কোথা থেকে আসছে সেটা কেউ জানে না। তবে এই জল এখানে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। পাহাড়ের পাদদেশেই ঝরনার কাছে রয়েছে নৃসিংহদেবের একটি খোলা মন্দির। তবে অনেক ইতিহাসবিদগণ এটিকে বীরস্তম্ভ বলেই মনে করেন।
শুশুনিয়া পাহাড়ের বর্ণনা
এই পাহাড়ের তিনটি ধাপ। প্রথম পাহাড় ওঠার পর উপর থেকে চারিদিকে সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সঙ্গে পরিমাণমত জল বিস্কুট রাখবেন। খুব বেশি নেওয়ার দরকার নেই, কারণ প্রথম পাহাড়ে ওঠার কিছুটা ধাপে ধাপেই এখানে জল বিস্কুটের অস্থায়ী দোকান। তারপর দ্বিতীয় পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা চলে গেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আপনি ইচ্ছা করলে সারা দিনই এই পাহাড়ে ট্রেকিং করতে পারবেন। তবে বিকালের আগে অবশ্যই নেমে আসবেন। প্রচুর গাছপালা ফুল এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই পাহাড়কে সুন্দর করে তুলেছে।
শুশুনিয়ার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
কাছাকাছি একটি রক্ষাকালী মন্দির আছে। এছাড়া গাড়ি ভাড়া করে আপনি কাছে বিহারীনাথ পাহাড়,গড়পঞ্চকোট, বিরিঞ্চিনাথের মন্দির, বরন্তি এইসব জায়গাও ঘুরে আসা পারে। তাছাড়া বাঁকুড়া জেলা শহর ও ঐতিহাসিক স্থান বিষ্ণুপুর খুব দূরে নয়।
শুশুনিয়ায় থাকার ব্যবস্থা
এখানে থাকার জন্য উল্লেখযোগ্য হোটেলগুলোর মধ্যে মারুত বাহা ইকোপার্ক, শুশুনিয়া ইয়ুথ হোস্টেল, শুশুনিয়া ফরেস্ট কটেজ, শুভম রিসর্ট, কমলাকান্ত গেস্ট হাউস, গ্রিন লজ ইত্যাদি আছে। এখানে টেন্ট করে থাকার ব্যবস্থাও আছে। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে ইকো পার্ক, এখানেও থাকার ব্যবস্থা আছে।
শুশুনিয়া ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
গরমকালে এই অঞ্চলে অত্যধিক গরম থাকে, সেই সময়ে একদমই যাওয়া উচিত নয়। বহু সংখ্যক পর্যটক এই অঞ্চলে শীতকালে এসে থাকে এই অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে। তাছাড়া কাছাকাছি অঞ্চলে যারা থাকে তাদের কাছে পিকনিকের জন্য শীতকালের আদর্শ জায়গা এটা। বর্ষাকালেও অনেকে আসে। সেইসময় তুলনামূলকভাবে পর্যটকদের কম ভিড় থাকে, সঙ্গে চারিদিকের ঘন সবুজ বর্ষাকালে শুশুনিয়া পাহাড় এলাকাকে আরো মোহময়ী করে তোলে। তবে সেই সময়ে পাহাড়ে ওঠা বিপজ্জনক হতে পারে। শুশুনিয়া পাহাড়ে আসার সেরা সময় হল নভেম্বর থেকে মার্চ।
শুশুনিয়ার পাথরের শিল্প
এখানে পাথরের শিল্প বিখ্যাত। পাহাড়ের পাথর নিয়ে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে বিখ্যাত প্রস্তরশিল্প। যে শিল্পের কদর শুধু বাংলা নয়, তার খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশে। রয়েছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত প্রস্তর শিল্পীও।পাথর কেটে সুন্দর বিভিন্ন মূর্তিগুলো সত্যিই অসাধারণ। পাথরের বাসন, শিলনোড়া, খেলনা বা অন্যান্য জিনিসও আছে। শুশুনিয়া মানেই প্রস্তরশিল্পীদের হাতের কাজ।
উপসংহার :- বাঁকুড়ার হস্তশিল্প বিশ্ববিখ্যাত। বাঁকুড়ার ঘোড়ার মূর্তি তো এক প্রকার বাংলার আইকন বলা যায়।সেগুলোও এখানে পাওয়া যায়।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “শুশুনিয়া” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) শুশুনিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বাঁকুড়া জেলার ছাতনা থানা থেকে ১০ কিমি পশ্চিমে।
শুশুনিয়া পাহাড়, নরসিংহ মন্দির, বিশেষ ঝরণা।
১২০০ ফুট।
পূর্বঘাট পর্বতমালা।