উপদ্বীপের যুদ্ধ

উপদ্বীপের যুদ্ধ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র পর্তুগাল, ফন্টেন ব্ল্যু সন্ধি, সন্ধির শর্ত, পর্তুগাল দখল, স্পেন আক্রমণের কারণ, স্পেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্পেন দখলের প্রতিক্রিয়া, যুদ্ধের গতিধারা হিসেবে বেলনের যুদ্ধ, উপদ্বীপের যুদ্ধ, নেপোলিয়নের উপস্থিতি, ট্যালাভেরার যুদ্ধ, ফরাসি বাহিনীর পরাজয়, যোসেফের স্পেন ত্যাগ, ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে স্পেনের ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা, গেরিলা যুদ্ধনীতি, স্পেনের জাতীয়তাবোধ, ইংল্যান্ডের সাফল্য, ক্যাথলিক ধর্ম, যোসেফের অযোগ্যতা, স্পেনীয় যুদ্ধে।

স্পেনীয় বা উপদ্বীপের যুদ্ধ প্রসঙ্গে উপদ্বীপের যুদ্ধের সময়কাল, উপদ্বীপের যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ, ফন্টেনব্ল্যু সন্ধি, উপদ্বীপের যুদ্ধ বা স্পেনের যুদ্ধে ফরাসি সেনাপতি, উপদ্বীপের যুদ্ধের কারণ, আইবেরীয় উপদ্বীপ পেনিনসুলার যুদ্ধ, উপদ্বীপের যুদ্ধের গতিধারা, উপদ্বীপের যুদ্ধের প্রকৃতি, উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ, স্পেনীয় ক্ষত, উপদ্বীপের যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব।

উপদ্বীপের যুদ্ধ

ঐতিহাসিক যুদ্ধউপদ্বীপের যুদ্ধ
সময়কাল১৮০৮-১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ
বিবাদমান পক্ষনেপোলিয়ন এবং স্পেন ও পর্তুগাল
বেলনের যুদ্ধ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ
স্যালামাঙ্কার যুদ্ধ১৮১২ খ্রিস্টাব্দ
ভিট্টোরিয়ার যুদ্ধ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ
ফলাফলনেপোলিয়নের ব্যর্থতা
উপদ্বীপের যুদ্ধ

ভূমিকা:- মহাদেশীয় ব্যবস্থা কে কার্যকর করতে গেলে নেপোলিয়নের পক্ষে সমগ্র আইবেয়ীর উপদ্বীপ অর্থাৎ পর্তুগাল ও স্পেনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। এই দুটি দেশ দখল করতে গিয়ে নেপোলিয়ন উপদ্বীপের যুদ্ধ বা স্পেনীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র পর্তুগাল

পর্তুগাল ছিল ইংল্যান্ড -এর পুরোনো মিত্র। প্রায় এক শতক ধরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এবং পর্তুগাল ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

ফন্টেন ব্ল্যু সন্ধি

বার্লিন ডিক্রি জারির পর নেপোলিয়ন পর্তুগাল-রাজকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সকল বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং ব্রিটিশ পণ্যাদি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। পর্তুগাল-রাজ এই নির্দেশ অমান্য করলে নেপোলিয়ন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের সঙ্গে ফন্টেন ব্ল্যুর গোপন সন্ধি স্বাক্ষর করেন।

ফন্টেন ব্ল্যু সন্ধির শর্ত

এই সন্ধি অনুসারে স্থির হয় যে, ফ্রান্স ও স্পেনের যুগ্ম বাহিনী পর্তুগাল আক্রমণ করবে এবং জয়লাভের পর তারা পর্তুগাল ও তার উপনিবেশগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে।

পর্তুগাল দখল

১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে মার্শাল জুনো-র নেতৃত্বে ফ্রান্স ও স্পেনের যুগ্মবাহিনী স্পেনীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করে পর্তুগাল দখল করে। পর্তুগাল রাজপরিবার ব্রাজিলে পালিয়ে যায়। পর্তুগালে মহাদেশীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

স্পেন আক্রমণের কারণ

নেপোলিয়নের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্পেন জয়। তাঁর স্পেন আক্রমণের পশ্চাতে একাধিক কারণ ছিল। যেমন –

  • (১) মার্কহাম বলেন যে,নেপোলিয়ন স্পেনীয় নৌ-বাহিনী সম্পর্কে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। ট্রাফালগারের যুদ্ধের সময় এই নৌ-বাহিনী তাকে যথেষ্ট সাহায্য করে। ওই সময় থেকেই এই নৌ-বাহিনী দখল করে তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলবার ইচ্ছা তিনি পোষণ করতেন।
  • (২) নেপোলিয়ন মনে করেছিলেনযে, ইউরোপ -এর অন্যান্য দেশের মতো স্পেনের জনসাধারণও তাঁকে ‘মুক্তিদাতা’ বলে অভিনন্দন জানাবে। এছাড়া, বিপ্লবী সংস্কারসমূহ প্রবর্তন করলে স্পেনের মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাঁর সমর্থকে পরিণত হবে।
  • (৩) পর্তুগাল অভিযানের সময় ফরাসি সেনাদল স্পেনের মধ্য দিয়ে যায় এবং এই সময় প্রাশিয়া-সংক্রান্ত কিছু দলিল নেপোলিয়নের হাতে আসে। তাতে দেখা যায় যে, স্পেনের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং কার্যত প্রধান শাসক গোদয় প্রাশিয়ার সঙ্গে যুগ্মভাবে ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনা করেছেন। এই পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য নেপোলিয়নের স্পেন দখল অপরিহার্য ছিল।
  • (৪) তিনি আরও মনে করেন যে, ফ্রান্সের প্রাকৃতিক সীমা এবং নিজ বংশের শাসন বজায় রাখতে গেলে স্পেন অতি প্রয়োজনীয়।

স্পেনের রাজনৈতিক অবস্থা

  • (১) স্পেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন খুবই বিশৃঙ্খল ছিল। বুরবোঁ রাজবংশের একটি শাখা তখন স্পেন শাসন করত। স্পেন-রাজ চতুর্থ চার্লস ছিলেন অযোগ্য ও ব্যক্তিত্বহীন। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ছিল রানির প্রিয়পাত্র ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন্ত্রী গোদয়-এর হাতে।
  • (২) রাজার মৃত্যুর পর তিনি স্পেনের সিংহাসন দখলের চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। অপরদিকে যুবরাজ ফার্দিনান্দ-এর পক্ষে পুরো ব্যাপারটি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি তাঁর দুর্বলচিত্ত পিতা, দুশ্চরিত্রা মাতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন্ত্রী গোদয় এবং তাঁদের কার্যকলাপ মানতে পারছিলেন না। জনগণ ছিল যুবরাজের পক্ষে।
  • (৩) এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি সাহায্য প্রার্থনা করলে নেপোলিয়ন পরিস্থিতির সুযোগ নেন। তিনি গোদয়-কে বন্দি করেন এবং স্পেন-রাজ চতুর্থ চার্লস ও যুবরাজ ফার্দিনান্দকে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেন।
  • (৪) ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন স্পেনের সিংহাসনে বসানো হয় নেপোলিয়নের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যোসেফ বোনাপার্টকে। যোসেফের ছেড়ে আসা নেপলসের সিংহাসনে বসেন মুরাট।

স্পেন দখলের প্রতিক্রিয়া

  • (১) নেপোলিয়নের স্পেন দখল ছিল চরম হঠকারিতা ও অজ্ঞতার পরিচায়ক। তিনি স্পেনবাসীর মানসিকতাকে বুঝতে পারেন নি। রুদে বলেন যে, এটি ছিল একটি মারাত্মক ভ্রান্তি (“It was a serious miscalculation.”)।
  • (২) জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ স্পেনবাসীর পক্ষে নেপোলিয়নের এই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি। পিরেনিজ থেকে জিব্রাল্টার পর্যন্ত সমগ্র স্পেন চরম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
  • (৩) স্পেনের ধর্মভীরু ও অশিক্ষিত কৃষকরা দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ শুরু করে এবং সাধারণ মানুষ দলে দলে এই সেনাদলে যোগদান করে। ক্যাথলিক গির্জা এবং অভিজাত শ্রেণির প্রভাবে স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে অসংখ্য ‘জুন্টা” বা বিদ্রোহী প্রতিরোধ সমিতি। ক্যাডিজে শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি কেন্দ্রীয় জুন্টা।
  • (৪) এই সংগঠনগুলি নিজেদের হাতে স্থানীয় প্রশাসন তুলে নেয় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম চালাতে থাকে। আন্দোলনের ব্যাপকতায় সিংহাসনে বসার মাত্র এগারো দিন পর যোসেফ রাজধানী ছাড়তে বাধ্য হন।
  • (৫) নেপোলিয়নের কাছে এ ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। এতদিন তিনি জার্মানিইতালিতে রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, কিন্তু স্পেনেই তিনি সর্বপ্রথম গেরিলা পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ একটি সঙ্ঘবদ্ধ জাতীয় বিদ্রোহের সম্মুখীন হন।
  • (৬) অধ্যাপক ডেভিড টমসন লিখছেন যে, এতদিন পর্যন্ত নেপোলিয়ন বেতনভুক পেশাদার সেনাদেরই পরাজিত করেছিলেন—এখন তিনি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেন।

যুদ্ধের গতিধারা

স্পেনীয় বা উপদ্বীপের যুদ্ধের গতিধারা ছিল নিম্নরূপ। –

(ক) বেলনের যুদ্ধ

১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বিশ্ববাসীকে চমকিত করে বেলেনের যুদ্ধে স্পেনীয়রা ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে এবং ২০ হাজার সেনা-সহ ফরাসি সেনাপতি দুপঁ আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।

(খ) বেলনের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রভাব

বেলনের যুদ্ধের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। যেমন –

  • (১) এটি ছিল স্পেনবাসীর প্রথম জয়। এর ফলে তারা নববলে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের প্রতিরোধ আন্দোলন শক্তিশালী হয়।
  • (২) নেপোলিয়ন অপরাজেয়—এই ধারণাধূলিসাৎ হয়ে যায়। এই ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি জার্মানি থেকে তাঁর ‘গ্র্যান্ড আর্মি’-র একটি অংশকে স্পেনে পাঠান এবং নিজে স্পেনীয় যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
  • (৩) এই ঘটনা পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়ারাশিয়াকে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে।
  • (৪) পর্তুগাল ব্রিটেনের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়।

(গ) উপদ্বীপের যুদ্ধ

  • (১) পর্তুগাল ও স্পেনে নেপোলিয়ন-বিরোধী এই গণ-অভ্যুত্থান পেনিনসুলার যুদ্ধ বা উপদ্বীপের যুদ্ধ নামে পরিচিত। পর্তুগালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ১৩ হাজার ইংরেজ সেনা-সহ আর্থার ওয়েলেসলি (পরবর্তীকালের ডিউক অব ওয়েলিংটন) পর্তুগালে উপস্থিত হন।
  • (২) তিনি ছিলেন ভারত -এর বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলি-র মধ্যম ভ্রাতা। তিনি ভিমিয়েরো-র যুদ্ধে (Battle of Vimiero) ফরাসি সেনাপতি জুনো-কে পরাস্ত করেন। সিন্ত্রার কনভেনশন অনুসারে জুনো-কে পর্তুগাল ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়। ইংরেজ সেনা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন দখল করে।

(ঘ) নেপোলিয়নের উপস্থিতি

  • (১) এই অবস্থায় ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্বয়ং নেপোলিয়ন স্পেনে উপস্থিত হন। স্পেনবাসীর চরম প্রতিরোধকে চূর্ণ করে ডিসেম্বর মাসেতিনি রাজধানী মাদ্রিদ দখল করেন। ভ্রাতা যোসেফ আবার স্পেনের সিংহাসনে বসেন।
  • (২) ইতিমধ্যে নেপোলিয়ন করুন্নার যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি স্যার জন মুরকে পরাস্ত করেন। এই সময় ইউরোপের অন্যান্য সংকটে জড়িয়ে পড়ার ফলে নেপোলিয়ন স্পেনীয় যুদ্ধে আর মন দিতে পারেন নি। তিনি স্পেন ত্যাগে বাধ্য হন এবং এরপর ব্যক্তিগতভাবে তিনি আর স্পেনের যুদ্ধে যোগ দেন নি।

(ঘ) ট্যালাভেরার যুদ্ধ

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ওয়েলেসলি আবার লিসবনে আসেন এবং ট্যালাভেরার যুদ্ধে (Battle of Talavera) ফরাসি সেনাপতি ভিক্টর-কে পরাজিত করেন। তিনি অবশ্য মাদ্রিদ দখল করতে পারেন নি। তাঁর সাফল্যে খুশি হয়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভাইকাউন্ট ওয়েলিংটন (Viscount Wellington) উপাধিতে ভূষিত করেন।

(ঙ) ফরাসি বাহিনীর পরাজয়

ওয়াগ্রামের যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাস্ত করার পর নেপোলিয়ন ১ লক্ষ ৫০ হাজার সেনা-সহ সেনাপতি ম্যাসেনাকে স্পেনে পাঠান। স্পেনে অবস্থানরত সেনানায়ক সুল্ট তাঁকে কোনোপ্রকার সহযোগিতা করেন নি। এর ফলে টোরেস ভেড্রাস-এর যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়।

(চ) যোসেফের স্পেন ত্যাগ

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়নের রুশ অভিযান শুরু হলে স্পেন ও পর্তুগাল থেকে তিনি বহু সৈন্য সরিয়ে আনেন। ফলে আর্থার ওয়েলেসলির সুবিধা হয় এবং তিনি স্যালামাঙ্কার যুদ্ধ (১৮১২) ও ভিট্টোরিয়ার যুদ্ধে (১৮১৩) ফরাসিদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। যোসেফ চিরতরে স্পেন-ত্যাগে বাধ্য হন।

(ছ) অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই

এরপর ওয়েলেসলি পিরেনিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে ফ্রান্সের অভ্যন্তরে ঢুকে যান। চতুর্দিকে শক্রবেষ্টিত হয়ে ফ্রান্স তখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ

স্পেনের যুদ্ধে নেপোলিয়ন তথা ফরাসিদের ব্যর্থতার জন্য নানা কারণকে দায়ী করা যায়। যেমন –

(১) স্পেনের ভৌগোলিক পরিবেশ

স্পেন ছিল পাহাড়-পর্বত-অরণ্য ও জলাভূমিতে পূর্ণ এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দেশ। এর জলবায়ু বড়োই বিচিত্র — শীত-গ্রীষ্মের পরিবর্তন ছিল বড়োই আকস্মিক। এই ধরনের বিচিত্র ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নেপোলিয়নের সেনাদলের কাছে যথেষ্ট অসুবিধাজনক ছিল।

(২) খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা

স্পেন ছিল একটি পর্বতসঙ্কুল দরিদ্র দেশ। এর জনবসতি ছিল বিক্ষিপ্ত এবং কৃষিক্ষেত্রও যথেষ্ট উন্নত নয়। এখানে কোনও বিশাল সেনাবাহিনীর পরিবহন ও খাদ্য সমস্যার সমাধান সহজ ছিল না। স্পেন এমন একটি দেশ যেখানে বিশাল সেনাবাহিনী অনাহারে শুকিয়ে মরে, আর ক্ষুদ্র বাহিনী পরাজিত হয়।

(৩) গেরিলা যুদ্ধনীতি

স্পেনের এই ভৌগোলিক পরিবেশ গেরিলা যুদ্ধের অনুকূল ছিল। স্পেনীয় গেরিলারাঅতর্কিত আক্রমণে ফরাসি সেনাদের ছিন্নভিন্ন করে দিত, তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহে নানা বিঘ্ন ঘটাত।হ্যাজেন বলেন যে, “রক্ষণাত্মক যুদ্ধের জন্য স্পেন উপযুক্ত ছিল, কিন্তু | আক্রমণাত্মক যুদ্ধের জন্য তা সুবিধাজনক ছিল না।”

(৪) স্পেনের জাতীয়তাবোধ

এতদিন নেপোলিয়ন বিভিন্ন রাজন্যবর্গের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। স্পেনের মানুষদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের স্বরূপ তিনি বুঝতে পারেন নি। নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের কাছে তাঁকে মাথা নত করতে হয়।

(৫) সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধে নামেন নি

  • (ক) স্পেনের যুদ্ধে নেপোলিয়ন পূর্ণ সময় এবং মনোযোগ দিতে পারেন নি, কারণ এই সময় তিনি মধ্য ইউরোপের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
  • (খ) ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি স্পেনের যুদ্ধে যোগ দেন, কিন্তু করুন্নার যুদ্ধের পর ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পেন-ত্যাগে বাধ্য হন। তিনি আর স্পেনে যান নি।
  • (গ) ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেনাপতি ম্যাসেনা-কে স্পেনে পাঠান, কিন্তু তাঁকে উপযুক্ত সাহায্য দিতে ব্যর্থ হন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেনাপতি সুল্ট-কে ফ্রান্সে ফেরত পাঠান।
  • (ঘ) অবশেষে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে যখন সব দিক থেকে বিধ্বস্ত তখন তিনি বিনা কারণে বেশ কিছু নির্দোষ সৈনিককে হত্যা করেন। তিনি যদি সর্বশক্তি দিয়ে স্পেনে যুদ্ধে নামতেন, তাহলে তার কী ফল হত বলা দুরূহ।
  • (ঙ) এছাড়া, ফরাসি সেনাপতিদের পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ঈর্ষা ফরাসি বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি।

(৬) ইংল্যান্ডের সাফল্য

ইংল্যান্ডের বিরোধিতা নেপোলিয়নের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।ইংল্যান্ড অর্থ, অস্ত্র, সৈন্য দিয়ে সর্বভাবে স্পেনকে সাহায্য করে। এছাড়া, আর্থার ওয়েলেসলির মতো দক্ষ ব্রিটিশ সেনানায়কও স্পেনীয়দের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ঐতিহাসিক ম্যারিয়ট লিখছেন যে, ইউরোপকে জানানো হল যে, নেপোলিয়ন অপরাজেয় নন।

(৭) ক্যাথলিক ধর্ম

স্পেনের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ক্যাথলিক সম্প্রদায়-ভুক্ত নিম্ন যাজক সম্প্রদায় ও পুরোহিত শ্রেণি। গির্জার সম্পত্তির উপর নেপোলিয়নের হস্তক্ষেপ তাঁদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। তাঁরা নেপোলিয়নের বিরোধিতা করেন এবং স্পেনীয়দের যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। মারখাম বলেন যে, স্পেনের প্রতিরোধ ছিল মূলত ধর্মীয়।

(৮) যোসেফের অযোগ্যতা

নেপোলিয়ন তাঁর ভ্রাতা যোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসান।স্পেনবাসী তাঁকে মেনে নেয় নি। তাছাড়াতিনি ছিলেন অযোগ্য ও অপদার্থ। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই তাঁর ছিল না। তিনি সেনাপতিদের পারস্পরিক বিদ্বেষ মিটিয়ে তাঁদের লক্ষ্যকে একমুখী করতে ব্যর্থ হন। স্পেনে নেপোলিয়নের ক্ষমতার ভিত্তিই ছিল দুর্বল।

স্পেনীয় যুদ্ধের প্রকৃতি

নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনীয়দের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত নন। যেমন –

  • (১) ডেভিড টমসন একে ‘জাতীয় যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। বলা হয় যে, স্পেনবাসী ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই নেপোলিয়নের বিরোধিতা করেছিল।
  • (২) মারখাম, রুদে প্রমুখ ঐতিহাসিক এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। রুদে বলেন যে, স্পেনে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কৃষক ও নিম্ন যাজক শ্রেণি। তাঁরা ছিলেন রক্ষণশীল এবং তাঁদের স্বার্থও ছিল সীমিত।
  • (৩) স্পেনে তখন বুর্জোয়া শ্রেণির কোনও অস্তিত্বই ছিল না। সুতরাং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ দ্বারা তাঁদের অনুপ্রাণিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।
  • (৪) মারখাম-এর মতে, গির্জার সম্পত্তির উপর নেপোলিয়নের হস্তক্ষেপ স্পেনবাসীকে ক্ষুব্ধ করে। তিনি বলেন যে, স্পেনের প্রতিরোধ ছিল মূলত ধর্মীয় এবং এর সঙ্গে উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না।
  • (৫) আসলে স্পেনে নেপোলিয়নের সীমাহীন দম্ভ এবং চতুর্থ চার্লস ও ফার্দিনান্দকে অপসৃত করে যোসেফকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা স্পেনবাসী মানতে পারে নি।
  • (৬) গ্রান্ট ও টেম্পারলি বলেন যে, ধর্ম ও জাতীয় দম্ভই স্পেনবাসীকে নেপোলিয়নের বিরোধিতা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই মতই যুক্তিযুক্ত।

যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল

নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত জীবন এবং ফ্রান্সের ইতিহাসে উপদ্বীপের যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। নেপোলিয়ন এই যুদ্ধকে ‘স্পেনীয় ক্ষত’ বলে অভিহিত করেছেন, যা তাকে ধ্বংস করেছে। ফিশার বলেন যে, ফরাসি সাম্রাজ্যের সংগঠনে নেপোলিয়নের স্পেনীয় অভিযান প্রথম ফাটল সৃষ্টি করে।

  • (১) ইতিপূর্বে নেপোলিয়ন বিভিন্ন স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, কিন্তু স্পেনে তিনি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ একটি সমগ্র জাতির প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। এটি ছিল তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নতুন এবং অভিনব বিষয়।
  • (২) ঐতিহাসিক ম্যারিয়ট বলেন যে, নেপোলিয়নের কাছে স্পেনীয় বিদ্রোহ ছিল একটি অভিনব বিষয়, যা তিনি কখনোই চিন্তা করতে পারেন নি। এই জাতীয় প্রতিরোধের মুখে নেপোলিয়নের রণকৌশল ব্যর্থ হয়। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে বেলেনের যুদ্ধে ২৩ হাজার ফরাসি সেনা স্পেনীয়দের হাতে বন্দী হয়।
  • (৩) এই যুদ্ধে ফ্রান্সের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়। ১৮০৮ থেকে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নেপোলিয়ন গড়ে ৩ লক্ষ সেনা স্পেনে মোতায়েন করেন। স্পেনের দীর্ঘ ও ব্যয়সাপেক্ষ যুদ্ধে সেনাদলের একটি বিরাট অংশ আটক থাকায় ইউরোপের অন্যত্র তাঁর শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • (৪) এতদিন পর্যন্ত অধিকৃত দেশ থেকে খাদ্য ও অর্থ সংগ্রহ করে সেনাদলের ব্যয়-নির্বাহ করা হত। স্পেনে সে সুযোগ না থাকায় ফ্রান্স থেকে এই অর্থ এনে তা স্পেনে ব্যয় করা হত।
  • (৫) এই যুদ্ধ নেপোলিয়নের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ ফরাসি সেনা নিহত হয় এবং এই যুদ্ধ নেপোলিয়নের অপরাজেয় ভাবমূর্তির উপর প্রবল আঘাত হানে।
  • (৬) স্পেনের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া—সর্বত্র জাগরণ শুরু হয়।

উপসংহার:- গ্রান্ট ও টেম্পারলি বলেন যে, স্পেনীয় যুদ্ধ ছিল একটি দুষ্ট ক্ষত, যা নেপোলিয়নের শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। অধ্যাপক ডেভিড টমসন তাঁর স্পেনীয় অভিযানকে ‘পতনের পথে প্রথম ধাপ’ (‘First step towards ruin’) বলে অভিহিত করেছেন।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “উপদ্বীপের যুদ্ধ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) উপদ্বীপের যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. উপদ্বীপের যুদ্ধ কাকে বলে?

আইবেরীয় উপদ্বীপ অর্থাৎ স্পেন ও পর্তুগালে নেপোলিয়ন বিরোধী গণ অভ্যুত্থান উপদ্বীপের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

২. উপদ্বীপের যুদ্ধের সময়কাল কত?

১৮০৮-১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ।

৩. উপদ্বীপের যুদ্ধকালে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে কোন যুদ্ধে?

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ভিট্টোরিয়ার যুদ্ধে।

৪. নেপোলিয়ন স্পেনের সিংহাসনে কাকে বসিয়েছিলেন?

যোসেফ বোনাপার্ট।

অন্যান্য ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলি

Leave a Comment