এডলফ হিটলারের অস্ট্রিয়া দখল প্রসঙ্গে আনশ্লুস, অস্ট্রিয়ার মানুষের ইচ্ছা, প্রথম উদ্যোগ, সামরিক অভ্যুত্থান, দ্বিতীয় উদ্যোগ, হিটলার-মুসোলিনি ঐক্য, ব্রিটিশ তোষণ নীতি, গণভোট ও অস্ট্রিয়া দখল সম্পর্কে জানবো।
এডলফ হিটলারের অস্ট্রিয়া দখল
ঐতিহাসিক ঘটনা | হিটলারের অস্ট্রিয়া দখল |
সময়কাল | ১০ এপ্রিল, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ |
প্রধান দল | নাৎসি দল |
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা:- হিটলার-এর লক্ষ্য ছিল সমস্ত জার্মান ভাষাভাষী মানুষদের ঐক্যবন্ধ করে একটি তৃতীয় রাইখ গঠন করা। অস্ট্রিয়া হিটলারের জন্মস্থান, তাছাড়া এখানে জার্মান ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। তাই তিনি অস্ট্রিয়া দখলের পক্ষপাতি ছিলেন।
আনশ্লুস
অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মান ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। তাছাড়া হিটলারের জন্মভূমি ছিল অস্ট্রিয়া। এই কারণে তিনি জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তিকরণে প্রবল আগ্রহী ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘মেঁই ক্যাম্ফ’-এও তিনি এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তাঁর এই নীতি ‘আনশ্লুস’ বা নিবিড় মৈত্রী নামে পরিচিত।
অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সংযুক্তিকরণ নিষিদ্ধ
ভার্সাই সন্ধি ও সেন্ট জার্মেইন সন্ধি দ্বারা অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সংযুক্তিকরণ নিষিদ্ধ ছিল। ক্ষমতালাভের পর থেকেই হিটলার অস্ট্রিয়া দখলের চেষ্টা শুরু করেন।
অস্ট্রিয়ার মানুষের ইচ্ছা
তিনি বলেন যে প্রাশিয়ার মন্ত্রী বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে জার্মানি থেকে বহিষ্কৃত করেছেন, কিন্তু তিনি অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে যুক্ত করবেন। অস্ট্রিয়ার বহু মানুষ এই সংযুক্তির পক্ষপাতী ছিলেন।
নাৎসি দলের শাখা
হিটলার অস্ট্রিয়াতে নাৎসি দলের শাখা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দল জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তিকরণের পক্ষে প্রচার চালাতে থাকে। হিটলার নানাভাবে তাদের সাহায্য করতে থাকেন।
প্রথম উদ্যোগ
তাঁর চেষ্টা ছিল অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলার ডলফাসকে হত্যা করে অস্ট্রিয়া দখল করা। ডলফাস জার্মানি ও হিটলারের অস্ট্রিয়ার সংযুক্তির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং ইতালি হিটলারের এই উদ্যোগকে সমর্থন করতে পারে নি। তারা অস্ট্রিয়ার স্বাধীনতা রক্ষার কথা ঘোষণা করে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের সূচনায় হিটলারের এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
সামরিক অভ্যুত্থান
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জুলাই নাৎসিরা অস্ট্রিয়ায় একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। এতে ডলফাস নিহত হন। নাৎসিরা সরকারি অফিস ও বেতারকেন্দ্র দখল করে। শেষ পর্যন্ত সরকারি সেনাবাহিনী এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়।
অস্ট্রিয়ার প্রতি মুসোলিনির সমর্থন
বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ অস্ট্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিটলারের হস্তক্ষেপের নিন্দা করে। ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনি অস্ট্রিয়ার সমর্থনে অস্ট্রিয়া ও ইতালি সীমান্তে সেনাদল পাঠান।
দ্বিতীয় উদ্যোগ
এইভাবে দ্বিতীয়বারও হিটলারের পরিকল্পনা ব্যাহত হয় এবং বেগতিক দেখে তিনি বিদ্রোহের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক অস্বীকার করেন। বহু অস্ট্রিয় নাৎসি জার্মানিতে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়। পরিস্থিতির চাপে হিটলার দু’বছরের জন্য অস্ট্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন।
জার্মান বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা
হিটলারের পোল্যান্ড ও অস্ট্রিয় নীতিতে শংকিত ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুই বার্থ ইউরোপ-এ একটি নাৎসি-বিরোধী জোট গঠনে তৎপর হন। এই ব্যাপারে কিছু করার আগেই তিনি মার্সাই বন্দরে আততায়ীর হাতে নিহত হন। এর ফলে জার্মান-বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়।
হিটলার-মুসোলিনি ঐক্য
হিটলারের অস্ট্রিয়া দখলের অন্যতম অন্তরায় ছিল ইতালি। হিটলার মুসোলিনির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে উদ্যোগী হন। যেমন –
(১) ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ ইতালির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দেয়। হিটলার লিগের নির্দেশ অমান্য করে ইতালিকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকেন। দু’পক্ষের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে।
(২) স্পেনের গৃহযুদ্ধ
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে হিটলার ও মুসোলিনি যৌথভাবে রুশ সাম্যবাদ ও তার সমর্থক স্পেন-এর প্রজাতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কো-কে সাহায্য পাঠান। এইভাবে তাঁদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে।
ব্রিটিশ তোষণ নীতি
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মান রাইখস্ট্যাগে প্রদত্ত এক ভাষণে হিটলার রুশ কমিউনিজনের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ চালান এবং পশ্চিমি গণতন্ত্র-বিশেষ করে ব্রিটেনের প্রশংসা করেন। এতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন খুব খুশি হন এবং প্রচ্ছন্নভাবে জার্মান তোষণ নীতি গ্রহণ করেন।
ব্রিটেনের সমর্থন
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হ্যালিফ্যাক্স হিটলারকে বলেন যে, জার্মানি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভার্সাই সন্ধি পরিবর্তন করলে ব্রিটেনের কোনও আপত্তি নেই। ডানজিগ, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে জামান দাবির প্রতি ব্রিটেনের নৈতিক সমর্থন আছে।
নাৎসি আন্দোলন
ব্রিটেনের সমর্থন হিটলারের মনে প্রবল অনুপ্রেরণা জোগায়। অস্ট্রিয়ার প্রধান প্রধান শহরগুলিতে তিনি নাৎসি দলের আন্দোলন শুরু করেন। অস্ট্রিয় সরকার দমননীতি গ্রহণ করলে হিটলার ক্ষুব্ধ হয়।
হিটলারের চরমপত্র
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি হিটলার অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলার সুশনিগকে তাঁর বাসভবনে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর হাতে এক চরমপত্র তুলে দেন। এই চরমপত্রে বলা হয় যে,
- (১) অস্ট্রিয়া সরকার নাৎসি দলকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেবে।
- (২) অস্ট্রিয়ার নাৎসি নেতা সিয়েস ইনকার্টকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ করতে হবে।
- (৩) অস্ট্রিয়া সরকারের অর্থ দপ্তর ও বৈদেশিক দপ্তরের দায়িত্ব নাৎসিদের হাতে দিতে হবে।
- (৪) সমস্ত নাৎসিদের মুক্তি দিতে হবে।
- (৫) সকল পদচ্যুত নাৎসিকে পুনর্বহাল করতে হবে।
- (৬) এইসব দাবি অমান্য করা হলে জার্মানি অস্ট্রিয়া আক্রমণ করবে।
চরমপত্রের দাবির স্বীকৃতি
অনন্যোপায় সুশনিগ সব দাবিগুলিই মেনে নেন, কিন্তু সিয়েস ইনকার্টকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগে আপত্তি জানান।
গণভোট
দেশে ফিরে এসে সুশনিগ জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি এবং হিটলারের দাবিগুলি নিয়ে একটি গণভোটের ব্যবস্থা করেন। গণভোটের দিন হিটলার এক চরমপত্র পাঠিয়ে গণভোট বন্ধ করার দাবি জানান এবং বলেন যে, এর অন্যথা হলে তিনি অস্ট্রিয়া আক্রমণ করবেন। গণভোট বন্ধ থাকে এবং সুশনিগ পদত্যাগে বাধ্য হন।
অস্ট্রিয়া দখল
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ নাৎসি নেতা সিয়েস ইনকার্ট চ্যান্সেলার পদে নিযুক্ত হন। এর পরেই তিনি অস্ট্রিয়াকে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য হিটলারের কাছে আবেদন জানান। ১২ই মার্চ হিটলার সসৈন্যে ভিয়েনায় প্রবেশ করেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয় এবং গণভোটের নির্দেশ দেওয়া হয়।
অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সংযুক্তি
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ই এপ্রিল একটি কৃত্রিম গণভোটের দ্বারা জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়া যুক্ত হয়। এই গণভোটে সংযুক্তির পক্ষে ৯৯.৭৫% ভোট পড়ে। আসলে ভীতি ও সন্ত্রাসের ফলে বৈধ ভোটাররা ভোট দিতে পারেন নি, যদিও অনেকেই সংযুক্তির পক্ষে ছিলেন। এইভাবে অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সংযুক্তি ঘটে।
ইউরোপীয় শক্তিবর্গের প্রতিক্রিয়া
হিটলারের অস্ট্রিয়া দখল সম্পর্কে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির প্রতিক্রিয়া ছিল বড়োই অদ্ভুত। যেমন –
(১) ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়া
লর্ড হ্যালিফ্যাক্সের মাধ্যমে ব্রিটেন আগেই এই ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিল। সংযুক্তির পরে ব্রিটেন জানায় যে, জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যদি জার্মান ভাষাভাষী মানুষরা ঐক্যবদ্ধ হয়, তাতে আপত্তির কিছু নেই।
(২) মুসোলিনির প্রতিক্রিয়া
হিটলার-বান্ধব মুসোলিনি কোনও আপত্তি করেন নি। তিনি বলেন যে, “তিনি অস্ট্রিয়াকে পাহারা দিয়ে ক্লান্ত। জার্মানির এখন দ্রুত কাজ শেষ করা উচিত।”
(৩) রাশিয়া ও আমেরিকার প্রতিক্রিয়া
সোভিয়েত রাশিয়া এই কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও চেকোশ্লোভাকিয়ার কাছে রাশিয়া একটি প্রস্তাব পাঠিয়ে ভবিষ্যৎ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছু সম্মিলিত কর্মসূচি গ্রহণের কথা বলে। এ ব্যাপারে আমেরিকা নিরুত্তর থাকে, এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।
ফলাফল
এই সংযুক্তিকরণ জার্মানির পক্ষে যথেষ্ট লাভজনক হয়। যেমন –
- (১) একটি রক্তপাতহীন বিজয়ের মাধ্যমে জার্মানি মধ্য দানিয়ুব অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। এই অঞ্চলের সড়ক, রেলপথ ও নদীপথের উপর জার্মানির অবাধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (২) এর ফলে জার্মানির সঙ্গে ইতালি, হাঙ্গেরি ও যুগোশ্লাভিয়ার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। চেকোশ্লোভাকিয়ার বোহেমীয় দুর্গের তিনটি দিক জার্মানির কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
- (৩) অস্ট্রিয়ার খনিজ সম্পদ ও ব্যাঙ্কের আমানত জার্মানির নিয়ন্ত্রণে আসে। জার্মান অর্থনীতির বিকাশে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
উপসংহার:- সবশেষে বলা যায় যে, হিটলারের অস্ট্রিয়া গ্রাস তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এবং তিনি আরও বৃহত্তর সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করতে থাকেন।
(FAQ) এডলফ হিটলারের অস্ট্রিয়া দখল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
অস্ট্রিয়া।
১০ এপ্রিল, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ফ্রাঙ্কো।
নাৎসি দল।