রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি প্রসঙ্গে চুক্তির পটভূমি, চুক্তি স্বাক্ষর, চুক্তির শর্তাবলী, চুক্তির গুরুত্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও চুক্তি ভঙ্গ সম্পর্কে জানবো।

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি

ঐতিহাসিক ঘটনারুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি
সময়কাল২৩ আগস্ট, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে
স্বাক্ষরকারীজার্মানিরাশিয়া
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি

ভূমিকা:- সুচতুর হিটলার উপলব্ধি করেছিলেন যে, পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ইংল্যান্ডফ্রান্স সহজে মেনে নেবে না। এই কারণে একদিকে তিনি যেমন যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন, তেমনি অন্যদিকে সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্থাপনে উদ্যোগী হন।

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির পটভূমি

হিটলারের কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ বা স্ট্যালিনের নাৎসি -বিদ্বেষ কারো অজানা নয়। তা সত্ত্বেও কয়েকটি কারণে দু’পক্ষ কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়। যেমন –

(১) একের পর এক নীতি

জার্মানি উপলব্ধি করেছিল যে, তার পক্ষে একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম দুই সীমান্তে রাশিয়া এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম এই ভুল করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এ পরাজিত হন। এই কারণে তিনি ‘একের পর এক’ নীতি গ্রহণ করেন।

(২) যুদ্ধের পরিধি সীমিতকরণ

তিনি রাশিয়ার মিত্রতা থেকে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে প্রথমে পশ্চিমি দেশগুলিকে পরাস্ত করার নীতি গ্রহণ করেন। এই কারণে জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে যুদ্ধের পরিধিকে সীমিত করতে চেয়েছিল।

(৩) রাশিয়ার স্বার্থ

যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে রাশিয়ার কাঁচামাল জার্মানির প্রয়োজন ছিল। অপরপক্ষে, রাশিয়ারও কিছু স্বার্থ ছিল। যেমন –

  • (ক) ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষের কমিউনিজম বিরোধিতা রাশিয়ার অবিদিত ছিল না। তা সত্ত্বেও রাশিয়া বহুবার তাদের কাছে জার্মানি-বিরোধী একটি জোট গঠনের প্রস্তাব পাঠিয়েও ব্যর্থ হয়। সুতরাং রাশিয়ার পক্ষে এই উপেক্ষার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
  • (খ) রাশিয়া জানত যে, তার উপর জার্মান আক্রমণ হবেই। তাই জার্মানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া জার্মান আক্রমণকে প্রতিহত বা বিলম্বিত করতে চেয়েছিল। রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল চুক্তির সুবাদে প্রাপ্ত সময়ে নিজ শক্তিকে সুসংহত করা।
  • (গ) রাশিয়ার পূর্ব সীমান্তে রুশ-বিরোধী জাপান তখন প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং যে কোনও সময় রাশিয়াকে আক্রমণ করতে পারত। এই অবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম দুই সীমান্তে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করা যথেষ্ট অসুবিধাজনক ছিল।

রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে আগস্ট মধ্যরাতে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি সম্পাদনে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির শর্ত

এই চুক্তির শর্তানুসারে স্থির হয় যে,

  • (১) আগামী দশ বছর জার্মানি ও রাশিয়া পরস্পরকে আক্রমণ করবে না।
  • (২) শান্তিপূর্ণভাবে পারস্পরিক বিবাদ মিটিয়ে নেওয়া হবে এবং
  • (৩) তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা দু’জনের কেউ আক্রান্ত হলে, কেউ-ই সেই তৃতীয় পক্ষকে সাহায্য করবে না।
  • (৪) এই চুক্তির একটি গোপন অংশ ছিল। তাতে স্থির হয় যে, দু’পক্ষ পোল্যান্ডকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে।

টেলরের মন্তব্য

বহু পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক এই চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর বলে অভিহিত করেছেন, কিন্তু অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর বলেন যে, মিউনিখ চুক্তির কর্মকর্তাদের পক্ষে কোনও সমালোচনা শোভা পায় না।

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির গুরুত্ব

এই চুক্তির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –

  • (১) এই চুক্তি ছিল হিটলারের কূটনেতিক দক্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন। এর দ্বারা হিটলার জার্মান-বিরোধী জোট গঠনের সম্ভাবনা দূর করেন এবং আপাতত রাশিয়াকে নিরপেক্ষ রেখে ভবিষ্যতে রাশিয়া আক্রমণের ব্যবস্থা করেন।
  • (২) ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষের নির্বুদ্ধিতায় এই চুক্তি সম্পন্ন হয় এবং জার্মানির হাত শক্ত হয়। পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষ অনায়াসেই শক্তিশালী হতে পারত।
  • (৩) এই চুক্তি হিটলারের হাত শক্ত করে তাঁকে পোল্যান্ড আক্রমণে প্ররোচিত করে। এক্ষেত্রে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। রুশ মিত্রতার ফলে জার্মানিকে একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম দুই সীমান্ত -এ যুদ্ধ করতে হয় নি।
  • (৪) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমনিতেই সংঘটিত হত, কিন্তু এই চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই চুক্তি না হলে যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

২৩শে আগস্ট রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। সদ্য-স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকে। পোল্যান্ডের রক্ষক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ৩রা সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

চুক্তি ভঙ্গ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রাথমিক পরাজয়ের পর হিটলার ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া আক্রমণ করেন।

উপসংহার:- জার্মানির একচ্ছত্র নেতা হিটলারের লক্ষ্য ছিল ইউরোপ-এ জার্মানির সম্প্রসারণ ঘটানো। তাই রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও পরবর্তীতে তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেন।

(FAQ) রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কবে কাদের মধ্যে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়?

২৩ আগস্ট, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও জার্মানি।

২. রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির সময় জার্মানির প্রধান শাসক কে ছিলেন?

হিটলার।

৩. রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারা?

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ।

Leave a Comment