ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণ প্রসঙ্গে গ্ৰন্থের নির্ভরযোগ্যতা, ভারতে আগমন, রাষ্ট্রব্যবস্থার তুলনা, রাজশক্তি বিকাশের ত্রুটি, সম্রাটের তুলনা, সামন্ততন্ত্র, দেশের সম্পত্তির মালিক, অভিজাতদের অবস্থা, বাদশাহের ক্ষমতা ও হিন্দু রাজাদের উপর নির্ভরশীলতা সম্পর্কে জানবো।
ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণ
বিষয় | বার্নিয়ের বিবরণ |
পরিচিতি | ফরাসি পর্যটক |
ভারতে আগমন | ১৬৫৮ খ্রি |
গ্ৰন্থ | The war of succession of 1658 |
ভূমিকা :- বার্নিয়ে ছিলেন পেশায় একজন ফরাসি চিকিৎসক। শাহজাহানের রাজত্বকাল-এ উত্তরাধিকারী দ্বন্দ্বের সময় তিনি ভারতবর্ষ-এ আসেন এবং The war of succession of 1658 নামে এই গ্রন্থটি লেখেন।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের গ্ৰন্থের নির্ভরযোগ্যতা
এই গ্রন্থ ঐতিহাসিকদের কাছে নির্ভরযোগ্য এক ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে এতদিন বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু তিনি পর্যবেক্ষণশক্তির পরিচয় দিলেও, বর্তমানে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে তাঁর গভীর বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সেহেতু ইউরোপীয়দের বিবরণ একদেশদর্শী।
অর্থমন্ত্রীকে লেখা ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের চিঠি
- (১) তাঁর গ্রন্থের একটি সবচেয়ে মূল্যবান অংশ ফ্রান্স-এর অর্থমন্ত্রী নসিয়ে কলেবরকে লেখা একটি চিঠি। সেখানে তিনি ফ্রান্সের একজন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীর কাছে ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা ছবি তুলে ধরেছেন।
- (২) যদিও এখানে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা অনুধাবন করতে তিনি ভুল করেছেন, তা সত্ত্বেও বার্নিয়ের বিবরণ মুঘল যুগের ইতিহাসের ছাত্রদের সম্যক অবহিত থাকা উচিত বলে মনে হয়েছে। তাই তাঁর বিবরণ বিশদভাবে না হলেও, তার কিছু অংশ এখানে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ভারতে আগমন
- (১) বার্নিয়ে ফ্রান্সের থাঁজু প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। বার্নিয়ে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে অর্থাৎ, ঔরঙ্গজেব-এর সিংহাসনে আরোহণের বছরে ভারতবর্ষে এসেছিলেন এবং ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে এদেশ ত্যাগ করেন। তিনি মুঘল অভিজাত দানিসমন্দ ও সম্রাটের চিকিৎসক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
- (২) এমনকি তিনি ঔরঙ্গজেব অসুস্থ হলে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য বেড়াতে লাহোর ও কাশ্মীর যাত্রা করলে, বার্নিয়েও তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তিনি লাহোর ও কাশ্মীরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে রাষ্ট্র ব্যবস্থার তুলনা
বার্নিয়ে তাঁর বিবরণে ইউরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থার তুলনা করে বলেছেন যে, ভারতকে রাষ্ট্র আখ্যা দেওয়া যায় না।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে রাজশক্তি বিকাশের ত্রুটি
ভারতে যথার্থ রাজশক্তির বিকাশের ত্রুটির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, সিংহাসনের উত্তরাধিকার বিষয়ে জ্যেষ্ঠপুত্রের বাস্তবে অধিকার স্বীকৃত না হওয়ায়, কোনো সম্রাটের মৃত্যুর পর সঙ্গে সঙ্গে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য ছিল। যদি কোনো রাজকুমার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের উৎখাত করে ক্ষমতা অধিকার করতে পারলেন তো ভালোই, নতুবা সাম্রাজ্য-এর বিচ্ছিন্নতা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব
বার্নিয়ে মুঘল রাজদরবারের ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। শাহজাহান-এর চার পুত্রকেই যোগ্যতার মানদণ্ডে বিচার করেছেন। ঔরঙ্গজেবের দক্ষতা ও কূটনীতিও বিচার করেছেন।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে সম্রাটের তুলনা
বার্নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের এবং চতুর্দশ লুই-এর সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের তুলনা করেছেন। বার্নিয়ের মতে, ফরাসি সম্রাট একটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন, কিন্তু ভারতের বাদশাহ তা করেন না।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে সামন্ততন্ত্র
- (১) ইউরোপে সামন্ততন্ত্র রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষায় এবং প্রাথমিক গঠনে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, ভারতে সামন্ততন্ত্র তা করতে পারে নি। অর্থাৎ সামন্ততন্ত্র-এর শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়ন সবই অব্যাহত ছিল। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক দিকগুলি ভারতে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয় নি।
- (২) বার্নিয়ের মতে, এই ইতিবাচক দিকগুলির একটা হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা মানুষকে কাজ করতে উৎসাহিত করে, সম্পদ সৃষ্টিতে সাহায্য করে এবং দেশে উৎপাদনের মানসিকতা গড়ে ওঠে। তাঁর মতে, এর ফলে ভারতীয় চরিত্র ছিল একান্তই কর্মবিমুখ ও নৈরাশ্যবাদী।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরনে দেশের সম্পত্তির মালিক
- (১) বার্নিয়ে লিখেছেন, সমগ্র দেশের সম্পত্তির মালিক ছিলেন সম্রাট, অন্য কারও মালিকানা ছিল না। আমির-ওমরাহ্ কেউই সম্পত্তির মালিক নয়, বাদশাহের দেওয়া ধনদৌলতের ওপরই তাঁরা নির্ভরশীল ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁদের সম্পত্তি বাদশাহের কাছেই ফিরে আসে।
- (২) চাষি বা জমিদারের একবিঘা জমির ওপরও মালিকানা ছিল না। বার্নিয়ে লিখেছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা স্বীকৃত না হওয়ায় সামাজিক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়। ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন যে, তাঁদের দেশে সম্রাট ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিলেন না।
- (৩) যদি তাঁরা দেশের ভূ-সম্পত্তির মালিক হতেন, তাহলে দেশে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেত না, ব্যবসা ও কারিগরদের উন্নতি হত না এবং প্যারি, লিয়েঁ ও তুলুঁর মতো সুন্দর শহর গড়ে উঠত না।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে অভিজাতদের অবস্থা
এদেশের অভিজাতরা ইউরোপের লর্ড বা ডিউকদের মতো গড়ে ওঠার সুযোগ পায় নি। এখানকার অভিজাতরা ছিলেন অশিক্ষিত, অনভিজাত ও আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন। বিবেক বলে তাঁদের কোনো পদার্থও নেই।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে বাদশাহের ক্ষমতা
- (১) তাঁর মতে, ঔরঙ্গজেব ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা না থাকার ত্রুটিগুলি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়া ছিল তাঁর পক্ষে অসম্ভব। বার্নিয়ে লিখেছেন, বাদশাহরা প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও, তাঁরা মানসিক দিক থেকে অপরিণত ছিলেন।
- (২) ঔরঙ্গজেব প্রায়ই বলতেন, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যের দুর্গতি ও অবনতির প্রধান কারণ হল রাজকুমারদের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা। বার্নিয়ের মতে, এশিয়ার সম্রাটরা পশুর চেয়েও নির্মম ও নিষ্ঠুর ছিলেন। শাসনকার্যে তাদের কোনো জ্ঞান ছিল না।
- (৩) বিশাল ভারতবর্ষকে তাঁদের পক্ষে শাসন করা সম্ভব ছিল না বলে, তাঁরা স্থানীয় শক্তিগুলির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বাদশাহের কাছে এদের বশ্যতা স্বীকার ছিল একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার মাত্র।
- (৪) কেউ কর দিত, কেউ আবার দিত না, কেউ আবার উলটে আদায় করত। পাঠানরা মুঘলদের মোটেই দেখতে পারত না। বিজাপুরের সুলতান মুঘল সম্রাটকে কর দিত না। গোলকুন্ডার রাজাও তাই। মুঘলদের একমাত্র মিত্র ছিল রাজপুত রানারা।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে হিন্দু রাজাদের উপর নির্ভরশীলতা
- (১) বার্নিয়ে লিখেছেন, মুঘল বাদশাহরা হিন্দু রাজাদের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিলেন। হিন্দুরা দলে থাকার ফলে, পাঠানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হয়। গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের সুলতানরা মুঘলদের বিরোধিতা করলে, শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ওমরাহদের পাঠাতে সাহস করতেন না।
- (২) তখন দেশীয় হিন্দু রাজারাই ছিলেন মুঘলদের ভরসা। পারস্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময়ও পারসিক আমির-ওমরাহরা অস্ত্র ধরতে রাজি হতেন না। এখানেও হিন্দু রাজারাই ছিলেন মুঘলদের ভরসা।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে ভারতবর্ষের দারিদ্র্য
- (১) ভারতবর্ষের দারিদ্র্য বার্নিয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। তিনি বলেছেন, হিন্দুস্তানের বাদশাহকে প্রকৃত অর্থে ধনী বলা যায় না। বাদশাহের কাছ থেকে অভিজাতরা কৌশল করে যে টাকা আদায় করতেন, তা নানা উপলক্ষ্যে ব্যয় করতেন। বিশেষ করে ভোগবিলাসে, ডজন ডজন উপপত্নীর খরচে এবং স্বর্ণালংকার নির্মাণে।
- (২) পৃথিবীতে আর কোথাও ভারতের মতো এত তাল তাল সোনা জমা হয় না। সমাজের ওপরতলা থেকে নীচের তলার সাধারণ মানুষের অলংকার হিসেবে সোনা মজুত করার একটা সাংঘাতিক প্রবণতা বর্তমান।
- (৩) তিনি আরও বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করলে, তা সোনা-রুপোয় পরিবর্তিত করে মাটির তলায় মজুত করে রাখে, আর ভিক্ষুকের মতো বাস করে। এই অস্বাস্থ্যকর অর্থনীতিই দেশকে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে পৌঁছে দেয়।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে জমি বিলি ববস্থা
- (১) বার্নিয়ে জমির বিলি-ব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন যে, ইউরোপ-এ যেসব লর্ড জায়গিরদারি পেয়ে থাকে, তাদের রাজার প্রতি প্রজাদের কতকগুলি দায়িত্ব পালন করতে হত। কিন্তু এখানকার জায়গিরদাররা ছিলেন শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়কারী।
- (২) বাদশাহ তাঁর ভাগ পেয়ে যান এবং সুবাদার, জায়গিরদার, জমিদার ও চৌধুরিরা নির্মম অত্যাচার ও শোষণের দ্বারা কৃষকের সর্বস্ব অপহরণ করে। অনেক সময় তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং চাষের ব্যাপারে তাদের কোনো উৎসাহ থাকে না।
- (৩) বার্নিয়ের মতে, এই কারণেই শুধুমাত্র ভারতের নয়, সমগ্র এশিয়ার দেশগুলির চরম অবনতি ঘটেছে। ভারতের অধিকাংশ নগরের ঘরবাড়ি জীর্ণ।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে শিল্প ও শিক্ষা
- (১) এরপর বার্নিয়ে ভারতের শিল্প, শিক্ষা ও বাণিজ্যের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন যে, ভারতীয়দের মধ্যে কোনো শিল্পবোধ নেই। এখানে শিল্পীদের কোনো মর্যাদা নেই, শিল্প সৃষ্টির কোনো স্বাধীনতা নেই, ধন সঞ্চয়ের অধিকার নেই।
- (২) হিন্দুস্তানে শিক্ষাদীক্ষার কোনো বালাই নেই। কোনো কলেজ বা একাদেমি কল্পনার বাইরে, শিক্ষার কোনো মর্যাদাও এখানে নেই। এখানে বাণিজ্যের কোনো উন্নতি নেই। বণিকদের কোনো স্বাধীনতা ও সম্মান নেই।
- (৩) তিনি লিখেছেন, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্য যে, বাদশাহ চারদিকে নিরক্ষর ও ক্রীতদাস দ্বারা পরিবৃত থাকেন। বিচক্ষণ ব্যক্তির কোনো মর্যাদা নেই। এদের দেশও নেই এবং দেশপ্রেমও নেই। টাকা দিয়ে প্রাদেশিক সুবাদারের পদ কেনা হয়।
পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে আইন
- (১) ইউরোপের মতো ভারতবর্ষে আইনসভা নেই, আদালত নেই, বিচারও নেই। তিনি আরও লিখেছেন, ফ্রান্সের সম্রাটকে আইন মেনে চলতে হয়। প্রজাদের প্রত্যেকের আইন-আদালতের সাহায্য নেওয়ার অধিকার আছে।
- (২) কিন্তু ভারতবর্ষে, তথা সমগ্র এশিয়ায় প্রজাদের কারও এ অধিকার নেই। বার্নিয়ে একথাও লিখেছেন যে, ভারতবর্ষে ‘সামাজিক প্রথা’ বলে কোনো বস্তু নেই।
ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণের ত্রুটি
- (১) ভারত-ইতিহাসে মুঘল শাসকদের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে পরবর্তী অনেক ভারতীয় ও ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের বার্নিয়ের উপরোক্ত বিবরণ গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে। তবে আধুনিক গবেষকগণ অনেক ক্ষেত্রেই বার্নিয়ের বিবরণকে ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে মেনে নিতে পারেন নি।
- (২) ভাবতে অবাক লাগে, বার্নিয়ে কেমন করে এমন অনৈতিহাসিক ও ত্রুটিপূর্ণ মতামত লিপিবদ্ধ করতে পারলেন, কিংবা ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের অবমূল্যায়ন কেন এভাবে করলেন, তার কারণ আমাদের কাছে দুর্বোধ্য।
- (৩) মধ্যযুগীয় বাতাবরণে সহজাত কিছু ত্রুটির কথা তিনি যা লিপিবদ্ধ করেছেন, তা হয়তো যথার্থ। কিন্তু যখন তিনি বলেন, হিন্দুস্তানের বাদশাহরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, নিরক্ষর লোক দ্বারা পরিবৃত, ভারতের শিল্পীদের শিল্পবোধ নেই, শিল্পীদের স্বাধীনতা নেই, শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার কোনো মর্যাদা নেই, বিচার নেই, তখন বার্নিয়ের তথ্যকে বিশ্বাস করা ঐতিহাসিক দিক থেকে কঠিন হয়ে পড়ে।
- (৪) অথচ ফ্রান্সের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, সম্রাটকে সে দেশের আইন মেনে চলতে হত এবং প্রজাদের আদালতের সাহায্য নেওয়ার অধিকার ছিল। অথচ একবারও তিনি উল্লেখ করেন নি যে, ভারতে ‘বাস্তিল দুর্গ’-এর মতো একটি দুর্গও মুঘল সম্রাটদের ছিল না।
- (৫) ভারতবর্ষে যিনি মুঘল রাজবংশের সূচনা করেছিলেন, তিনি তাঁর কালজয়ী আত্মজীবনীমূলক তুজুক-ই-বাবরী গ্রন্থে নিজের পাপপুণ্যের হিসাব দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর কন্যা গুলবদন বেগম হুমায়ুননামা রচনা করে মধ্যযুগের ইতিহাসে যশস্বিনী হয়ে আছেন।
- (৬) জাহাঙ্গির তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী লিখেছেন। শাহজাহান, দারা ও ঔরঙ্গজেব তাঁদের যুগের শিক্ষা-দীক্ষায় যে যথেষ্ট অগ্রসর ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর মহামতি আকবর সেযুগে বিধাতার এক অনন্য সৃষ্টি।
- (৭) স্বভাবতই বলা যায়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির এমন পৃষ্ঠপোষক রাজপরিবার সমগ্র বিশ্বে বিরল। অথচ বার্নিয়ে লিখেছেন, তাদের শিক্ষার অভাব ছিল। বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রতিটি মুঘল সম্রাটই ছিলেন শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসরমান।
- (৮) মুঘল রাজবংশের একমাত্র নিরক্ষর ছিলেন বাদশাহ আকবর। অথচ তিনি সে যুগে তাঁর মানসিক প্রগতিশীলতার এমন ছাপ রেখে গেছেন, যার জন্য তাকে ‘এমন নরপতি ইতিহাসে দুর্লভ’ বলে বিশ্ব ইতিহাসে তুলনা করা যেতে পারে।
- (৯) বর্তমানে সকলেই স্বীকার করেছেন যে, মুঘল রাজবংশ আমাদের ধারাবাহিকভাবে একের পর এক এমন মহৎ শাসক ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা উপহার দিয়েছে, যাদের মহৎ কীর্তি আজও অম্লান হয়ে আছে।
- (১০) একদিকে আগ্রার তাজমহল, দিল্লির জামি মসজিদ ও লালকেল্লা; অন্যদিকে খান-ই- খানানের কবিতা, বীরবলের গল্পগুচ্ছ, তুলসীদাসের রামায়ণ, আবুল ফজল-এর সহজাত প্রতিভা, টোডরমল-এর প্রশাসনিক দক্ষতা সবই মুঘল যুগের গৌরবের প্রতীক।
- (১১) এঁদেরই দানে গড়ে উঠেছে ভারতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। মুঘল সম্রাট আকবরের কাহিনি প্রাচীনকালের মুনিঋষি বা উপকথার নায়কের মতো সত্যই জনসাধারণের মনকে আবিষ্ট করে রাখে।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষিত
ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের মূল্যায়ন করতে বসে, মুঘল যুগের অবদানকে বার্নিয়ের অস্বীকার করার দুর্মতি কেন হল, তা বুঝে ওঠা কষ্টকর। তাহলে কি তিনি প্রাচ্যদেশীয় ঘৃণার মানসিকতা বা বিজাতীয় মনোভাব নিয়ে মুঘল যুগে ভারতবর্ষের অবস্থা পর্যালোচনা করেছিলেন? এটি কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
উপসংহার :- তাঁর অমূল্য ঐতিহাসিক বিবরণের বৈজ্ঞানিক দিকটি নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও বার্নিয়ের বিবরণ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করলে সমকালীন মুঘল ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
(FAQ) ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বিবরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ফরাসি চিকিৎসক।
১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে
ঔরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের বছর।
The war of succession of 1658