আকবরের সামরিক শাসন প্রণালী

মুঘল সম্রাট আকবরের সামরিক শাসন প্রণালী প্রসঙ্গে মনসবদারী প্রথা, অশ্বারোহী বাহিনী, পদাতিক বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী, রণ হস্তি, নৌবাহিনী, শিবির জীবন, স্থায়ী বাহিনী ও সমর বিভাগের ত্রুটি সম্পর্কে জানবো।

মুঘল সম্রাট আকবরের সামরিক শাসন প্রণালী

বিষয়আকবরের সামরিক শাসন প্রণালী
মুঘল বাদশাআকবর
প্রধান বাহিনীঅশ্বারোহী বাহিনী
গোলন্দাজ বাহিনীমীর আতীশ
মুঘল সম্রাট আকবরের সামরিক শাসন প্রণালী

ভূমিকা :- মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই ভারত বিজয় করেছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাঁর যা কৃতিত্ব, তা সামরিক বিজয়েই সীমাবদ্ধ। সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য সুগঠিত সেনাবাহিনীর যে একান্ত প্রয়োজন তা তাঁর পুত্র হুমায়ুন ও পৌত্র আকবর উপলব্ধি করেন।

মনসবদারি প্রথা

বাবর ও হুমায়ুনের সেনাবাহিনী জায়গিরদারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আকবর মুঘলদের একটি বিধিবদ্ধ নিয়মিত সামরিক সংগঠনের জন্য প্রথম মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। মনসবদারি ব্যবস্থায় অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

অশ্বারোহী বাহিনী

অশ্বারোহী বাহিনীই ছিল মুঘলদের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী। আকবর স্বয়ং এই বাহিনীর ওপর নজর দিতেন এবং মনসবদারদের সর্বদাই নির্দিষ্ট সংখ্যক অর্থ ও সৈনিক রাখার জন্য চাপ দেওয়া হত। অশ্বারোহী বাহিনীকে ‘flower of the army’ বলা হয়েছে।

পদাতিক বাহিনী

  • (১) অশ্বারোহী বাহিনীর পরই পদাতিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। তবে পদাতিক বাহিনী সুশিক্ষিত বাহিনী ছিল না। পদাতিক বাহিনীর মধ্যে সৈনিক ছাড়া তিরন্দাজ ও সমরোপকরণ বাহকও ছিল।
  • (২) ‘বন্দুকচি’ ও ‘সমসেরবাজ’কে (তরবারি যোদ্ধা) যুদ্ধ করতে হত। আকবরের সময় প্রায় একলক্ষ তরবারি যোদ্ধা ছিল।

গোলন্দাজ বাহিনী

  • (১) আকবরের সমর বিভাগে গোলন্দাজ বাহিনী উল্লেখযোগ্য ছিল। কিন্তু গোলন্দাজ বাহিনী খুব দক্ষ ছিল না। অথচ বাবরের নেতৃত্বে মুঘলদের ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা কামানের গর্জনেই সম্ভব হয়েছিল।
  • (২) আকবরের সময় ভারী কামানের স্থলে হালকা ধরনের কামান নির্মিত হয় এবং স্থানান্তরিত করার সুবিধার জন্য তা বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। মুঘলরা গোলা ব্যবহারে পারদর্শী ছিল না। সাধারণত রুমিরা (কনস্টান্টিনোপলের অধিবাসী) বা পোর্তুগিজরা গোলন্দাজ বাহিনীতে থাকত। এই বিভাগের যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি হলেন মির আতিশ।

রণহস্তী

আকবরের সামরিক বাহিনীতে উপযুক্ত সংখ্যক রণহস্তী থাকত। মনসবদারদেরও উপযুক্ত সুশিক্ষিত নির্দিষ্ট সংখ্যক রণহস্তী রাখতে হত। হস্তীবাহিনী প্রাচীন ভারতবর্ষের মতো মুঘল যুগেও সৈন্য বিভাগের অন্যতম অঙ্গ ছিল।

নৌবাহিনী

  • (১) মুঘলদের নৌবাহিনী ছিল না বললেই চলে এবং এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতারও অভাব ছিল। পোর্তুগিজদের সঙ্গে আকবরের যে সংঘর্ষ হয়, তাতে মনে হয় আকবর নৌ-শক্তির উপযোগিতা উপলব্ধি করেছিলেন।
  • (২) আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় যে, আকবরের একটি নৌ-বিভাগও ছিল। মালাবার ও ক্যাম্বে অঞ্চলের নাবিকরা নৌ-বিদ্যায় পারদর্শী ছিল।

শিবির জীবন

  • (১) মুঘল সামরিক বিভাগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল শিবির-জীবনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। মুঘলদের মধ্য এশিয়ার যাযাবর জীবনযাত্রা পদ্ধতি থেকেই বোধহয় সামরিক ছাত্রাবাসের রীতি গৃহীত হয়। সৈনিকরা ভ্রাম্যমাণ শিবিরে বাস করত।
  • (২) সম্রাটও স্বয়ং সপারিষদ জেনানা মহল সহ এই শিবিরে বাস করতেন। ফলে মুঘলদের সামরিক ছাত্রাবাস চলমান নগরের মতো ছিল বললেই হয়। সমর দক্ষতা ও সামরিক শৃঙ্খলার দিক দিয়ে এই পদ্ধতি লাভজনক হয়েছিল।
  • (৩) কিন্তু পরিণামে এই বিরাট এবং উপকরণ-বহুল সামরিক জীবন সমর বিভাগের পক্ষে ক্ষতিকর হয়। হালকা মারাঠা বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে মুঘলদের এই ভারবহুল সমর পদ্ধতি কার্যকরী হত না।

স্থায়ী বাহিনী

ব্লকম্যান আকবরের স্থায়ী বাহিনী সুগঠিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন। এই বাহিনী রাজকোষ থেকে মাইনে পেত এবং এর সংখ্যা পঁচিশ হাজারের বেশি ছিল না বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু আধুনিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, পদাতিক ছাড়া এই সংখ্যা তিন লক্ষের কম ছিল না।

দাগ-মাহলি

শুধুমাত্র সামরিক বিভাগের নিয়ম ও নীতি যাতে লঙ্ঘিত না হয়, তা তীক্ষ্ণভাবে দেখার জন্য ‘দাগ-মাহলি’ নামে একটি পৃথক বিভাগ স্থাপন করা হয়েছিল।

স্মিথের অভিমত

ড. স্মিথ আকবরের সামরিক ক্ষমতাকে দুর্বল বলে বর্ণনা করেছেন এবং ইউরোপীয় বাহিনীর সঙ্গে আকবরের সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সেনাবাহিনী দুর্বল নয়

  • (১) পোর্তুগিজদের নৌ-যুদ্ধ ছাড়া সামরিক ক্ষমতা পরীক্ষার কোনো সুযোগ ঘটে নি। সুতরাং, অকারণে আকবরের সামরিক শক্তির মৌলিক দুর্বলতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অনৈতিহাসিকও বটে।
  • (২) বরঞ্চ যে সৈন্যদলের সাহায্যে আকবর প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করেছেন এবং সীমান্তের দুর্ধর্ষ পার্বত্য জাতিগুলিকে পরাজিত করেছেন, তাকে দুর্বল বলা মোটেই সংগত নয়।
  • (৩) তাই জনৈক ঐতিহাসিকের ভাষায় বলা যায়- “The unbroken record of victories of this great ruler is an eloquent testimony to the success of this system”

সমর বিভাগের ত্রুটি

আকবরের মতো বিজেতার সমর বিভাগে যে কিছু ত্রুটি ছিল তা স্বীকার করতেই হবে। কারণ, মুঘল সমর বিভাগ একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না। মহান ব্যক্তিত্ব আকবরের সময় এই ত্রুটিগুলি গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখা না দিলেও পরবর্তীকালে মুঘল বাহিনীকে দুর্বল করেছিল। যেমন –

  • (১) সৈন্যদলের শক্তি সেনাপতি-নির্ভর ছিল। কোনো কারণে সেনাপতির মৃত্যু ঘটলে, তখন যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল।
  • (২) মুঘল সেনাবাহিনী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকায়, সেনাবাহিনীতে ঐক্য ছিল না। উপরন্তু যুদ্ধের ভার একাধিক সেনাপতির ওপর অর্পিত হওয়াতে, রণকৌশলে একনিষ্ঠার অভাব ঘটত।
  • (৩) মুঘল সেনাবাহিনী যখন বাহ্যিক উপকরণসম্ভার নিয়ে শিবির স্থাপন করত, তখন মনে হত যেন একটা চলমান রাজধানী। মুঘল শিবিরে দরবারের যাবতীয় আড়ম্বর থাকত। এমনকি গায়কের দল, হারেম, বাদশাহি কারখানা, চলমান বাজার, সবই থাকত।
  • (৪) এর ফলে মুঘল বাহিনী এক অচলায়তনে পরিণত হয়। তাই ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন মারাঠা আক্রমণের মোকাবিলা করতে পরবর্তীকালে মুঘল বাহিনীকে নাস্তানাবুদ হতে হয়।
  • (৫) সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সামস্য ছিল না। কোনো বিভাগ ছিল খুবই সুসংগঠিত, আবার কোনো কোনো বিভাগ ছিল অসংগঠিত। এর ফলে বাহিনীর মধ্যে একটা অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ছিল।
  • (৬) সৈনিকদের মনসবদারদের মাধ্যমে মাইনে দেওয়ায়, সেনাবাহিনীতে নানা দুর্নীতি প্রবেশ করে।
  • (৭) ইউরোপীয়দের তুলনায় মুঘল গোলন্দাজ বাহিনী ছিল খুবই দুর্বল। মুঘলরা বড়ো কামান ব্যবহার করত। বড়ো কামান যে কার্যকরী নয়, তা অসিরগড় দুর্গ দখলে প্রমাণিত হয়েছিল। যদিও আকবর ছোটো কামান ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন।
  • (৮) কিন্তু বাবরের নেতৃত্বে ‘তুর্কি’ গোলন্দাজ বাহিনী পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ও খানুয়ার যুদ্ধে যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিল পরবর্তীকালে মুঘলদের অনভিজ্ঞতার জন্য গোলন্দাজ বাহিনী কোনো যুদ্ধেই তেমন কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে নি।

উপসংহার :- বহু ত্রুটি সত্ত্বেও আকবর মনসবদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে মধ্যযুগে মুঘল বাহিনীতে ঐক্যের সমুন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের সামরিক শাসন প্রণালী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মনসবদারি প্রথা প্রবর্তন করেন কে?

মুঘল সম্রাট আকবর।

২. মুঘলদের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী কোনটি?

অশ্বারোহী বাহিনী।

৩. আকবরের গোলন্দাজ বিভাগের দায়িত্বে কে ছিলেন?

মীর আতীশ

Leave a Comment