জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রসঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দেশ, আন্দোলনের নেতা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বান্দুং সম্মেলন, বেলগ্রেড সম্মেলন, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রসঙ্গে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বলতে কী বোঝায়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দেশ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে জানব।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন
ঐতিহাসিক ঘটনা | জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন |
জনক | জওহরলাল নেহরু |
বান্দুং সম্মেলন | ১৯৫৫ খ্রি |
বেলগ্রেড সম্মেলন | ১৯৬১ খ্রি |
কায়রো সম্মেলন | ১৯৬৪ খ্রি |
লুসাকা সম্মেলন | ১৯৭০ খ্রি |
কলম্বো সম্মেলন | ১৯৭৬ খ্রি |
ভূমিকা :- বিভিন্ন জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি জোটনিরপেক্ষ নীতি ও আদর্শের প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই দেশগুলির অধিকাংশই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ধনতান্ত্রিক জোট এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে সংঘটিত ঠাণ্ডা লড়াই থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন
বিভিন্ন জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে এবং জোটনিরপেক্ষ নীতি ও আদর্শের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। এই ঘটনা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-alignment Movement বা NAM) নামে পরিচিত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সম্মেলন থেকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় বলে অনেকে মনে করেন। ক্রমে এই আন্দোলনের আরও প্রসার ঘটে।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দেশ
এই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ ছিল, ভারত, মিশর, যুগোশ্লোভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ঘানা, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি।
ইতিহাস খ্যাত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন ভারতের জওহরলাল নেহরু, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, যুগোশ্লোভিয়ার মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ঘানার নক্রূমা প্রমুখ।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাবলি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এবিষয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্যস্বাধীন বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশেষ অগ্ৰণী ভূমিকা নিয়েছিল। যেমন –
(১) জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগ
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের জনক বা উদ্ভাবক বলে মনে করা হয়। তিনি ভারতের স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করেন যে, ভারত সকল জোট ও সামরিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বাইরে থাকবে এবং সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করবে। স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় গণপরিষদ-এও তিনি এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।
(২) পঞ্চশীল নীতি
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারত ও চিন-এর মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘পঞ্চশীল’ নামে যে পাঁচটি নীতি গৃহীত হয় তা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।
(৩) টিটোর ভূমিকা
যুগোশ্লোভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোট থেকে বেরিয়ে এসে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যুগোশ্লাভিয়া সফরে যান এবং ডিসেম্বর মাসে টিটো ভারত সফরে আসেন। তারা উভয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি আস্থা জানান।
(৪) কলম্বো সম্মেলন
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান সম্মিলিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। এখানে এশিয়া ও আফ্রিকার জাতিগুলির স্বার্থের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি এবং তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
(৫) দিল্লি সম্মেলন
এশিয়ার ১৪টি রাষ্ট্র ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে মিলিত হয়। এখানে তারা আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতি, ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবৈষম্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, নিজেদের মধ্যে ঐক্য শক্তিশালী করা প্রভৃতির প্রতিশ্রুতি দেয়।
(৬) বান্দুং সম্মেলন
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের (১৮-২৬ এপ্রিল) বান্দুং সম্মেলনকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। এই সম্মেলনে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশ যোগদান করে। সম্মেলনে বর্ণবৈষম্যের অবসান, ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি, পারমাণবিক অস্ত্র-পরীক্ষা ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
(৭) কায়রো সম্মেলন
জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকে নিয়ে একটি প্রস্তাবিত সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনার জন্য এশিয়া, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার ২১টি দেশ ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে (৫-১২ ডিসেম্বর) মিশরের রাজধানী কায়রোতে মিলিত হয়। এখানে স্থির হয় যে, প্রস্তাবিত সম্মেলনে বিশ্বশান্তি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। কায়রো সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে জোটনিরপেক্ষ নীতির পটভূমি বা ভিত্তি গড়ে ওঠে।
বান্দুং সম্মেলন
১৮-২৬ এপ্রিল, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) উদ্যোক্তা ও মধ্যমণি
এই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ও মধ্যমণি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলি শস্ত্রো মিদযোযো।
(২) সম্মেলনে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ
এই সম্মেলনে যোগদানকারী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ ছিলেন চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই, মিশরের প্রধানমন্ত্রী গামাল আবদেল নাসের প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পশ্চিমি জোটভুক্ত ৬টি দেশ বান্দুং সম্মেলনে যোগদান করে।
(৩) দশশীল নীতি
বান্দুং সম্মেলনে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা হয়। এই নীতিগুলি ‘দশশীল’ নামে পরিচিত। দশশীলের নীতিগুলি হল –
- (i) মৌলিক মানবাধিকার ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ-এর সনদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন,
- (ii) সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার স্বীকৃতি,
- (iii) ছোটো-বড়ো সব বর্ণ ও জাতির সমানাধিকারের স্বীকৃতি,
- (iv) কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা,
- (v) জাতিপুঞ্জের সনদ অনুসারে একক ও যৌথভাবে সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন,
- (vi) যৌথভাবে কোনো বৃহৎ শক্তির প্রতিরক্ষার স্বার্থ রক্ষা এবং এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি না করা,
- (vii) কোনো দেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আগ্রাসনমূলক ক্রিয়াকলাপ বা আগ্রাসনের ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ না করা,
- (viii) শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা, আপস ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সকল বিরোধের মীমাংসা করা,
- (ix) পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা ও সহযোগিতা,
- (x) ন্যায়-নীতি ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার অধিবেশনকালে নেহরু, নাসের, টিটো, সুকর্ণ, নক্রুমা প্রমুখ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃবর্গ জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকে নিয়ে একটি প্রস্তাবিত সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনা করেন।
কায়রোর প্রভৃতি সম্মেলন
প্রস্তাবিত এই সম্মেলনের জন্য কায়রোয় ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে একটি প্রস্তুতি সম্মেলন বসে। এই প্রস্তুতি সম্মেলনে পাঁচটি নীতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই নীতিগুলি হল –
- (১) জোটনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ,
- (২) কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা,
- (৩) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা,
- (৪) বর্ণবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ প্রতিরোধ করা,
- (৫) জাতীয় মুক্তি আন্দোলন-কে সমর্থন করা।
কায়রো সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে বেলগ্রেড সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বেলগ্রেড সম্মেলন
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে (১-৬ সেপ্টেম্বর) যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) যোগদানকারী দেশসমূহ
বেলগ্রেড সম্মেলনে ২৫টি রাষ্ট্র যোগদান করে। যোগদানকারী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, ইথিওপিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, কম্বোডিয়া, কঙ্গো, কিউবা, ঘানা, ব্রহ্মদেশ, লেবানন, সাইপ্রাস, সিংহল প্রভৃতি। এ ছাড়া পরিদর্শক হিসেবে এই সম্মেলনে যোগদান করে ব্রাজিল, বলিভিয়া ও ইকুয়েডর।
(২) নেতৃবৃন্দ
বেলগ্রেড সম্মেলনে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো, মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ, ঘানার রাষ্ট্রপতি নক্রুমা, সিংহলের প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েক প্রমুখ।
(৩) আলোচ্য বিষয়
বেলগ্রেড সম্মেলনে যুদ্ধ, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার, বর্ণবৈষম্য, ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতির বিপক্ষে এবং শান্তি ও সহাবস্থানের সপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
কায়রো সম্মেলন
৫ থেকে ১০ অক্টোবর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কায়রো সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলনে ৪৬ টি দেশ অংশগ্রহণ করে। এখানে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান সুকর্ণ আগ্রাসী নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বললে মতভেদ সৃষ্টি হয়।
লুসাকা সম্মেলন
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৮-১০ সেপ্টেম্বর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের লুসাকা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৫৪ টি দেশ অংশগ্রহণ করে। এখানে উপস্থিত ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়া উপনিবেশবাদের বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করেন।
আলজিয়ার্স সম্মেলন
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির আলজিয়ার্স সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৭৫ টি দেশ অংশগ্রহণ করে। এখানে উপস্থিত কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতি দেখালে গদ্দাফি তার সমালোচনা করেন।
কলম্বো সম্মেলন
১৬ থেকে ১৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির কলম্বো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৮৪ টি দেশ অংশগ্রহণ করে। এখানে উপস্থিত বেশ কিছু দেশ আমেরিকা ও রাশিয়াকে সমর্থন করে।
হাভানা সম্মেলন
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির হাভানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৮৯ টি দেশ যোগদান করে।
নতুন দিল্লি সম্মেলন
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ থেকে ৯ মার্চ জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নতুন দিল্লিতে। এখানে ৯৭ টি দেশ উপস্থিত থাকে। এই সম্মেলনে উপস্থিত ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক প্রচারের উপর গুরুত্ব দেন।
হারারে সম্মেলন
১-৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি মিলিত হয় হারারে শহরে। এই সম্মেলনে ১০১ টি দেশ অংশগ্রহণ করে।
বেলগ্রেড সম্মেলন
১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪-৭ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বেলগ্ৰেড শহরে এখানে ১০২ টি দেশ উপস্থিত থাকে।
জাকার্তা সম্মেলন
১-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির জাকার্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ১০৮ টি দেশ যোগদান করে।
কার্টাজেনা সম্মেলন
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮-২০ অক্টোবর জোটনিরপেক্ষ দেশ গুলির কার্টাজেনা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ১১৩ টি দেশ যোগদান করে।
ডারবান সম্মেলন
২-৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ দেশ গুলি ডারবান শহরে মিলিত হয়। কাশ্মীর সহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হয়।
কুয়ালালামপুর সম্মেলন
২০০৩ সালের ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির কুয়ালালামপুর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের হুমকি, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা হয়।
হাভানা সম্মেলন
২০০৬ খ্রিস্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির হাভানা সম্মেলনে ভারত-পাক সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা নিয়ে আলোচনা হয়।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা
ভারত শুধু জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবর্তকই নয়, সে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন –
(১) সামরিক জোট থেকে দূরত্ব
ভারত সর্বদা দুটি শক্তিশালী সামরিক জোট, যথা – পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক জোট এবং রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক জোট থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
(২) কোরীয় যুদ্ধে ভূমিকা
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে কোরীয় যুদ্ধ-এর পর যুদ্ধবন্দি সংক্রান্ত যে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল তার সমাধানে ভারত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
(৩) ভিয়েতনামের যুদ্ধে ভূমিকা
ইন্দোচিন বা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভারত তার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছে।
(৪) মিশর আক্রমণ প্রতিবাদ
ভারত ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরের ওপর ফরাসি ও ইজরায়েলের আক্রমণের বিরোধিতা করেছে।
(৫) হাঙ্গেরির ঘটনার প্রতিবাদ
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দেই হাঙ্গেরির ঘটনার সময় ভারত সোভিয়েত রাশিয়ারও সমালোচনা করেছে।
(৬) জাতিপুঞ্জে চিনের স্থায়ী আসন লাভের জন্য সমর্থন
চিনের সঙ্গে মিত্রতা থাকার সময় এবং পরবর্তীকালে চিনের সঙ্গে সীমানা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সম্পর্কের অবনতির সময়ও জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে চিনের স্থায়ী আসন লাভের বিষয়টিকে ভারত সমর্থন করেছে।
(৬) পাকিস্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্কের চেষ্টা
ভারত তার প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে সর্বদা আগ্রহী। এ বিষয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পরামর্শ গ্রহণ করতেও ভারত সর্বদাই আগ্রহী।
(৭) সাম্রাজ্যবাদ ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরোধিতা
ভারত সর্বদা সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তাত্ত্বিকভাবে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করলেও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলি তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করতে পারে নি। কিন্তু বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি এবং ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –
(১) পৃথক মঞ্চ
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন দেশগুলি এর দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক জোটের রাজনীতি থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে নিজেরা একটি পৃথক মঞ্চ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
(২) বিশ্বশান্তির প্রয়াস
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে অনেকটা পথ অগ্রসর হয়েছে।
(৩) তৃতীয় বিশ্বের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার পূর্বে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিই বিশ্বরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যই ছিল শেষ কথা। কিন্তু জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের সদ্যস্বাধীন, দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ ও জাতিগুলিকে নিজেদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে।
(৪) ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা
জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পুঁজিবাদী জোট ও সমাজতান্ত্রিক জোটের আগ্রাসন ও তাদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই প্রশমিত করতে পেরেছে। এভাবে এই আন্দোলন বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
উপসংহার :- অনেকের মতে, ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী যুগে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরোধ ও বিভিন্ন স্বার্থ-সমন্বিত চুক্তি।
(FAQ) জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু।
ভারত, মিশর, যুগোশ্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ঘানা প্রভৃতি।
ভারতের জওহরলাল নেহরু, মিশরের নাসের, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ঘানার নক্রুমা প্রমুখ।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১-৬ সেপ্টেম্বর যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড শহরে।
বান্দুং সম্মেলন।