ভারতে নগরায়ণ প্রসঙ্গে নগরায়ণের কারণ, নগরায়ণের বিভিন্ন সময়কাল, ভারতের বিভিন্ন যুগে নগরায়ণ, হরপ্পা সভ্যতার যুগে ভারতে নগরায়ণ, বৈদিক যুগে ভারতের নগরায়ণ, প্রাক মৌর্য যুগের ভারতের নগরায়ণ, মৌর্য যুগে ভারতে নগরায়ণ, মৌর্য পরবর্তী যুগে ভারতে নগরায়ণ, গুপ্তযুগে ভারতে নগরায়ণ, দিল্লি সুলতানি যুগে ভারতের নগরায়ণ ও ভারতে নগরায়ণের প্রভাব সম্পর্কে জানবো।
উপমহাদেশ ভারতে নগরায়ণ প্রসঙ্গে নগরায়ন কী, ভারতে নগরায়ণের কারণ, ভারতের বিভিন্ন যুগে নগরায়ণ, ভারতে হরপ্পা সভ্যতার যুগে প্রথম নগরায়ন, মৌর্য যুগে ভারতে নগরায়ণ, গুপ্তযুগে ভারতে নগরায়ণ ও ভারতে নগরায়ণের প্রভাব সম্পর্কে জানব।
ভারতে নগরায়ণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভারতে নগরায়ণ |
হরপ্পা ও লোথাল | সিন্ধু সভ্যতা |
অহিচ্ছত্র, হস্তিনাপুর | বৈদিক সভ্যতা |
বৈশালী, চম্পা | প্রাক মৌর্য যুগ |
তক্ষশীলা, মথুরা | মৌর্য সাম্রাজ্য |
উজ্জয়িনী, অবন্তী | মৌর্য পরবর্তী যুগ |
বারাণসী, ইন্দ্রপ্রস্থ | গুপ্ত সাম্রাজ্য |
ভূমিকা :- ভারত-এ সভ্যতা বিকাশের প্রথম লগ্নেই নগরায়ণের সূচনা হয়েছিল। আনুমানিক ২৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হরপ্পা সভ্যতায় সর্বপ্রথম নগরায়ণের সূত্রপাত ঘটেছিল। সিন্ধু সভ্যতা ছিল এক উন্নত নগর সভ্যতা। পরবর্তীকালে অবশ্য বহিরাগত আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে এই নগর সভ্যতার পতন ঘটিয়ে গ্রামীণ সভ্যতার প্রসার ঘটায়। প্রথমদিকে আর্যদের প্রধান জীবিকা ছিল পশুলাপন। পরবর্তীকালে তারা কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। পশুপালন ও কৃষির জন্য আর্যদের কাছে গ্রামীণ সমাজই কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু কৃষির অগ্রগতি-সহ অন্যান্য কারণে পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে আবার ভারতে নগরের উদ্ভব ঘটতে থাকে। এরপর ষোড়শ মহাজনপদ-এর সময়কালে, মৌর্য, পরবর্তী মৌর্য, গুপ্ত প্রভৃতি যুগে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও দক্ষিণ ভারতে নগরায়ণের অদ্ভূত অগ্রগতি ঘটে। মধ্যযুগেও ভারতে নগরায়ণের ধারা অব্যাহত থাকে।
ভারতে নগরায়ণের কারণ
প্রাচীন ভারতে নগরের উৎপত্তি ও নগরায়ণের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) জনবসতি বৃদ্ধি
প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন প্রশাসনিক কেন্দ্র, সামরিক ছাউনি, যাতায়াতের কেন্দ্র, শিল্পী ও কারিগরদের বাসস্থান, তীর্থক্ষেত্র প্রভৃতি স্থানগুলিতে জনবসতি ক্রমে বাড়তে থাকে। এভাবে উক্ত স্থানগুলি নগরের রূপ ধারণ করে। ড. রামশরণ শর্মা এই অভিমত সমর্থন করেন।
(২) কৃষিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন
ড. শর্মা ও ড. কোশাম্বী প্রাচীন ভারতে নগরায়ণের ক্ষেত্রে কৃষিতে লোহার লাঙলের ব্যবহারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের মতে, লোহার লাঙল ব্যবহারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয় এবং এর ফলে ব্যাবসাবাণিজ্য ও কারিগরি শিল্পের সূত্রপাত ঘটে। বাণিজ্য ও শিল্পকেন্দ্রগুলিতে জীবিকার প্রয়োজনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সেগুলি ক্রমে শহরে পরিণত হয়।
(৩) রাজনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধি
অমলানন্দ ঘোষের মতে, রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন, মুদ্রার প্রচলন, সেনাবাহিনী গঠন প্রভৃতির মাধ্যমে রাজার আর্থিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এর ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজনৈতিক আধিপত্য ও সংগঠন শক্তিশালী হয় যা উত্তর ভারতে নগরায়ণের পথ প্রস্তুত করে।
(৪) ইক্তা প্রথা
তুর্কি শাসনকালে ইক্তা প্রথা চালু হলে ইক্তার প্রধান কেন্দ্রগুলির গুরুত্ব বেড়ে সেগুলি ক্রমে নগরে পরিণত হয়।
(৫) প্রশাসনিক কেন্দ্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি
এ ছাড়া মধ্যযুগে তুর্কি অভিজাত ও শাসকশ্রেণির বাসস্থান ও প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়ে সেগুলি ক্রমে নগরে পরিণত হয়।
ভারতে নগরায়ণের বিভিন্ন সময়কাল
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে ভারতে নগরায়ণের প্রসার ঘটেছিল। প্রথমদিকে মূলত উত্তর ভারতে নগরের প্রসার ঘটে। পরবর্তীকালে তা দক্ষিণ ভারতেও প্রসারিত হয়। প্রাচীন যুগে ভারতের নগরায়ণ প্রক্রিয়াকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা –
(১) প্রথম পর্যায়
হরপ্পা সভ্যতার যুগ (আনু. ২৩৫০-১৭৫০ খ্রি. পূ.)।
(২) দ্বিতীয় পর্যায়
ষোড়শ মহাজনপদের যুগ থেকে প্রাক-গুপ্ত যুগ (আনু. ৬০০ খ্রি. পূ. – ৩০০ খ্রি.)।
(৩) তৃতীয় পর্যায়
সুলতানি যুগ (১২০৬- ১৫২৬ খ্রি.)।
নগরায়ণের অবক্ষয়ের যুগ
৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে সুলতানি শাসনের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে অনেকে নগরায়ণের অবক্ষয়ের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।
ভারতে বিভিন্ন যুগে নগরায়ণ
বিভিন্ন যুগে ভারতে নগরায়ণের ইতিহাস নীচে আলোচনা করা হল –
(ক) হরপ্পা সভ্যতার যুগে ভারতে নগরায়ণ
- (১) আনুমানিক ২৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে হরপ্পা সভ্যতার সময়কালে সর্বপ্রথম নগরের উদ্ভব হয়। এটি ভারতের প্রথম নগরায়ণ নামে পরিচিত। মোটামুটি ৬০০ বছর স্থায়িত্বের পর আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই নগর সভ্যতার পতন ঘটে।
- (২) এই সময় হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি ছাড়াও রংপুর, বাওয়ালি, রোজানি, কোটদিজি, চানহুদরো প্রভৃতির মতো মাঝারি বা ছোটো মাপের শহরেরও অস্তিত্ব ছিল।
- (৩) এখানকার উন্নত নগর পরিকল্পনা, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, প্রভৃতি প্রশংসনীয়। নগরগুলিতে প্রচুর লোকজন বসবাস করত এবং তারা ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পের কাজে নিযুক্ত ছিল। কোনো পূর্বসূরি সভ্যতার উত্তরাধিকার ছাড়াও হরপ্পা সভ্যতায় নগরায়ণের বিকাশ সত্যিই বিস্ময়কর।
- (৪) খ্যাতনামা ঐতিহাসিক রণবীর চক্রবর্তী মনে করেন যে, বিভিন্ন শ্রেণির বণিক ও কারিগররা হরপ্পা সভ্যতাকে নাগরিক চরিত্র দান করেছিল।
(খ) বৈদিক যুগে ভারতে নগরায়ণ
- (১) হরপ্পা-পরবর্তী বৈদিক সভ্যতার প্রথমদিকে নগরের পরিবর্তে ভারতে গ্রামীণ সভ্যতার প্রসার ঘটে। ঋক বৈদিক যুগ-এ (১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্ব) যাযাবর আর্যদের প্রধান জীবিকা ছিল পশুপালন। পরবর্তী বৈদিক যুগ-এ (১০০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্ব) সপ্তসিন্ধু অঞ্চল থেকে আর্য সভ্যতা ক্রমে গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রসারিত হয়।
- (২) এই সময় আর্যরা নদীর তীরে স্থায়ীভাবে বসবাস ও কৃষিকাজ শুরু করে। ফলে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদন ক্রমে ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশে সহায়তা করে। শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশের ফলে নগর গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে অহিচ্ছত্র, হস্তিনাপুর, কৌশাম্বী প্রভৃতি নগরের উত্থান শুরু হয়।
- (৩) পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘নগর’, ‘নাগরিণ’ প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ আছে। ড. রণবীর চক্রবর্তীর মতে, মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির ব্যাপক বিকাশের পাশাপাশি শিল্পে এবং ব্যাবসাতে অগ্রগতি নগরায়ণের পক্ষে অনুকূল অবস্থার জন্ম দেয়।
(গ) প্রাক-মৌর্য যুগে ভারতে নগরায়ণ
- (১) প্রাক-মৌর্য যুগে (৬০০ খ্রি.পূ. – ৩২৫ খ্রি. পূ.) সারা ভারতে নগরায়ণের প্রসার ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে নগরায়ণের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। একে ভারতের দ্বিতীয় নগরায়ণ বলা যায়। এই সময় বারাণসী, বৈশালী, রাজগৃহ, চম্পা, শ্রাবস্তী, কুশীনগর, পাটলিপুত্র প্রভৃতি নগরের উত্থান ঘটে। প্রতিটি নগরই মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় গড়ে ওঠে।
- (২) সেকালে বৌদ্ধ ধর্ম-এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিভিন্ন নগর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। ‘দীঘনিকায়’ এর মহাপরিনির্বাণসূত্তে গৌতম বুদ্ধ-এর সমসাময়িক ষাটটি নগরের কথা উল্লেখ আছে। অবশ্য এই সব শহরের জীবনযাত্রার মান খুব উন্নত ছিল না। এখানে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনিযুক্ত ঘরবাড়ির প্রাধান্য ছিল।
(ঘ) মৌর্য যুগে ভারতে নগরায়ণ
ভারতে মৌর্য যুগে (৩২৫-১৭৫ খ্রি.পূ.) নগরায়ণের আরও অগ্রগতি ঘটে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পাটলিপুত্রে তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলে পাটলিপুত্র নগরীর সমৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আকারে এবং জনসংখ্যায় এটি ছিল সমকালীন ভারতের সর্ববৃহৎ নগরী। এই সময় উল্লেখযোগ্য অন্যান্য নগরগুলি ছিল কৌশাম্বী, তক্ষশিলা, শ্রাবস্তী, মথুরা, পুষ্কলাবতী প্রভৃতি।
(ঙ) মৌর্য-পরবর্তী যুগে ভারতে নগরায়ণ
- (১) মৌর্য-পরবর্তী যুগে (১৭৫ খ্রি.পূ.- ৩০০ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নগরায়ণের প্রসার ঘটে। পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্যে’ এই যুগের যেসব নগরীর উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলি হল হস্তিনাপুর, পাটলিপুত্র, বারাণসী, কৌশাম্বী, মথুরা, উজ্জয়িনী, অহিচ্ছত্র, অবন্তী, কাঞ্চিপুর, কান্যকুব্জ, কিষ্কিন্ধ্যা, মাহিষ্মতী, নাসিক, সাকেত, সংকিশ্য প্রভৃতি।
- (২) দাক্ষিণাত্যে এই সময় মাদুরা, কাবেরীপট্টনম, আকিয়ামেদু প্রভৃতি নগরের বিকাশ ঘটেছিল। উত্তর ভারতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ-এও এই সময় নগরায়ণে গতি আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বর্তমান চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়।
- (৩) এ ছাড়া বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে এই সময়ের নাগরিক জীবনের সন্ধান মিলেছে। কুষাণ যুগে রোম-ভারত বাণিজ্যের ফলে আর্থিক সমৃদ্ধি, মধ্য এশিয়ায় কুষাণ আধিপত্য প্রভৃতি এই যুগে নগরের অগ্রগতির অন্যতম কারণ ছিল।
(চ) গুপ্ত যুগে ভারতে নগরায়ণ
- (১) গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে নগরায়ণের বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন যে, গুপ্ত যুগ থেকে নগরায়ণের অবক্ষয় শুরু হয়। অবশ্য অবক্ষয় সত্ত্বেও অন্তত ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেশ কিছু নগরের অস্তিত্ব বজায় ছিল। এর পরবর্তীকালে অনেক নগরী পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। লুধিয়ানার সাঙ্গোলে, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, কোশাম্বী, বারাণসী প্রভৃতি নগরে এই চিত্র ধরা পড়ে।
- (২) খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে একাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতে নগরায়ণের চূড়ান্ত অবক্ষয় দেখা দেয়। ঐতিহাসিক ড. রামশরণ শর্মা, বি. এন. যাদব প্রমুখ এই যুগে নগরায়ণের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, কুষাণ সাম্রাজ্য ও সাতবাহন সাম্রাজ্য-এর পতন ঘটলে ভারতীয় ব্যাবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে নগরগুলি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়।
- (৩) খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে শিল্প, বাণিজ্য ও নগরজীবনের অবক্ষয় শুরু হয়। অবশ্য ড. ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ মনে করেন যে, এই যুগে নগরের অবক্ষয় নয়, বরং সমৃদ্ধি ঘটেছিল।
(ছ) সুলতানি যুগে ভারতে নগরায়ণ
- (১) ইতিহাসবিদ মহম্মদ হাবিব মনে করেন যে, ভারতে তুর্কি আক্রমণের পরবর্তীকালে কৃষিক্ষেত্রে বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটে এবং উন্নত অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এর ফলে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে এবং নগরায়ণের সুত্রপাত ঘটে। নগরের এই অগ্রগতিকে মহম্মদ হাবিব ‘নগর বিপ্লব’ আখ্যা দিয়েছেন।
- (২) বড়ো নগরগুলির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ছোটো ছোটো নগরের উদ্ভব ঘটে। সুলতানি যুগে প্রশাসনিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দিল্লি ছিল গুরুত্বপূর্ণ নগর। ইবন বতুতা দিল্লিকে ইসলামি প্রাচ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরী বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দৌলতাবাদ, মুলতান, লাহোর, কারা, লক্ষ্মণাবতী, কাম্বে প্রভৃতি ছিল এসময়ের সুবিখ্যাত নগরী।
- (৩) সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক পাঁচটি শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলি হল ফতেহাবাদ, হিসার, ফিরোজপুর, জৌনপুর ও ফিরোজাবাদ। সামরিককেন্দ্র হিসেবে যে সকল নগরের প্রতিষ্ঠা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দীপালপুর, হানসি, হিসার, ফিরোজা, সিরহিন্দ, ফতেবাদ।
- (৪) রাজস্থানে প্রশাসন ও দুর্গকে কেন্দ্র করে যোধপুর, নাগোর, জারে, পোখরান প্রভৃতি শহর গড়ে ওঠে। রাজস্থানের বাণিজ্যপথগুলির উপর হনুমানগড়, বারমের, মেরতা প্রভৃতি শহর গড়ে ওঠে। এ ছাড়া তীর্থক্ষেত্র হিসেবে বারাণসী, মথুরা প্রভৃতি নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়।
- (৫) এই সময় বাংলাদেশে রামাবতী, গৌড়, পাণ্ডুয়া, নদিয়া, নবদ্বীপ, শান্তিপুর, লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতি, সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী, বিজয়াপুর প্রভৃতি এবং দক্ষিণ ভারতে মিরজান, হোনাভার, ভাতকল, বারকুর, বাসরুর, ম্যাঙ্গালোর, কুম্বলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নগরী গড়ে ওঠে।
ভারতে নগরায়ণের প্রভাব
ভারতে প্রাচীন ও মধ্যযুগে যে নগরায়ণ প্রক্রিয়ার প্রসার ঘটেছিল তার বহুমুখী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
(১) বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা
ভারতের নগরগুলি বণিক, শিল্পী ও কারিগরদের বাসস্থান ও বাণিজ্যিক পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
(২) শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশ
নগরগুলিতে জীবন-জীবিকার সুবিধা থাকায় গ্রাম থেকে বহু দরিদ্র শিল্পী ও কারিগর শহরে চলে আসে। ফলে শহরের শিল্পকারখানায় সস্তায় শ্রমিকের জোগান এবং শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়েছিল।
(৩) মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ
শহরগুলিতে বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার মানুষ পাশাপাশি বসবাস করার ফলে নাগরিক সমাজে এক ধরনের মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বহু বিদেশিও ভারতীয় নগরগুলির সমাজজীবনের সঙ্গে মিশে যায়।
(৪) বর্ণপ্রথায় শিথিলতা
শহরে উচ্চনীচ বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মানুষের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করতে থাকে। তারা ‘মিশ্র জাতি’ হিসেবে পরিচিত হয়। এরা শহরে অন্যদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে ভারতীয় বর্ণপ্রথার বাঁধন ক্রমে শিথিল হতে থাকে।
(৫) অসবর্ণ বিবাহের উদ্ভব
বর্ণপ্রথায় শিথিলতা দেখা দিলে শহরের মানুষের মধ্যে পৃথক বর্ণে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বাধানিষেধের মানসিকতা দূর হয়। এর ফলে শহরে অসবর্ণ বিবাহের প্রচলন ঘটে এবং শহরে সামাজিক উদারতা বৃদ্ধি পায়।
(৬) সাংস্কৃতিক বিকাশ
শহরের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সমাজের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটতে শুরু করে। শহরে শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতির চর্চা এই অগ্রগতিকে সম্ভব করে তোলে।
উপসংহার :- প্রাচীনযুগে যখন কোনো কোনো নগরের অবক্ষয় শুরু হয় তখন পাশাপাশি অন্যান্য অঞ্চলে নতুন নতুন নগরের প্রতিষ্ঠা হতে দেখা যায়। তাই নগরায়ণের মূল স্রোতটি কখনোই একেবারে থেমে থাকেনি। এই নগরগুলি বিভিন্ন যুগে ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।
(FAQ) ভারতে নগরায়ণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
হরপ্পা সভ্যতার সময়।
হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, লোথাল, কালিবঙ্গান।
শ্রাবস্তী, মথুরা, তক্ষশিলা।
বারাণসি, ইন্দ্রপ্রস্থ, কোশাম্বী।
দিল্লি, লাহোর, হিসার, সপ্তগ্ৰাম।