সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বৈদেশিক আক্রণের ফলে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, সামরিক সাহায্য দান সামন্তপ্রথার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে চার্চের অবদান, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে প্রিকারিয়াম ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে প্যাট্রোসিনিয়াম ও কমিটেটাস প্রথা, সামন্ততন্ত্রের উদ্ধবে ফিয়েফ বা ফিউডম, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে রোমান ও জার্মান সংমিশ্রণ, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে বোলাঁভিয়ের অভিমত, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে মন্তেস্কুর অভিমত ও সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে পিরেনের তত্ত্ব সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বৈদেশিক আক্রণের ফলে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে প্রিকারিয়াম ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে প্যাট্রোসিনিয়াম ও কমিটেটাস প্রথা সম্পর্কে জানব।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

ঐতিহাসিক ঘটনাসামন্ততন্ত্রের উদ্ভব
ইউরোপ -এ উদ্ভবপঞ্চম-দশম শতকের মাঝামাঝি
চীন -এ উদ্ভবতৃতীয় শতাব্দী
ভারতবর্ষ -এ উদ্ভবচতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী
আরব -এ উদ্ভবনবম ও দশম শতাব্দী
ফ্রান্স -এ উদ্ভবদশম ও একাদশ শতাব্দী
ইংল্যান্ড -এ উদ্ভবএকাদশ শতাব্দী
সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

ভূমিকা :- Thompson and Johnson লিখিত “An Introduction to Medieval Europe” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রোমান, খ্রিস্টান এবং জার্মান ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ছিল সামন্ততন্ত্র। সমসাময়িক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে নতুন ধরনের নমুনা হিসাবে সামন্ততন্ত্রকে অভিহিত করা যায়।

ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

  • (১)মহাদেশ ইউরোপে সামন্ততন্ত্র-এর উদ্ভব ঘটেছিল আনুমানিক পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে। ইউরোপ ছাড়া অন্যান্য দেশে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব আগেই ঘটেছিল। চীন-এ সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দীতে। ভারতবর্ষ-এ চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল।
  • (২) আরবে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের সময়কাল নবম ও দশম শতাব্দীতে। ফ্রান্স-এ সামন্ততন্ত্রের সময়কাল হিসাবে দশম ও একাদশ শতাব্দীকে চিহ্নিত করা হয়। জার্মানিতে সামন্ততন্ত্রের পরিণতি লক্ষ্য করা যায় দ্বাদশ শতাব্দীতে। ইংল্যাণ্ডে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে।
  • (৩) ১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দে নর্মাণ্ডির ডিউক উইলিয়াম ইংল্যাণ্ডে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। মধ্যযুগের ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্য-এর শেষ দিকে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
  • (৪) শার্লামেন-এর মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য দুর্বল উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত হয়ে গিয়ে ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত হয়ে পড়ায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তা ও বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সামন্ততন্ত্রের উত্থান সম্ভব হয়। তবে একই সময়ে সমস্ত অঞ্চলে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে নি।
  • (৫) প্রাচীনকালে মিশর-এ সামন্ততান্ত্রিক ধারা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। জাপান-এর কৃষি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসাবে ফ্রান্সের নাম করা যায়। শার্লামেনের ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের পতনের পরই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও উত্থান ঘটেছিল।

অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বৈদেশিক আক্রণের ফলে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব

  • (১) সামন্ততন্ত্র মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজব্যবস্থার বিকাশের একটি স্তর। শার্লামেনের মৃত্যুর পরবর্তীকালে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং বৈদেশিক আক্রমণের ফলস্বরূপ সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।
  • (২) বৈদেশিক আক্রমণের মধ্যে আরব মুসলমান বা স্যারাসেনদের আক্রমণ, উত্তর থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বা নরম্যান জলদস্যুদের আক্রমণ, পূর্ব থেকে হাঙ্গেরিয়ান বা ম্যাগিয়ারদের আক্রমণ প্রভৃতি।
  • (৩) এইরকম সংকটজনক বিশৃঙ্খল অবস্থায় সম্রাট ও ভূস্বামীরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের জমি জনসাধারণের কাছে ফিফ হিসাবে প্রদান করে। যারা ফিফ পেয়েছিল তারা লর্ড বা প্রভুদের নিরাপত্তার জন্য সামরিক সাহায্য দেবার জন্য বাধ্য হয়েছিল।
  • (৪) যাদের অল্প জমি ছিল তারা তাদের জমিগুলিকেও ফিফ হিসাবে নিম্নশ্রেণীর ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টন করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত। গীর্জা ও মাঠের জমিও ফিফ হিসাবে বণ্টন করে গীর্জা ও মঠের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হত।

সামরিক সাহায্য দান সামন্তপ্রথার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ

  • (১) এই সামন্ততন্ত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক বিষয়সমূহ। অষ্টম শতাব্দী থেকেই সামন্ততন্ত্রে সামরিক কর্তব্যের দিকটি গুরুত্ব পেয়েছিল। আরব স্যারাসেনরা প্রধানত সুলতান দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে স্পেনীয় মুসলমানরা অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পীরেনিজ পর্বত পার হয়ে গল বা ফ্রাঙ্ক রাজ্যে প্রবেশ করেছিল।
  • (২) কিন্তু মুসলমান বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করবার মত পদাতিক সেনা ফ্রাঙ্ক বাহিনীর ছিল না। মেরোভিঞ্জিয়ান বংশের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের রাজকোষে উপযুক্ত পরিমাণে অর্থ না থাকায় নতুন করে অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তোলা অসম্ভব হয়েছিল।
  • (৩) এইরকম পরিস্থিতিতে মেরোভিঞ্জিয়ান শাসক বা সম্রাটের নির্দেশে প্যালেসের মেয়র চার্লস মর্টেল চার্চের কাছাকাছি জমিগুলো বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, এই জমিগুলোকে এমন অনুপাতে ভূস্বামীদের বিতরণ করা যারা সম্রাটকে বর্ম ও বর্শা সজ্জিত দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী সরবরাহ করতে পারে।
  • (৪) চার্লস মর্টেল এইভাবে অশ্বারোহী সেনা সংগ্রহ করেছিলেন। তার সহায়তায় মুসলমান বাহিনী ফ্রাঙ্ক রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। এরপর থেকেই সম্রাটকে সামরিক সাহায্য দেওয়া ভূস্বামীদের একান্ত পালনীয় কর্তব্যে পরিণত হয়। সামরিক দায়িত্ব পালনের দিকটিও সামন্ততন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে গড়ে উঠেছিল।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে চার্চের অবদান

  • (১) Perry Anderson তাঁর “Passages from Antiquity to Feudalism” গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ও উত্থানের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান চার্চের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টান চার্চ অষ্টম শতাব্দী থেকেই আলাদাভাবে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিল। চার্চও সামন্ততান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।
  • (২) চার্চ নিজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তার জমিগুলিকে ফিফ হিসাবে দান করার ফলে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হঠাৎ করে হয়েছিল এমনটা নয়, সামন্ততন্ত্র ছিল দীর্ঘসময়ের ফসল।
  • (৩) দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যাবার পর সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব বিভিন্ন অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, ইটালী, জার্মানি, স্পেন, স্কটল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশগুলিতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে প্রিকারিয়াম ব্যবস্থা

  • (১) রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ভূমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে ‘প্রিকারিয়াম’ নামক একটি ব্যবস্থা ছিল। এই প্রথায় কৃষকরা ভূস্বামীর কাছে জমির জন্য আবেদন করতে পারত। তারা যে জমি লাভ করত তার কোনো লিখিত চুক্তিপত্র ছিল না। জমির জন্য রাজস্ব দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না। ভূস্বামী মনে করলেই কৃষককে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত।
  • (২) পরবর্তী সময়কালে জমির জন্য রাজস্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। ভূস্বামীকে যদি নিয়মিত রাজস্ব দেওয়া হত তাহলে কৃষক আজীবন জমি ভোগ করতে পারত। সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ‘প্রিকারিয়াম’ নামক রোমান পদ্ধতি ছিল অন্যতম।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ

ঐতিহাসিক F. L. Ganshof দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে “Classical Age of Feudalism” বা “সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ” বলে অভিহিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ এই সময়কালেই ঘটেছিল।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে প্যাট্রোসিনিয়াম ও কমিটেটাস প্রথা

  • (১) রোমান সাম্রাজ্যে ‘প্যাট্রোসিনিয়াম’ নামক এক ধরনের ব্যবস্থা ছিল। ধনী ব্যক্তিরা ক্লায়েন্ট নামক এক ধরনের ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। ক্লায়েন্টরা ধনী ব্যক্তিদের অনুগ্রহভাজন ছিল এবং এর জন্য তারা ধনীদেরকে শ্রমদান করত।
  • (২) জার্মান কমিটেটাস হল প্যাট্রোসিনিয়ামের অনুরূপ শব্দ। রোমান সাম্রাজ্যের শেষদিকে প্যাট্রোসিনিয়াম ব্যবস্থা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ‘প্যাট্রোনেজ প্যাট্রোসিনিয়াম’ প্রথার কথা বলা যায়। মেরোভিঞ্জিয়ান সময়কালে এই প্রথাটি চালু ছিল।
  • (৩) এক্ষেত্রে দেখা যায়, লর্ডদের অনুগতরা তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে লর্ডদের ভূমিদাসে পরিণত হচ্ছে এবং লর্ডদের সামরিক কাজেও এরা অংশগ্রহণ করত। প্রকৃতপক্ষে লর্ডরা ছিল Patronum অর্থাৎ পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের অনুগতরা ছিল ক্লায়েন্ট বা অনুগামী।
  • (৪) ফ্রাঙ্করা পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশ করার পর প্রিকেরিয়াম, প্যাট্রোসিনিয়াম পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। ফ্রাঙ্করা কমিটেটাস নামক প্রথাটির সঙ্গেও পরিচিত ছিল। সামরিক যোদ্ধারা যদি তাদের নেতার অধীনে তাঁর স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন তা ‘কমিটেটাস’ পদ্ধতি হিসাবে অভিহিত হত।
  • (৫) পেরি অ্যান্ডারসনও ‘কমিটেটাস’, প্যাট্রোসিনিয়াম প্রথার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ‘প্যাট্রোসিনিয়াম’ ‘কমিটেটাস’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের উদ্ধবে ফিয়েফ বা ফিউডম

এই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ফিয়েফ বা ফিউডম-এর বিষয়টি এসে পড়ে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে F. L. Ganshof, Elizabeth, A. R. Brown প্রমুখরা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ফিয়েফ বা ফিউডম-কে অপরিহার্য উপাদান বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও প্রায়র এই বিষয়টি নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, ফিয়েফ বা ফিউডম না থাকলেও সামন্ততন্ত্র বা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে কোনো সমস্যা হত না।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে রোমান ও জার্মান সংমিশ্রণ

  • (১) Thompson এবং Johnson-এর বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায় যে, সামন্ততন্ত্র রোমান ও জার্মান সমাজব্যবস্থার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। জার্মানরা রোমান ব্যবস্থা ধ্বংস করে ধ্রুপদী যুগের অবসান ঘটানোর ফলে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করা যায় নি।
  • (২) H. Pirenne “Economic and Social History of Medieval Europe” গ্রন্থে এইরকম ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর মতে, জার্মানরা রোমান সংস্কৃতিকে ধ্বংস নয়, রক্ষাই করেছিল। রোমে জার্মানরা হঠাৎ করে সভ্যতা ধ্বংসের উদ্দেশ্যেই আক্রমণ করে নি। রোমান সাম্রাজ্য তারা ধীরে ধীরে অধিকার করেছিল।
  • (৩) সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব আকস্মিকভাবে না ঘটলেও সামন্ততান্ত্রিক কিছু প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসও সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে সাহায্য করেছিল।

ভূমিকেন্দ্রীক সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে বোলাঁভিয়ের অভিমত

ফরাসি ইতিহাসবিদ বোলাঁভিয়ের সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে তাঁর নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। সামন্ততন্ত্রকে তিনি স্বৈরতন্ত্র এবং বিরোধী নিরাপত্তার স্বীকৃতি স্বাধীনতা ও সম্পত্তি সুরক্ষার হাতিয়ার হিসাবেই দেখেছিলেন। শাসনব্যবস্থাকে বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল বলে তিনি মনে করেছেন। বোলাঁভিয়ের সামন্ততন্ত্রকে “মানবসত্ত্বার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম” বলে অভিহিত করেছিলেন। ভলতেয়ারও বোলাঁভিয়ের-এর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে মন্তেস্কুর অভিমত

  • (১) ফরাসী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য মন্তেস্কু সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে বলেছেন, ইউরোপে বিদেশীদের অভিযানের ফলেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং উত্তর পশ্চিম ইউরোপের বিশৃঙ্খল অবস্থা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে দায়ী ছিল। এর সঙ্গে বিদেশীদের আক্রমণের ফলে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল।
  • (২) এই অবস্থায় নিরাপত্তার জন্য তারা লর্ডদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই ভাবেই মধ্যযুগের ইউরোপে উদ্ভব হয়েছিল সামন্ততন্ত্রের। আসলে জমি বা ফিয়েফ-র সত্ত্বকে কেন্দ্র করে একদিকে সম্রাট অন্যদিকে লর্ড এবং তাদের অধীনস্থ ভ্যাসলদের নিয়ে যে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সাধারণভাবে তাকেই ‘সামন্ততন্ত্র’ বা ‘Feudalism’ বলা হয়।

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে পিরেনের তত্ত্ব

  • (১) বেলজিয়ামের ঐতিহাসিক Henri Pirenne মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা ‘পিরেনের তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। অষ্টম শতকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমানদের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য পশ্চিম ইউরোপের বাণিজ্যের অবলুপ্তি ঘটে এবং মুদ্রা অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ইউরোপ গ্রাম্য কৃষিভিত্তিক সমাজে ফিরে যায় এবং সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
  • (২) কিন্তু হেনরি পিরেনের তত্ত্বের সমালোচনা ও বিরোধীতা করে ডপশক বা ডপস্ বলেছেন, ভূমধ্যসাগরে মুসলিমদের কর্তৃত্ব স্থাপনের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার দ্রুত অবসান হয় নি।

উপসংহার :- বেঞ্জামিন গেরার্ড মনে করেন, সামন্ততন্ত্র হঠাৎ করে গড়ে ওঠে নি। প্রাচীন ব্যবস্থার রূপান্তরের মধ্যে দিয়েই সামন্ততন্ত্র গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়।

(FAQ) সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল কখন?

পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কালে।

২. চীনে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল কখন?

আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দীতে।

৩. ভারতবর্ষে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয় কখন?

চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে।

৪. আরবে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব কখন হয়?

নবম ও দশম শতাব্দীতে।

৫. ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয় কখন?

দশম ও একাদশ শতাব্দীতে।

Leave a Comment