মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে সাম্রাজ্যের বিশালতা, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, দুর্বল উত্তরাধিকার, অভিজাত শ্রেণীর অবক্ষয় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, জায়গিরদারি সংকট, কৃষক বিদ্রোহ, শিল্প বাণিজ্যের বিনাশ, সামরিক দুর্বলতা, জাতীয়তাবোধের অভাব ও ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব সম্পর্কে জানবো।

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ প্রসঙ্গে ঔরঙ্গজেবের আমলে সাম্রাজ্যের পতন, সাম্রাজ্যের বিশালতা, মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বল শাসক, মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বল উত্তরাধিকার নীতি, ঔরঙ্গজেবের বিভিন্ন নীতি, মোগল সাম্রাজ্যের পতনে কৃষক বিদ্রোহের অবদান, সাম্রাজ্যের দুর্নীতি ও মোগল সাম্রাজ্যের পতনে ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব সম্পর্কে জানব।

ভারতের মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনামোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
প্রথম মোগল সম্রাটবাবর
শ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাটআকবর
শেষ মোগল সম্রাটদ্বিতীয় বাহাদুর শাহ
মোগল সাম্রাজ্যের অবসান১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ভূমিকা :- মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে উইলিয়ম আরভিন, স্মিথ, স্যার যদুনাথ সরকার, ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখ প্রাচীন ঐতিহাসিকরা সাম্রাজ্যের বিশালতা, ঔরঙ্গজেব -এর ধর্মনীতি, দাক্ষিণাত্য নীতি, পরবর্তী মোগল সম্রাটদের দুর্বলতা, ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, অভিজাতদের নৈতিক অধঃপতন, সেনাবাহিনীর দুর্বলতা ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রভৃতির কথা বলেন।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট

আধুনিক ঐতিহাসিকরা উপরি উক্ত কারণগুলিকে গুরুত্ব দিলেও, তাঁরা নতুন কিছু কারণের উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, এই সময় মোগল সাম্রাজ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক—এমন কতকগুলি সংকটের মধ্যে পড়েছিল, যা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না।

ইরফান হাবিব, গৌতম ভদ্রের অভিমত

ডঃ সতীশ চন্দ্র, আতাহার আলি, ইরফান হাবিব, মুজাফ্ফর আলম, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মোগল দরবারে দলাদলি, জায়গিরদারি সংকট, কৃষিসংকট ও কৃষক বিদ্রোহ প্রভৃতি কারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

(ক) সাম্রাজ্যের বিশালতা

  • (১) মোগল সাম্রাজ্যের বিশালতা তার পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আকবরের আমলে যে সাম্রাজ্যবাদী নীতির সূচনা হয়, ঔরঙ্গজেবের আমলে তা পরিপূর্ণতা  লাভ করে।
  • (২) ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যই ছিল ভারত ইতিহাসে সর্বপ্রথম বৃহত্তর সাম্রাজ্য। ইতিপূর্বে ভারত ইতিহাসে এত বড় সাম্রাজ্য আর কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার দিনে দিল্লি থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সত্যই খুব দুরূহ ছিল।
  • (৩) এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রায়ই দিল্লির কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করত। দূরবর্তী প্রদেশগুলির এই সব বিদ্রোহ দমন সত্যই খুব কষ্টসাধ্য ছিল।

(খ) উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব

  • (১) মোগলদের কোনও সুস্পষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না। এই কারণে কোনও সম্রাটের মৃত্যু হলে তাঁর সব পুত্রই সিংহাসনের দাবিদার হতেন এবং সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব শুরু হত।
  • (২) তাঁদের লক্ষ্যই ছিল তখত আউর ততা’— হয় সিংহাসন, নতুবা কফিন লাভ। শাহজাহান -এর জীবদ্দশাতেই তাঁর পুত্ররা এই ধরনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব তাঁর সকল ভ্রাতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
  • (৩) ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই ধরনের ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব প্রবল আকার ধারণ করে এবং ১৭০৭ থেকে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র তেরো বছরের মধ্যে ছয় জন সম্রাট সিংহাসনে বসেন।
  • (৪) এঁদের মধ্যে কেবল প্রথম বাহাদুর শাহমহম্মদ শাহ ব্যতীত সকলেই নিহত হন। বিভিন্ন আমির-ওমরাহ ও রাজকর্মচারীরা এই সব দ্বন্দ্বে অংশগ্রহণ করলে অবস্থা জটিলতর হয়ে ওঠে।
  • (৫) বিজয়ী রাজপুত্রের সমর্থক আমির-ওমরাহদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং নতুন বাদশা তাঁদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হতেন।
  • (৬) গৃহযুদ্ধে জয়লাভের পর বাদশা তাঁর সমর্থকদের ঢালাও জায়গির ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতেন। এর ফলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অর্থসংকট দেখা দিত।
  • (৭) গৃহযুদ্ধের ফলে প্রচুর লোকক্ষয় ও ধন সম্পত্তি বিনষ্ট হত। এর ফলাফল রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি।

(গ) দুর্বল উত্তরাধিকার

  • (১) মোগল সাম্রাজ্য স্বৈরাচারী ও সামরিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার সাফল্য বহুলাংশে সম্রাটের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল।
  • (২) ঔরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীদের অধিকাংশই ছিলেন অযোগ্য, অপদার্থ ও বিলাসপ্রিয়। ৬৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে বৃদ্ধ ও বিলাসপ্রিয় বাহাদুর শাহের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না।
  • (৩) পরবর্তী সম্রাট জাহান্দার শাহ সুরা ও নর্তকীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। সম্রাট ফারুখসিয়ার অতি মাত্রায় প্রমোদাসক্ত ছিলেন। মহম্মদ শাহ ছিলেন ‘সর্বপ্রকার বিলাসের প্রতি অনুরক্ত’।
  • (৪) এই সব অলস, অকর্মণ্য ও ব্যভিচারী সম্রাটদের হাতে পড়ে মোগল সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়।
  • (৫) নাদির শাহের আক্রমণের পর মোগল সাম্রাজ্য বস্তুত ‘বহুমূল্য পরিচ্ছদে ভূষিত একটি মৃতদেহ’ (‘a gorgeously dressed corpse) ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।

(ঘ) অভিজাত শ্রেণীর অবক্ষয় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব

  • (১) মোগল যুগের সূচনা-পর্বে অভিজাত সম্প্রদায় ছিলেন সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ। তাঁরা ছিলেন ‘সদা-সচেতন, দক্ষ ও অনুগত’ এবং বহুক্ষেত্রে তাঁরা দুর্বল মোগল সম্রাটদের পরিপূরক হয়ে কাজ করতেন।
  • (২) এই সব অভিজাতদের মধ্যে বৈরাম খাঁ, আবদুর রহিম, মহাবৎ খাঁ, মিরজুমলা, মান সিংহ প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল রাজপরিবারের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে মোগল অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেও চরম অবক্ষয় দেখা দেয়।
  • (৩) স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, অভিজাতদের অবক্ষয়ের জন্যই মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে (“The Empire fell because of the decline of the peerage.”)।
  • (৪) সাম্রাজ্যের মঙ্গলের কথা চিন্তা না করে এই সব স্বার্থান্বেষী অভিজাতরা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলাদলি ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে শুরু করেন। ঔরঙ্গজেবের জীবদ্দশায় দরবারে ইরানি, তুরানি ও হিন্দুস্থানি নামে তিনটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়।
  • (৫) ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত যুদ্ধ শুরু হলে তিন গোষ্ঠীর মধ্যে তৎপরতা শুরু হয় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীর সমর্থনে এগিয়ে আসে।
  • (৬) সম্রাট বাহাদুর শাহ ও জাহান্দার শাহের আমলে ইরানি গোষ্ঠীর নেতা জুলফিকার খাঁ ও আসাদ খাঁ সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং তাঁরাই সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
  • (৭) ফারুখশিয়র দিল্লির সিংহাসনে বসলে সৈয়দ আবদুল্লা খাঁ ও সৈয়দ হোসেন আলির নেতৃত্বে হিন্দুস্থানি গোষ্ঠী সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তুরানি গোষ্ঠীর নেতা আমিন খাঁ ও চিন্ কিলিচ বাঁ তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করেন।
  • (৮) ডঃ সতীশ চন্দ্র বলেন যে, এই ধরনের দলাদলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের পক্ষে শুভ হয় নি। এর ফলে জাতীয় জীবন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অক্ষম হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এবং রাষ্ট্র দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হয়।

(ঙ) অর্থনৈতিক বিপর্যয়

  • (১) অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও মোগল সাম্রাজের পতনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সম্রাট আকবর মোগল সাম্রাজ্যের একটি সুদৃঢ় আর্থিক কাঠামো গঠন করলেও তাঁর উত্তরাধিকারীদের হাতে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
  • (২) দরবারের বিশাল জাঁকজমক, রাজপরিবারের বিলাসিতা, সম্রাটদের স্থাপত্যানুরাগ, অভিজাতবর্গের উচ্চ বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং সেনাদলের বিশাল ব্যয়ভার সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
  • (৩) শাহজাহানের জাঁকজমক ও আড়ম্বরপ্রিয়তার ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেবের সীমাহীন যুদ্ধ মোগল অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। কৃষিকার্য, শিল্প ও বাণিজ্য যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • (৪) ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড বলেন যে, “ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেশ যে দেউলিয়া তা স্পষ্ট হয়ে উঠল।” আর্থিক সংকট মেটাবার জন্য সম্রাট জাহান্দার শাহ সরকারি খাস জমি ইজারা দিতে বাধ্য হন।
  • (৫)পরবর্তীকালেও এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। স্যার যদুনাথ সরকার -এর রচনা থেকে জানা যায় যে, ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে একদা পর পর তিনদিন রাজকীয় রন্ধনশালায় উনুন জ্বালানো সম্ভব হয় নি।
  • (৬) ক্ষুধার জ্বালায় রাজকন্যারা পর্দা উপেক্ষা করে হারেম থেকে বেরিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য, এই ধরনের দেউলিয়া সরকারের পক্ষে কখনোই টিকে থাকা সম্ভব নয়।

(চ) জায়গিরদারি সংকট

  • (১) ডঃ সতীশ চন্দ্র-র মতে, সাম্রাজ্যের পতনে জায়গিরদারি সংকটের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোগল যুগে বহু মনসবদারকে নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গির দেওয়া হত এবং এই জায়গিরদারি ব্যবস্থাই বহুলাংশে মোগল শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল।
  • (২) ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে জায়গিরদারি ব্যবস্থা প্রবল সংকটের সম্মুখীন হয়, যদিও এই সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল জাহাঙ্গীরের আমলেই। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মনসবদারের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়, কিন্তু বন্টনযোগ্য জমির পরিমাণ সে তুলনায় বৃদ্ধি পায় নি।
  • (৩) যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অশান্ত দাক্ষিণাত্য থেকে জায়গিরদাররা কখনোই পুরোপুরি রাজস্ব আদায় করতে পারত না। এই কারণে সকলেই উত্তর ভারতের উর্বর জায়গির পেতে চাইত। বলা বাহুল্য, এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল না।
  • (৪) জায়গির প্রার্থী মনসবদারকে জায়গিরের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত এবং জায়গির পেলেও সর্বদা ‘জমা’ (কাগজে-কলমে দেখানো রাজস্ব) ও ‘হাসিল’ (প্রকৃত আদায়ীকৃত রাজস্ব)-এর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকত না।
  • (৫) এই অবস্থায় জায়গির পাওয়ার জন্য মনসবদারদের মধ্যে দলাদলি চরমে ওঠে, জাতি ও ধর্মের সুপ্ত মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয় এবং অভিজাত সম্প্রদায় থেকে হিন্দুদের বিতাড়নের জিগির তোলা হয়।
  • (৬) জায়গির না পাওয়ায় বা নিম্নমানের জায়গির পেয়ে ‘জমা’ ও ‘হাসিল’-এর মধ্যে সামঞ্জস্য না হওয়ায় সাম্রাজ্যে নানা দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয় এবং এর ফলে সাম্রাজ্যদুর্বল হয়ে পড়ে।

(ছ) কৃষক বিদ্রোহ

  • (১) ডঃ ইরফান হাবিব মনে করেন যে, মোগল যুগে জমিদার ও কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলনই হল মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। এই সময় জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছিল, কিন্তু জায়গিরদারদের আয় বৃদ্ধি পায় নি।
  • (২) জায়গিরের ওপর জয়গিরদারের অধিকার স্থায়ী ছিল না—কয়েক বছরের মধ্যেই তাকে অন্যত্র বদলি করা হত। এই কারণে সব জায়গিরদারই চাইত যতটা বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করতে। এর ফলে অনেকেই যুদ্ধ অপেক্ষা রাজস্ব আদায়েই বেশি মনোযোগী ছিল।
  • (৩) অনেক জায়গিরদার নিজে রাজস্ব আদায় না করে নিলামের মাধ্যমে ইজারাদার-দের হাতে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করত। তাদের কার্যকাল ছিল স্বল্পস্থায়ী। তাই তারা স্বল্প সময়ে অধিক রাজস্ব আদায়ের দিকে নজর দিত। এতে দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচার ও শোষণের মাত্রাই বৃদ্ধি পেত এবং তারা কৃষিকার্য পরিত্যাগ করে পলায়ন করত।
  • (৪) অনেক সময় অত্যাচারিত জমিদার ও কৃষকরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। মোগল যুগের শেষ পর্ব হল জাঠ, শিখ, সংনামী—এই সব কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। এই সব বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের সংহতির মূলে প্রবল আঘাত হানে।

(জ) শিল্প-বাণিজ্যের বিনাশ

  • (১) মোগল যুগে কৃষির অবনতি ঘটলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিকল্প পথ ছিল শিল্প বাণিজ্যের উন্নতি। এদিকে মোগল বাদশাহের বিশেষ নজর ছিল না। রাজপুরুষরা বণিক ও কারিগরদের ওপর নানা ধরনের জুলুম চালাতেন।
  • (২) ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির ফলে শিল্প-বাণিজ্যে মন্দা ভাব দেখা দেয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, শিল্পে উন্নততর আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে অনাগ্রহ এবং বহির্বাণিজ্য ও নৌ-বাণিজ্যের প্রতি উপেক্ষা ভারতীয় -শিল্প-বাণিজ্যকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।
  • (৩) সম্রাট ফারুখশিয়র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিনাশুঙ্কে বাণিজ্যের অধিকার দান করলে রাজকোষে অর্থের টান পড়ে এবং নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব হয়, যা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাকে চরমভাবে বিঘ্নিত করে।

(ঝ) সামরিক দুর্বলতা

  • (১) ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়ম আরভিন বলেন যে, সামরিক দক্ষতার অভাব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একমাত্র কারণ যদি নাও হয়, তবে অন্তত প্রধান কারণ। এর সঙ্গে তুলনা করলে অন্যান্য ত্রুটি বা দুর্বলতার কোনও গুরুত্বই নেই।
  • (২) মোগলদের সামরিক সংগঠন ছিল খুবই ত্রুটিপূর্ণ। তুর্কি, আফগান, রাজপুত এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গঠিত মোগল বাহিনী কখনোই ‘জাতীয় বাহিনী’ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে নি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গঠিত হওয়ায় তাদের মধ্যে কোনও সংহতি গড়ে ওঠে নি এবং তাদের রণকৌশলও ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
  • (৩) যুদ্ধকালে সেনা সরবরাহের জন্য মোগলরা মনসবদারদের ওপর নির্ভর করত। তাই সেনাদের আনুগত্য থাকত নিজ নিজ প্রভু মনসবদারদের প্রতি—সম্রাট বা রাষ্ট্রের প্রতি নয়।
  • (৪) নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনা রাখার শর্তে মনসবদারদের জায়গির দেওয়া হত। অর্থাভাবে বহুক্ষেত্রে তারা কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনা রাখত না এবং যে সব সেনা রাখত তাদের যোগ্যতাও প্রশ্নাতীত ছিল না।
  • (৫) মোগল সেনাবাহিনীর গতি ছিল অতি শ্লথ। হাট-বাজার, হারেম, নর্তকী, বিলাসের সব উপকরণ নিয়ে মোগল সেনাবাি বিশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলত। সেনাবাহিনীতে অসামরিক লোকজনের সংখ্যাধিক্য থাকায় তা একটি বিশৃঙ্খল জনসমষ্টিতে পরিণত হয়, যার পক্ষে কোনওভাবেই দ্রুতগতিসম্প মারাঠাদের মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না।
  • (৬) শিবির জীবনের বিলাসিতায় সেনা নায়কদের চরিত্রবল ও সংগ্রামী মনোভাব বিনষ্ট হয় এবং তাঁরা ‘মসলিনের ঘাঘরা পরিহিত পাণ্ডুর পুরুষ’ (‘pale persons in muslin petticoats’)-এ পরিণত হন। তাঁদের পক্ষে আর সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।
  • (৭) মোগলদের যুদ্ধাস্ত্র, কামান ও রণকৌশল-সবই ছিল পুরোনো ধাঁচের ও নিম্নমানের। ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন যে, মধ্য এশিয়ার স্থলভাগ থেকে আগত মোগলরা নৌশক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে নি। এর ফলে তাঁদের পক্ষে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব হয় নি।

(ঞ) জাতীয়তাবোধের অভাব

  • (১) ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বা দেশপ্রেমের অভাব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
  • (২) সেই যুগে দেশবাসীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠলেও, কোনও প্রকার রাজনৈতিক সংহতি গড়ে ওঠে নি।
  • (৩) মানুষের আনুগত্য ছিল ব্যক্তি, গোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মের প্রতি—দেশের প্রতি নয়। তাই দেশের বিপদে কেউ দেশরক্ষায় অবতীর্ণ। হয় নি।

(ট) ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব

  • (১) মোগল সাম্রাজ্যের পতনে ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতির গুরুত্বকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ইসলামিক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হন।
  • (২) রাজপুত, জাঠ, বুন্দেলা, সৎনামী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনি রাজপুতদেরসহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন।
  • (৩) ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে তাকে তাঁর জীবনের শেষ পঁচিশ বছর দাক্ষিণাত্যে এক অন্তহীন ও নিষ্ফলা যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকতে হয়।
  • (৪) তিনি মারাঠাদের দমনে ব্যর্থ হন এবং রাজধানীতে তাঁর অনুপস্থিতির কারণে সমগ্র উত্তর ভারতে এক চরমতম রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে সাম্রাজ্য দুর্বলতর হয়ে পড়ে।

(ঠ) বৈদেশিক আক্রমণ

জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে নাদির শাহের ভারত আক্রমণ (১৭৩৮-৩৯ খ্রিঃ) এবং আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ (১৭৪৮-৬৭ খ্রিঃ) মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের ওপর চরম আঘাত হানে।

উপসংহার :- বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থতার ফলে মোগল মর্যাদা চরমতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাম্রাজ্যের আর্থিক বনিয়াদ একেবারে ভেঙ্গে পড়ে এবং অভিজাতদের দলাদলি চরম রূপ ধারণ করে। মোগলদের পক্ষে আর ফিরে দাঁড়ানো সম্ভব হয় নি।

(FAQ) মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কে কবে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন?

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বাবর।

২. কোন যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়?

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ-এর মাধ্যমে।

৩. শেষ মোগল সম্রাট কে ছিলেন?

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।

৪. মোগল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে কখন?

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment