নাদির শাহের ভারত আক্রমণ

নাদির শাহের ভারত আক্রমণ -এর কারণ হিসেবে অর্থ লুন্ঠন, কান্দাহার বিবাদ, ভারত আক্রমণে আমন্ত্রণ, মারাঠাদের সাহায্য করা, ধনরত্নের লোভ, ভারত আক্রমণ, যুদ্ধ, মোগলদের পরাজয়, সন্ধি, গুজব, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুন্ঠন এবং নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

নাদির শাহের ভারত আক্রমণ প্রসঙ্গে নাদির শাহের ভারত আক্রমণের সময়কাল, নাদির শাহের ভারত আক্রমণের সময় মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ, নাদির শাহের দিল্লি লুন্ঠন, নাদির শাহের ভারত আক্রমণের কারণ, নাদির শাহের সাথে মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহের যুদ্ধ, নাদির শাহ ও মহম্মদ শাহের সন্ধি ও নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ফলাফল সম্পর্কে জানব।

নাদির শাহের আক্রমণ (১৭৩৮-৩৯ খ্রিঃ)

ঐতিহাসিক ঘটনানাদির শাহের আক্রমণ
সময়কাল১৭৩৮ – ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ
মোগল সম্রাটমহম্মদ শাহ
ফলাফলনাদির শাহের জয়লাভ ও লুঠতরাজ
নাদির শাহের আক্রমণ

ভূমিকা :- পারস্যের এক অতি দরিদ্র পরিবারে নাদির শাহের জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নাদির কুলি খাঁ। বাল্যে তিনি ছিলেন মেষপালক এবং যৌবনে তিনি দস্যুদলের নেতৃত্ব দিতেন।

জার পিটারের পারস্য দখল

অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে পারস্যের সাফাভি বংশ দুর্বল হয়ে পড়লে আফগানরা পারস্য সফল করে (১৭২২ খ্রিঃ)। ঠিক এই সময়েই রাশিয়ার জার মহান পিটার পারস্যের কিছুঅংশ অধিকার করেন (১৭২২ খ্রিঃ)।

পারস্যের সম্রাট কে সহায়তা

পারসিক সম্রাট শাহ তাহমাস্প-এর এই দুর্দিনে দস্যু সর্দার নাদির কুলি তাঁকে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। কৃতজ্ঞতাবশত তাহমাস্প নাদির কুলিকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

নাদির শাহের নিজেকে সম্রাট ঘোষণা

কালক্রমে তিনিই সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং শাহ তাহমাস্প কে অপসারিত করে তাঁর শিশুপুত্রকে নামেমাত্র সিংহাসনে বসিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে এই শিশু-সম্রাটের মৃত্যু হলে তিনি নিজেকে ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন এবং শাহ’ উপাধি ধারণ করেন।

নাদির শাহের ভারত আক্রমণের কারণ

পারস্যের নাদির শাহের ভারত আক্রমণের পশ্চাতে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন –

(১) অর্থ লুন্ঠন

পারস্যের সিংহাসনে বসে তিনি বেশ কিছু অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালান এবং তৎকালীন এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সেনানায়ক হিসেবে অভিহিত হন। এই বিশাল যুদ্ধোদ্যম পরিচালনার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। তিনি ভারত থেকে লুণ্ঠিত অর্থের মাধ্যমে পারস্যের অর্থসংকট মোচনের চিন্তা করেন। এ ব্যাপারে গজনীর সুলতান মামুদ-এর দৃষ্টান্ত তাঁকে অনুপ্রাণিত করে।

(২) কান্দাহার বিবাদ

১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কান্দাহার দখল করেন। কান্দাহারের বিদ্রোহী আফগানরা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি মোগল সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানান এবং ভারতে আফগান অনুপ্রবেশ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে দিল্লিতে দূত পাঠান। দিল্লিশ্বর এ ব্যাপারে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে দূতকে আটকে রাখেন। এর ফলে ক্ষুব্ধ নাদির শাহ ভারত আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

(৩) ভারত আক্রমণে আমন্ত্রণ লাভ

বলা হয় যে, অযোধ্যার সুবাদার সাদাত খাঁ এবং নিজাম-উল্‌-মূলক নাকি নাদির শাহকে ভারত আক্রমণের প্ররোচনা দেন। বলা বাহুল্য, বিষয়টি বিতর্কিত।

(৪) মারাঠাদের সাহায্য

বলা হয় যে, ভারত অভিযানের পূর্বে নাদির শাহ নাকি ঘোষণা করেন যে, হিন্দু মারাঠাদের বিরুদ্ধে মোগলদের রক্ষা করাই তাঁর উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য, হিন্দু মারাঠাদের বিরুদ্ধে মুসলিম সমর্থন লাভের জন্য এটি ছিল নিছক একটি রাজনৈতিক প্রচার।

(৫) ধনরত্নের লোভ

যাই হোক, তিনি যে ধনরত্নের লোভে ভারতে আক্রমণ হানেন সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।

নাদির শাহের ভারত অভিযান

১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে নাদির শাহ আফগানিস্তান আক্রমণ করে কাবুল ও গজনী দখল করেন। এরপর তিনি একরকম বিনা বাধায় পেশোয়ার, লাহোর ও পাঞ্জাব দখল করে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন।

মোগলদের সাথে নাদির শাহের যুদ্ধ

গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও প্রবলতম আর্থিক সংকটে জীর্ণ দিল্লির মসনদে আসীন মহম্মদ শাহ তাঁকে বাধা দেবার জন্য অগ্রসর হন। পানিপথের কুড়ি মাইল উত্তরে কার্নাল নামক স্থানে দু’পক্ষে যুদ্ধ হয় (২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৭৩৯ খ্রিঃ)।

নাদির শাহের কাছে মোগল সম্রাটের পরাজয়

তিন ঘণ্টার কম সময় স্থায়ী এই যুদ্ধে মহম্মদ শাহ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। প্রায় আট হাজার ভারতীয় সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়। পুরোনো ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশল এবং সেনাপতিদের দক্ষতার অভাবই ছিল ভারতীয়দের ব্যর্থতার কারণ।

নাদির শাহ ও মোগল সম্রাটের সন্ধি স্থাপন

পরাজিত মহম্মদ শাহ ৫৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার শর্তে নাদির শাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে নাদির শাহ বাদশাহের সঙ্গে দিল্লিতে প্রবেশ করে (৯ই মার্চ) শাহজাহান-এর সুরম্য প্রাসাদ ‘দেওয়ান-ই-খাস’-এ অবস্থান করছিলেন।

নাদির শাহের মৃত্যুর গুজব

এই সময় নাদির শাহের মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব রটে। দিল্লিবাসী তখন নাদির শাহের সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে প্রায় নয়শ’ সৈন্যকে হত্যা করে। ক্রুদ্ধ নাদির শাহ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দিল্লির অধিবাসীদের হত্যার নির্দেশ দেন।

নাদির শাহের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুন্ঠন

দীর্ঘ সাত ঘন্টা ধরে সেনাবাহিনী দিল্লি নগরীতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও পৈশাচিক অত্যাচার চালায়। শেষ পর্যন্ত, সম্রাট মহম্মদ শাহের কাতর অনুরোধে তিনি ক্ষান্ত হন।

নাদির শাহের ভারত ত্যাগ

১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে তিনি দিল্লি ত্যাগ করেন। সঙ্গে নিয়ে যান প্রায় ৭০ কোটি মুদ্রা, প্রচুর মণি-মাণিক্য, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, দাস-দাসী, দক্ষ কারিগর, শাহজাহান -এর বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন, কোহিনুর মণি এবং ৩০০ হাতি, ১০ হাজার ঘোড়া ও ১০ হাজার উট।

নাদির শাহের সিন্ধু, কাবুল লাভ

মহম্মদ শাহ সিন্ধু, কাবুল ও পশ্চিম পাঞ্জার নাদির শাহকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং লাহোরের মোগল শাসনকর্তা তাকে বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকা কর দিতে স্বীকৃত হন।

পারস্যের নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ফলাফল

নাদির শাহের আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। যেমন –

  • (১) এই আক্রমণ পতনোন্মুখ মোগল সাম্রাজ্যের বুকে চরম আঘাত হানে এবং মোগল সাম্রাজ্যের মহিমা ধূলায় লুণ্ঠিত হয়। তৈমুর বংশের রাজকন্যাকে অজ্ঞাতকুলশীল নাদির শাহের পুত্রের সঙ্গে বিবাহ দিতে বাধ্য করা হয়।
  • (২) প্রজাবর্গের সামনে সাম্রাজ্যের দুর্বলতা ও ক্লীবত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিচ্ছিন্নতা ও বিদ্রোহ দেখা দেয়। সাম্রাজ্যের অভিজাতরা কিছুদিনের জন্য হতচকিত হয়ে পড়েন এবং দিল্লির প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে।
  • (৩) দরবারের অভিজাতরা গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব ও উচ্চপদ লাভের প্রতিযোগিতায় মত্ত হন এবং ‘উজির’ ও ‘মির বক্সী’ পদলাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র রূপ ধারণ করে। নিজাম-উল-মূলক নিজ ভাগ্য পরীক্ষার জন্য দাক্ষিণাত্যে পাড়ি দেন।
  • (৪) সাম্রাজ্যের দুর্বলতা ও অক্ষমতা বিদেশি বণিকদের কাছে ধরা পড়ে এবং এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা নিজ নিজ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিস্তারে সচেষ্ট হয়।
  • (৫) মারাঠা, শিখ প্রভৃতি উদীয়মান শক্তিগুলি উপলব্ধি করে যে, কাবুল-সহ সিন্ধুর পশ্চিমাঞ্চল নাদির শাহের হস্তগত হওয়ায় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং যে কোনও সময় এই পথে বিদেশি আক্রমণ হতে পারে। নিকট ভবিষ্যতে এই পথেই আহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ শুরু হয়।
  • (৬) নাদির শাহের আক্রমণের ফলে মোগল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। বহু নগর ও জনপদ ধ্বংস হয় এবং বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সম্পদ বিদেশে চলে যায়। ডঃ জগদীশ নারায়ণ সরকার বলেন যে, “It was a big drain on the resources of the country.”।
  • (৭) নাদির শাহ অভিজাতদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করেছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত অভিজাতরা ক্ষতিপূরণের জন্য জায়গিরগুলিতে প্রচণ্ড শোষণ চালায়। উচ্চ রাজস্বের বিনিময়ে জায়গিরগুলি ইজারাদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং ইজারাদারদের অত্যাচারে কৃষক কুলের সর্বনাশ হয়।

উপসংহার :- নাদির শাহের আক্রমণ ও অত্যাচারের ফলে দীর্ঘ দিনের ভারত-পারস্য সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়। ভারতে বসবাসকারী ইরানি-তুরানি গোষ্ঠীর মানুষেরা পারস্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারতীয় জনগোষ্ঠীতে মিশে যায়।

(FAQ) নাদির শাহের ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. নাদির শাহ কে ছিলেন?

পারস্যের সম্রাট।

২. নাদির শাহ কখন ভারত আক্রমণ করেন?

১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে।

৩. নাদির শাহের ভারত আক্রমণের সময় মোগল সম্রাট কে ছিলেন?

মহম্মদ শাহ।

৪. ময়ূর সিংহাসন কে পারস্যে নিয়ে যায়?

নাদির শাহ।

Leave a Comment