মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ

মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ প্রসঙ্গে তার সিংহাসনে আরোহণ, সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের ক্ষমতাচ্যুতি, দীর্ঘ শাসনকাল, ব্যতিক্রমী রাজত্বকাল, ভঙ্গুর শাসন ব্যবস্থা, দুর্বলচেতা ও খামখেয়ালীপনা, আমীর ওমরাহদের তৎপরতা, মারাঠাদের আক্রমণ, নাদির শাহর আক্রমণ ও নাদির শাহর প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে জানবো।

মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ

ঐতিহাসিক চরিত্রমহম্মদ শাহ
পরিচিতিমুঘল সম্রাট
রাজত্বকাল১৭১৯-৪৮ খ্রি:
পূর্বসুরিফারুখসিয়র
উত্তরসূরিআহম্মদ শাহ
মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ

ভূমিকা :- ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ফারুখসিয়রকে সিংহাসনচ্যুত করে হত্যা করেন। ফারুখসিয়রের মৃত্যুর পর তারা পরপর দুই রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসালেন। ক্ষয়-রোগে অল্পদিনের মধ্যে এই দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল।

মহম্মদ শাহের সিংহাসনে আরোহণ

এরপর সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় মাত্র আঠার বছরের এক বালক মহম্মদ শাহ কে সিংহাসনে বসান।

সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতের ক্রীড়নক তিন মোগল সম্রাট

ফারুখসিয়রের পরবর্তী তিন জন ‘সম্রাট’ ছিলেন সৈয়দ ভ্রাতাদের হাতের ক্রীড়নক। এঁদের কিছু মাত্র ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল না। নিজেদের ইচ্ছামত লোকজনের সঙ্গে দেখা করা বা কোথাও যাওয়ার স্বাধীনতাও এদের ছিল না।

সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের ক্ষমতাচ্যুতি

১৭১৩ থেকে ১৭২০ খ্ৰিস্টাব্দ পর্যন্ত সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ই ছিলেন রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসনকর্তা। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে এদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।

মহম্মদ শাহের দীর্ঘ শাসনকাল

সম্রাট মহম্মদ শাহের প্রায় ত্রিশ বর্ষব্যাপী (১৭১৯-৪৮ খ্রি) দীর্ঘ শাসনকাল মুঘল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার শেষ সুযোগ এনে দিয়েছিল।

মহম্মদ শাহের ব্যতিক্রমী রাজত্বকাল

১৭০৭-২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজসিংহাসনের অধিকারী পুনঃপুনঃ পরিবর্তিত হয়েছিল, মহম্মদ শাহের রাজত্বকাল ছিল তার ব্যতিক্রম।

মহম্মদ শাহের আমলে মোগল সাম্রাজ্যের মর্যাদাবোধ জাগ্ৰত

সম্রাট মহম্মদ শাহ যখন সিংহাসনে আসীন হলেন তখনও দেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে মুঘল সম্রাট বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী, জনসাধারণের মধ্যে তখনও মুঘল সাম্রাজ্যের মর্যাদাবোধ জাগ্রত ছিল। তখনও মুঘল সৈন্য বাহিনী বিশেষতঃ তার গোলন্দাজ সেনাবাহিনীর শক্তি বেশ প্রবল ছিল।

ভঙ্গুর মোগল শাসন ব্যবস্থা

উত্তর ভারত-এ মুঘল শাসনব্যবস্থার অবনতি হয়েছিল ঠিকই, তবে তখনও তা একেবারে ভেঙ্গে পড়েনি। মারাঠা সর্দারদের যা কিছু পরাক্রম তা তখনও দাক্ষিণাত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, রাজপুত রাজ্যবৃন্দ তখনও মুঘল রাজবংশের প্রতি তাদের আনুগত্য বিসর্জন দেন নি।

পরিস্থিতির অনুপযোগী ব্যক্তি মহম্মদ শাহ

একজন দৃঢ়চেতা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সম্রাট, সাম্রাজ্যের আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে সজাগ একদল পারিষদের সাহায্যে এই সময় সাম্রাজ্যকে অবশ্যই অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু মহম্মদ শাহ এই পরিস্থিতির উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন না।

দুর্বলচেতা ও খামখেয়ালী মহম্মদ শাহ

তিনি দুর্বলচেতা ও খামখেয়ালী ছিলেন। নির্ঝঞ্চাট স্ফূর্তি ও বিলাসময় জীবনযাপনের দিকেই ছিল তাঁর অধিক আকর্ষণ। তিনি রাজকাজেও অবহেলা করতেন।

দক্ষ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মহম্মদ শাহের ষড়যন্ত্র

নিজাম উল মূলকের মত দক্ষ উজীরদের পরিপূর্ণভাবে সমর্থন না করে তিনি কতকগুলি দুর্নীতিপরায়ণ অপদার্থ মোসাহেবের পরামর্শে নিজের দক্ষ মন্ত্রীদের বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দিতেন। এমন কি তার অনুগ্রহভাজন মোসাহেবরা অন্যায় ভাবে যে সব উৎকোচ অর্জন করত, তারও তিনি ভাগ নিতেন।

মহম্মদ শাহের উজিরের সঙ্কল্প

সম্রাটের অস্থিরচিত্ততা ও সন্দিগ্ধ প্রকৃতি এবং রাজদরবারে নিত্য নুতন কলহ কচ কচিতে বিরক্ত হয়ে রাজদরবারে সর্বাধিক প্রভাবশালী নিজাম উল মুলুক তার স্বীয় উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার সঙ্কল্প নিয়েছিলেন।

মহম্মদ শাহের উজিরের সিদ্ধান্ত

১৭২২ খ্রিস্টাব্দে উজীর পদ প্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই শাসনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য নিজাম উল মুলুক আপ্রাণ চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন। সম্রাটের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে সম্রাট ও সাম্রাজ্যের পরিণতি নিয়ে তিনি আর মাথা ঘামাবেন না, যা ঘটার তা ঘটে যাক্, এবার তিনি নিজের ভাগ্য গড়ে তোলায় মন দেবেন।

মহম্মদ শাহের উজিরের পদত্যাগ

১৭২৪ খ্ৰিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে উজীরের পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং হায়দ্রাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই প্রস্থানকে ঐতিহাসিকেরা সাম্রাজ্য থেকে রাজানুগত্য এবং ন্যায়ধর্মের প্রস্থানের প্রতীকরূপে বর্ণনা করে থাকেন। বস্তুতঃ এই সময় থেকেই মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের সূচনা হয়েছিল।

মহম্মদ শাহের সময়ে আমীর ওমরাহদের তৎপরতা

রাজদরবারের অন্যান্য যে সব ক্ষমতাশালী ও উচ্চাভিলাষী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বা ওমরাহ, ছিলেন এখন তাঁরাও নিজেদের জন্য এক একটি আধা স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন।

মহম্মদ শাহের সময়ে বংশানুক্রমিক ‘নবাব’

দেশের নানাস্থানে তখন বেশ কয়েকজন বংশানুক্রমিক ‘নবাব’ গজিয়ে উঠল, মুঘল সম্রাটের প্রতি এদের আনুগত্য ছিল নামে মাত্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ বাংলা, অযোধ্যা, হায়দ্রাবাদ ও পাঞ্জাবের নাম করা যেতে পারে।

মহম্মদ শাহের সময়ে স্বাধীনতার দাবি

দেশের প্রায় সর্বত্র ছোট-খাটো জমিদার, রাজা ও নবাবেরা বিদ্রোহী হয়ে নিজেদের এখন স্বাধীন বলে দাবি তুলতে লাগলেন।

মহম্মদ শাহের সময়ে মারাঠাদের আক্রমণ

এই সময়ে মারাঠা সর্দারেরা দাক্ষিণাত্যের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ না রেখে উত্তরাপথের দিকে অগ্রসর হয়ে মালোয়া, গুজরাট ও বুন্দেলখণ্ড দখল করে নিয়েছিলেন।

মহম্মদ শাহের আমলে নাদির শাহর ভারত আক্রমণ

  • (১) ঠিক এই সময়, ১৭৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করতেই মুঘল সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয়ে গেল। ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে বিনা প্রতিরোধে নাদির শাহ ভারতে প্রবেশ করেন।
  • (২) বহুশত বছর ধরে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। নাদির শাহের বাহিনী লাহোর পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত বিপদের গুরুত্ব কেউই বুঝতে পারেন নি।
  • (৩) এখন দিল্লী রক্ষার জন্য তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হতে লাগল। কিন্তু শত্রু আক্রমণের মুখেও কলহপ্রিয় রাজ-প্রধানেরা একমত হতে পারলেন না। কিভাবে শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করা হবে এবং কে সেনাপতি হবেন এই নিয়ে মতদ্বৈততা দেখা দিল।
  • (৪) অনৈক্য, নেতৃত্ব করার মত ব্যক্তির অভাব, পারস্পরিক ঈর্ষা ও অবিশ্বাসের পরিণাম অনিবার্য পরাজয়। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারী কর্ণালে মুঘল ও নাদির শাহের সৈন্যবাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল। আক্রমণকারী নাদির শাহের পরাক্রমে মুঘল বাহিনী পরাজিত হয়।
  • (৫) সম্রাট মহম্মদ শাহ কে বন্দী করে নাদির শাহ এবার দিল্লী অভিমুখে অগ্রসর হন। নাদির শাহের কয়েকজন সৈন্যকে দিল্লীতে হত্যা করা হয়েছিল, এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাদির শাহের আদেশক্রমে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লীর নাগরিকদের প্রতি অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছিল।
  • (৬) লোভী নাদির শাহ রাজকোষ এবং রাজ পরিবারের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করেই ক্ষান্ত থাকেন নি। দিল্লীর ওমরাহদের কাছ থেকে তিনি প্রচুর ‘নজরানা’ আদায় করেন। দিল্লীর ধনী নাগরিকদের ধনসম্পদও লুণ্ঠিত হয়েছিল।
  • (৭) নাদির শাহ কর্তৃক লুণ্ঠিত ধনসম্পদের মোট অর্থমূল্য দাঁড়িয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ বলে বলীয়ান হয়ে তিনি নাকি তিন বছর তাঁর নিজ রাজত্বের প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় বন্ধ রেখেছিলেন।
  • (৮)  সুবিখ্যাত কোহিনুর হীরক খণ্ড, এবং সম্রাট শাহজাহান-এর মণিমাণিক্য খচিত ময়ূর সিংহাসনও তিনি লুণ্ঠন করে স্বদেশে নিয়ে যান।

নাদির শাহ ও মহম্মদ শাহের মধ্যে সন্ধি

সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরবর্তী সমগ্র ভূভাগ নাদির শাহর অধিকারে থাকবে মহম্মদ শাহকে বাধ্য হয়ে এমনি একটি চুক্তি করতে হয়েছিল।

নাদির শাহর প্রত্যাবর্তন

  • (১) নাদির শাহের বিদায়ের পর সাম্রাজ্য তার হৃতশক্তি কিছুটা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল, যদিও এই পুনরুজ্জীবন সঙ্কীর্ণ এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিছু পরে আবার এই সীমানাও দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে এসেছিল।
  • (২) সুতরাং হৃতশক্তি পুনরুদ্ধার হয়েছে বলে আত্মসন্তুষ্টির মনোভাবের মধ্যে ফাঁকি থেকে গিয়েছিল। রাষ্ট্রের শক্তি বাইরে থেকে যতটা বেড়েছিল মনে হত, আসলে তা বাড়ে নি।

উপসংহার :- ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর ক্ষমতা লিপ্সু বিবেকবর্জিত রাজ্য প্রধানদের মধ্যে তিক্ত বাদ-বিসংবাদ ও সঙ্ঘর্ষের উদ্ভব হয়েছিল।

(FAQ) মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মহম্মদ শাহের রাজত্বকাল কত?

১৭১৯-৪৮ খ্রিস্টাব্দ।

২. কোন মুঘল সম্রাটের রাজত্বকালে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন?

মহম্মদ শাহ।

৩. মহম্মদ শাহের পর কে সিংহাসনে আরোহণ করেন?

আহম্মদ শাহ।

Leave a Comment