মোগল সাম্রাজ্যের পতনে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব হিসেবে তাঁর সন্দেহপ্রবণতা, ধর্মীয় নীতি, রাজপুত নীতি, শিখ বিরোধিতা, দাক্ষিণাত্য নীতি ও আধুনিক মতামত সম্পর্কে জানবো।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | মোগল সাম্রাজ্যের পতনে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব |
ঔরঙ্গজেবের শাসন | ১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ |
জিজিয়া কর প্রবর্তন | ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ |
মৃত্যু | ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ |
উত্তরসূরি | বাহাদুর শাহ |
সূচনা :- স্যার যদুনাথ সরকার, ডঃ শ্রীবাস্তব, স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঔরঙ্গজেবকে নানাভাবে দায়ী করেন। বলা হয় যে, ব্যক্তিগতভাবে দক্ষ ও পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও তিনি এমন কিছু নীতি অবলম্বন করেন যার ফলে মোগল সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
ঔরঙ্গজেবের সন্দেহ প্রবণতা
- (১) এই ব্যাপারে প্রথমেই ঔরঙ্গজেবের সন্দিগ্ধচিত্ততার কথা বলা যায়। তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতেন না-এমনকী নিজ পুত্রদেরও নয়। প্রশাসনের প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজ তিনি নিজে দেখতেন বা পরিচালনা করতেন।
- (২) তাঁর মন্ত্রীরা নিছক করণিক ব্যতীত অন্য কিছু ছিলেন না। বিপদকালে তাঁরা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না—তাঁরা সম্পূর্ণভাবে বাদশার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতেন।
- (৩) তিনি যখন দাক্ষিণাত্যে বিজাপুর-গোলকুণ্ডা ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলেন, তখন সমগ্র উত্তর ভারতের প্রশাসন দুর্বল, অক্ষম, স্থাণু ও জড়বৎ হয়ে পড়ে।
- (৪) তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র বাহাদুর শাহ প্রবীণ বয়সে সিংহাসনে বসলেও তাঁর কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছিল না। এই ব্যাপারে ঔরঙ্গজেব তাঁর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না।
ধর্মীয় নীতি
- (১) ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতিকেও সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করা হয়। সম্রাট আকবর উদার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করে ‘জাতীয় সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন।
- (২) কিন্তু ঔরঙ্গজেবের সিংহাসনারোহণের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ইতিহাসে ধর্মীয় নির্যাতনেরযুগের সূচনা হয় (“The accession of Aurangzeb opened a new era of religious persecution.”)।
- (৩) তিনি হিন্দুদের ওপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। তাদের ওপর “জিজিয়া” সহ নানা প্রকার বৈষম্যমূলক কর আরোপিত হয়। তাঁর নির্দেশে হিন্দু দেব-মন্দিরগুলিও ভাঙ্গা হয়।একমাত্র রাজপুতানায় তিনি প্রায় ২০০টি মন্দির ধ্বংস করেন।
- (৪) কেবলমাত্র হিন্দুরাই নয়-গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ‘জিন্দাপির’ শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরেও নানা প্রকার অত্যাচার চালান। তাঁর এই ভ্রান্ত নীতির ফলে রাজপুত, জাঠ, শিখ, বুন্দেলা, সৎনামী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়। এই বিপ্লবাগ্নি সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে প্রবল আঘাত হানে।
রাজপুত নীতি
- (১) তাঁর রাজপুত নীতিও ছিল অপর একটি মারাত্মক ভুল। আকবর রাজপুতদের প্রতি বন্ধুত্বের নীতি গ্রহণ করে তাদের সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভে পরিণত করেছিলেন। সাম্রাজ্য রক্ষা ও সাম্রাজ্য বিস্তারে রাজপুতদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- (২) ঔরঙ্গজেবের নীতির ফলে তিনি রাজপুতদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। রাজপুতদের সাহায্য পেলে উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ দমন করা হয়তো সহজতর হত।
শিখ বিরোধিতা
তিনি নবম শিখ গুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করে শিখদের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হন। তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে শিখদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বার হয়ে ওঠে এবং পাঞ্জাব স্বাধীন হয়ে যায়।
দাক্ষিণাত্য নীতি
- (১) ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ছিল সাম্রাজ্যের পক্ষে বিপর্যয়কর। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য এবং মারাঠাদের দমনের জন্য তিনি তাঁর জীবনের ২৫টি বছর দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেন।
- (২) মারাঠাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার মেনে নিলেই সমস্যার সমাধান হতে পারত। সেদিকে না গিয়ে তিনি দাক্ষিণাত্যে এক লোকক্ষয়কারী ও বিরামহীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যা সাম্রাজ্যের আর্থিক ও প্রশাসনিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
- (৩) উত্তর ভারতে সম্রাটের দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে সেখানে নানা ধরনের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়। দেশজুড়ে ব্যবসা বাণিজ্য, কর আদায় ও কৃষিকার্য ব্যাহত হয় এবং সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সুতরাং সাম্রাজ্যের পতনে ঔরঙ্গজেব কখনোই তাঁর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না।
আধুনিক মত
- (১) সাম্প্রতিক কালে পার্সিভ্যাল স্পিয়ার, ডঃ সতীশ চন্দ্র, ডঃ আতাহার আলি প্রমুখ ঐতিহাসিক ও গবেষকরা নতুন তথ্যের ভিত্তিতে ভিন্নতর বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন।
- (২) তাঁদের মতে জাঠ, বুন্দেলা, সৎনামী প্রভৃতি বিদ্রোহের পশ্চাতে ধর্মীয় কারণ নয়—অর্থনৈতিক কারণই ছিল মূল। সমগ্র রাজপুতানা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নি–বিদ্রোহ করেছিল মেবার ও মারওয়াড়। বুন্দি, বিকানীর প্রভৃতি বহু রাজ্য ঔরঙ্গজেবের পক্ষে ছিল।
- (৩) এই সব ঐতিহাসিকরা ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতি অপেক্ষা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকটের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁদের মতে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী ছিল সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং সাংগঠনিক ত্রুটি। এই সংগঠন কোনও ব্যক্তিবিশেষের তৈরি নয়—একটি যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে তা গড়ে ওঠে।
উপসংহার :- অর্থনৈতিক সমস্যা, জায়গিরদারি সংকট এবং তার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে অভিজাতদের দলাদলি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়। তাই সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঔরঙ্গজেবকে কখনোই এককভাবে দায়ী করা যায় না।
(FAQ) মোগল সাম্রাজ্যের পতনে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে।
১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে।
নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর।