বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান

বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান প্রসঙ্গে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি, সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বাংলার নতুন যুগের সূচনা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত, প্রথম তিন জন নরপতির যোগ্যতা, উদার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি, হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়, শান্তি ও সমৃদ্ধির সোপান, লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্ব, সাধুসন্তদের ভক্তি, সাহিত্যের অগ্ৰগতি, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, স্থাপত্যের বিকাশ ও শিক্ষার বিকাশ সম্পর্কে জানবো।

বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান

বিষয়বঙ্গদেশের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান
বংশইলিয়াস শাহী বংশ
প্রতিষ্ঠাতাশামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
আদিনা মসজিদসিকান্দার শাহ
গুণরাজ খানমালাধর বসু
বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান

ভূমিকা :- বঙ্গদেশের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল এক গৌরবময় অধ্যায়। দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্য-এর চরম প্রতিপত্তিকালেও বঙ্গদেশের উপর দিল্লির সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি।

দিল্লি সুলতানির শাসনাধীন বাংলা

বাংলার শাসকগণ দিল্লি থেকে বাংলাদেশ-এর দূরত্ব এবং অফুরন্ত সম্পদের জন্য প্রায়ই দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। কখনও সফল, কখনও বিফল হয়েছে। তবে ইলিয়াস শাহী বংশের লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গদেশ দিল্লি সুলতানির শাসনাধীন ছিল বলা যায়।

দিল্লির আধিপত্য মুক্ত বাংলা

এন. বি. রায়ের ভাষায় বলা যায়, লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে ইলিয়াস শাহী বংশের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে “opened a new chapter in the history of Bengal.” প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াস শাহের শাসনকাল থেকে বঙ্গদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত, বঙ্গদেশ দিল্লির আধিপত্য থেকে মুক্ত ছিল।

ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি

  • (১) ইলিয়াস শাহের শাসনকালে বঙ্গদেশে এক স্বাধীন সুলতানির সূচনা করে। বঙ্গদেশে স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অনেকেই শুরু করেছিলেন, কিন্তু দিল্লির হস্তক্ষেপে তা সাফল্যমণ্ডিত হয় নি। কিন্তু ইলিয়াস শাহী বংশই বঙ্গদেশে এক স্বাধীন সুলতানির প্রতিষ্ঠা করে।
  • (২) ইলিয়াস শাহী বংশের প্রায় সত্তর বছরের শাসনকালে বঙ্গদেশে প্রথম এক স্বাধীন সুলতানি প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, তা শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহই সর্বপ্রথম সাফল্যমণ্ডিত করেন।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন

বঙ্গদেশে ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালে যে শান্তি ও সমৃদ্ধির অগ্রগতির সূচনা হয়, তার ফলে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বঙ্গদেশে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

বাংলাকে দিল্লির অধীনস্থ করার চেষ্টা

বঙ্গদেশ দিল্লির সুলতানদের প্রত্যেকেরই মাথাব্যথার কারণ ছিল। বঙ্গদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব দিল্লি সুলতানির কাছে চরম মর্যাদাহানিকর বলে বিবেচিত হত। তাই নানাভাবে বঙ্গদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করার চেষ্টা কুতুবউদ্দিন আইবক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক পর্যন্ত সকলেই করেছেন।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে বাংলার তিন বিভাগ

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশ কার্যত স্বাধীন সুলতানির অধীনস্থ হয়। ইলিয়াস শাহী বংশের পূর্বে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বঙ্গদেশকে তিনভাগে ভাগ করে শাসন করার ব্যবস্থা করেন।
  • (২) এই তিন বিভাগের রাজধানী ছিল লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও। এই তিন বিভাগে পৃথক শাসনকর্তা দিল্লি কর্তৃক নিযুক্ত ছিল। মহম্মদ বিন তুঘলকও এই তিন বিভাগে নতুন শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

দিল্লি সুলতানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা

এই নতুন ব্যবস্থা যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল, তা সফল হয় নি। কারণ, মহম্মদ তুঘলক কর্তৃক নিযুক্ত সোনারগাঁও-এর শাসক গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি অবশ্য সফল হন নি। তাঁর পরবর্তী শাসকগণও যে সফল হয়েছিলেন, তা বলা যায় না।

বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের উত্থান

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের উত্থানের ফলে বঙ্গদেশে একদিকে যেমন লক্ষ্মণাবতীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, অপরদিকে তেমনি তার সামরিক গৌরব প্রতিবেশী রাজ্যেও প্রতিষ্ঠিত হয়। মহম্মদ তুঘলকের কার্যকলাপে সমগ্র উত্তর ভারতে তখন ব্যাপক অব্যবস্থা দেখা দেয়।
  • (২) ইলিয়াস শাহ এই সুযোগে সোনারগাঁও দখল করেন এবং এর পর উড়িষ্যা, ত্রিহুত এবং বেনারস (বারাণসী)থেকে কর আদায় করেন। ত্রিহুত ও নেপাল অভিযানের সাফল্য, ইলিয়াস শাহকে দিল্লি দখলের অনুপ্রেরণা জোগায় বলে যদুনাথ সরকার মনে করেন।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে ফিরোজ তুঘলকের বাংলা আক্রমণ

এরপর ফিরোজ শাহ তুঘলক স্বয়ং বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন। ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দিল্লির সঙ্গে সংঘর্ষে কে বিজয়ী হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সমসাময়িক ঐতিহাসিক আফিফ যাই বলুন, ইলিয়াস বঙ্গদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব যে-কোনো ভাবে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা নিশ্চিত।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে বাংলায় নতুন যুগের সূচনা

তাঁর পুত্র সিকন্দারও বঙ্গদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষা করতে সমর্থ হন। প্রখর রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ইলিয়াস শাহী বংশ বঙ্গদেশের সীমান্তকে তার প্রাকৃতিক সীমান্তরেখায় স্থাপন করেন। সমগ্র বঙ্গদেশে ইলিয়াস শাহী বংশের স্বাধীনভাবে আধিপত্য স্থাপন বঙ্গদেশের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে।

বাংলায় ইলিয়াস শাহী শাসনে সাহিত্য ও সংস্কৃতির রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত

রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশে শিল্প, স্থাপত্য ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন লক্ষ্মণাবতীতে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির রুদ্ধদ্বার অর্গলমুক্ত হয়।

ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম তিন জন নরপতির যোগ্যতা

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এই যে, এই বংশের প্রথম তিনজন নরপতিই অত্যন্ত যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। ইলিয়াস শাহ ও সিকন্দার শাহ বঙ্গদেশের স্বাধীনতা ও ঐক্য রক্ষায় চরম দক্ষতার পরিচয় দেন এবং বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক জগৎকেও উদ্ভাসিত করেন।
  • (২) সিকন্দারের পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজমও তাঁর লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও ন্যায়পরায়ণতার দ্বারা বঙ্গদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নব যুগের সূচনা করেন।

ইলিয়াস শাহী শাসকদের উদার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকগণ ন্যায়পরায়ণ, উদার ও যোগ্য শাসক ছিলেন। তাঁদের শাসনকালেই বঙ্গদেশে এক উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
  • (২) ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকগণ উদার লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্বের জোরে দিল্লি সুলতানির বিরুদ্ধে সংগ্রামে হিন্দুদেরও ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ইলিয়াস শাহী বংশের সেনাদলে হিন্দু পাইক সেনাদের বীরত্বের খ্যাতি ছিল।

বাংলায় ইলিয়াস শাহী শাসনকালে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়

এদেরই শাসনকালে হিন্দু-মুসলমানের এই সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপনই পরবর্তীকালে বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয়ের এক নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটায়। এই বংশের রাজদরবারেই হিন্দুরা মর্যাদার অধিকারী হন। এই ধারাই পরবর্তী হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে অব্যাহত ছিল।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে বাংলায় শান্তি ও সমৃদ্ধির সোপান

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশ বঙ্গদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। ইলিয়াস শাহী বংশের উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ সুশাসনই বঙ্গদেশে শান্তি ও সমৃদ্ধির সোপান রচনা করে।
  • (২) বঙ্গদেশের এই শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফলেই বঙ্গদেশে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি দেখা দেয়। চীনদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও পরিচয় পাওয়া যায়।

ইলিয়াস শাহী শাসকদের লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্ব

বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্ব। এই লোকরঞ্জন ব্যক্তিত্বের জন্য তাঁরা এক চরম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এই জনপ্রিয়তাই তাদের বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল।

বিদেশে ইলিয়াস শাহী শাসনকালে দূত বিনিময়

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালেই বঙ্গদেশের খ্যাতি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছিল । স্বদেশে যেমন জৌনপুরের সুলতানের রাজদরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন, তেমনি আরব দেশের মক্কা ও চীনদেশের সঙ্গেও দূত বিনিময় করে বঙ্গদেশের সঙ্গে বিদেশের এক নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেন।
  • (২) ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালে কয়েকজন চীনা দূত বঙ্গদেশে এসেছিলেন। সমকালীন বঙ্গদেশের ইতিহাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল।
  • (৩) ইবন বতুতাও এই সময়কালেই বঙ্গদেশে এসেছিলেন। তাঁর বিবরণ বঙ্গদেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিবরণ থেকে বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, তাঁর সময় জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাবিক কম ছিল। বয়নশিল্পে বঙ্গদেশের যে জগৎজোড়া নাম সে-কথা ইবন বতুতার বিবরণে পাওয়া যায়।

ইলিয়াস শাহী শাসনে সাধুসন্তদের ভক্তি

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকগণ সাধুসন্তদেরও ভক্ত ছিলেন। এর ফলে বঙ্গদেশে এক নতুন উদার ধর্মীয় শাসন শুরু হওয়ায়, শাসকগণ ন্যায়নিষ্ঠ ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। এমনকি দেখা যায়, ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানগণ সাধুসন্ত ও দরবেশদের উপদেশ অনুযায়ী চলতেন।
  • (২) বিহারের দরবেশ শামস বলখির চিঠি থেকে একদিকে যেমন ইলিয়াস শাহের ব্যক্তিগত চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, অপরদিকে তেমনি ইলিয়াসের ওপর তাঁদের কতটা প্রভাব ছিল তাও জানা যায়। বলখি ভিন্ন আর একজন দরবেশ নূর কুৎব-এর সঙ্গেও ইলিয়াসের ভালো সম্পর্ক ছিল।
  • (৩) প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকগণ সাধুসন্তদের ভক্ত হওয়ার ফলেই, তাঁরা ব্যক্তিগত চরিত্রকে মধ্যযুগীয় নৈতিক কলুষতা থেকে মুক্ত রেখে এক আদর্শপ্রাণ শাসকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। এর ফলে বঙ্গদেশে তাঁরা সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই সর্বজনীন আতিথ্য পেয়েছিলেন।

বাংলায় ইলিয়াস শাহী শাসনকালে সাহিত্যের অগ্ৰগতি

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকাল বঙ্গদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম তিনজন সুলতান নিজেরাই ছিলেন সুপণ্ডিত। তাঁদের পাণ্ডিত্য সুবিদিত।
  • (২) গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ তাঁর স্বরচিত কবিতার একটি পংক্তি পূরণের জন্য ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজের নিকট পাঠান এবং হাফিজ তা পুরণ করে আজমের কাছে পাঠিয়ে দেন।
  • (৩) হাফিজের মৃত্যুর অল্পকাল পরে তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু মহম্মদ গুল অন্দাম কর্তৃক সংকলিত ‘দিওয়ান-ই-হাফিজে’ সম্পূর্ণ গজলটি পাওয়া যায় এবং এতে গিয়াসউদ্দিন ও বঙ্গদেশের নাম আছে। হাফিজের সঙ্গে বঙ্গদেশের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে, ইলিয়াস শাহী বংশের একজন সুলতানের কাছে এটি কম গৌরবের পরিচয় নয়।
  • (৪) সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তারা যে ধারার প্রচলন করেছিলেন, তা বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে, সুবর্ণযুগ বললে অত্যুক্তি হবে না। এই ধারাই হুসেন শাহের রাজত্বকালে বঙ্গদেশকে এক গৌরবময় স্থানে পৌঁছে দেয়।
  • (৫) ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শৈশবকাল উত্তীর্ণ হয়, একথা বলা যায়। ‘চর্যাপদ’ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ বঙ্গভাষার উত্তরণ এই যুগেই ঘটেছিল।
  • (৬)  ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকদের বিরুদ্ধে কোনো কোনো লেখকের যাই অভিযোগ থাকুক না কেন, বঙ্গ-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তাদের স্থান বঙ্গদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
  • (৭) বাংলা গজলের ক্ষেত্রেও তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও সে-যুগের ইলিয়াস শাহী বংশের সাহিত্য-সেবার এক চিত্র পাওয়া যায়।
  • (৮) বিদ্যাপতির কাব্যেও গিয়াসউদ্দিনের নাম পাওয়া যায়। আবার ত্রিপুরার ‘রাজমালা’য় তুরস্ক-নৃপতির কথা আছে। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সিকন্দার শাহকেই তুরস্ক-নৃপতি বলে মনে করেন প্রকৃতপক্ষে, ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানগণের প্রচেষ্টায় লক্ষ্মণাবতী, গৌড় ও পাণ্ডুয়া বঙ্গদেশের এক শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক পীঠস্থানে পরিণত হয়।
  • (৯)  ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম তিনজন সুলতানের পাণ্ডিত্য ছিল, একথা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের শাসক বারবক শাহের পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অল-ফাজিল’ ও ‘অল-কামিল’ এই দুটি উপাধি তাঁর শিলালিপিতে ব্যবহাত হয়েছে।
  • (১০) তিনি শুধু পণ্ডিত ছিলেন না, সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কবি ও সাহিত্যিকগণ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এ ব্যাপারে এই যুগের এক মহাপণ্ডিত বৃহস্পতি মিশ্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি গীতগোবিন্দের টীকা, কুমারসম্ভব টীকা, রঘুবংশ টীকা, শিশুপালবধ টীকা, অমরকোষ টীকা, স্মৃতিরত্নহার প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক।
  • (১১) তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসিদ্ধ গ্রন্থ অমরকোষ টীকা পদচন্দ্রিকা। বৃহস্পতি পদচন্দ্রিকায় লিখেছেন ‘গৌড়েশ্বর তাকে ‘পণ্ডিত সার্বভৌম’ উপাধি প্রদান করেন এবং দশ আঙুলের রত্নখচিত আংটিসহ ‘রাজমুকুট’ প্রদান করেন।
  • (১২) বিশারদ নামে একজন জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক পণ্ডিতের লেখা থেকেও জানা যায় যে, তিনিও বারবক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণবিজয় নামে বিখ্যাত বাংলা কাব্যের লেখক মালাধর বসুকে বারবক শাহ ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। মালাধর বসুর পুত্রও ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
  • (১৩) কৃত্তিবাসই প্রথম বাংলা ভাষায় ‘রামায়ণ‘ রচনা করেন। কৃত্তিবাস ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। তিনিও বারবাক শাহ কর্তৃক সম্মানিত হয়েছিলেন। শরফনামা নামে একটি পারসিক শব্দকোষ গ্রন্থের প্রণেতা ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকিও বারবাক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।
  • (১৪) ইব্রাহিম জৌনপুরের অধিবাসী ছিলেন। তিনিও বারবাক শাহের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমির জৈনুদ্দিন নামে সমসাময়িক একজন কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বারবাক শাহের সভাকবি ছিলেন।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব

  • (১) ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালেই হিন্দু পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের সূচনা হয়। তাঁরাই হিন্দুদের উচ্চ রাজপদে প্রবেশাধিকার দেন। হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এই মনোভাব পরবর্তীকালে খুবই কার্যকরী হয়।
  • (২) অনন্ত সেন বারবাক শাহের রাজ-চিকিৎসক ছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্রের পুত্র বিশ্বাস রায় বারবাক শাহের প্রধানমন্ত্রীদের অন্যতম ছিলেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, কেদার রায় ত্রিহুতে বারবাক শাহের প্রতিনিধি ছিলেন।
  • (৩) কৃত্তিবাস তাঁর আত্মজীবনীতে বারবাক শাহের কয়েকজন সভাসদের উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে জগদানন্দ রায়, ‘ব্রাহ্মণ’ সুনন্দ, কেদার খান, গন্ধর্ব রায়, তরণী, সুন্দর, মুকুন্দ প্রমুখের নাম পাওয়া যায়। মুকুন্দ ছিলেন ‘রাজপণ্ডিত’। কেদার খান ছিলেন বিশেষ প্রতিপত্তিশালী সভাসদ। তিনি কৃত্তিবাসের সংবর্ধনা সভায় কৃত্তিবাসের মাথায় ‘চন্দনের ছড়া’ ঢেলেছিলেন।
  • (৪) গন্ধর্ব রায়কে কৃত্তিবাস ‘গন্ধর্ব অবতার’ বলে অভিহিত করেছেন। বারবাক শাহের বিভিন্ন শিলালিপি থেকে ইকরার খান, আজমল খান, নসরৎ খান, মহাবত্ খান জাহান, অজলকা খান, আশরফ খান, খুরশিদ খান প্রমুখ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নাম পাওয়া যায়।
  • (৫) এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, হিন্দু-মুসলমান উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সমন্বয়ে মধ্যযুগে বঙ্গদেশে এক ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের প্রবর্তন করেছিলেন। বঙ্গদেশেই এ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটে।

বাংলায় ইলিয়াস শাহী শাসনকালে স্থাপত্যের বিকাশ

  • (১) স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রেও ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান বঙ্গদেশের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। রাজধানী পাণ্ডুয়া ও গৌড়কে চমৎকার অট্টালিকার দ্বারা শোভাময় করে তোলা হয়। বঙ্গদেশের স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় সুলতানদের নির্মিত মসজিদ ও সমাধিভবনে।
  • (২) এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুসলমান আমলের যে-সকল অট্টালিকা আজও কালের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলি সবই চতুর্দশ শতকে নির্মিত। বঙ্গদেশের সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলি গৌড় ও পাণ্ডুয়াতে অবস্থিত।
  • (৩) সুলতানি যুগের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন ত্রিবেণী গ্রামে জাফর খান-এর সমাধি মন্দির। ইলিয়াস শাহ হাজিপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। গৌড়ের পাশে একডালা দুর্গও সেকালের এক বিস্ময়কর দুর্গ। যদিও কালের স্রোতে এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ত্রিবেণীতে একটা বিরাট মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আছে।
  • (৪) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিকন্দার শাহ কর্তৃক নির্মিত পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ। সুরক্ষিত মসজিদগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। ভারতবর্ষ-এ এত বড়ো মসজিদ আর কখনও নির্মিত হয় নি। দামাস্কাসের মসজিদের অনুকরণে এটি নির্মিত। এই মসজিদ সম্পর্কে পার্সি ব্রাউন বলেছেন, এই মসজিদটিই রাজধানী লক্ষ্মণাবতীর সবচেয়ে শিল্পসুষমামণ্ডিত মসজিদ।
  • (৫) এছাড়া আখ-ই-সিরাজউদ্দিন মসজিদ, কোতোয়লি দরওয়াজা ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালের অন্যতম প্রাসাদটি সৌন্দর্যের চরম নিদর্শন। ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ-এর নির্মিত দারাসবারিতে জামি মসজিদ। এটিও একটি সৌন্দর্যের নিদর্শন।
  • (৬) কানিংহাম ও ক্রিঘটনের মতে, ইউসুফ গৌড়ে আরও তিনটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই তিনটি মসজিদ হল- গৌড়ের বিখ্যাত লোটন মসজিদ, চামকাটি মসজিদ এবং গৌড়ের তাঁতিপাড়া মসজিদ।
  • (৭) লোটন মসজিদের শিল্প-সুষমা বর্ণনা করতে গিয়ে ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন, is unsurpassed for elegance of style, lightness of construction and tasteful decoration in any part of Hindustan.’
  • (৮)  ইউসুফ শাহ হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মসজিদটি ‘বাইশ-দরওয়াজা’ নামে পরিচিত। এইসব মসজিদের ও অট্টালিকার এক নিজস্ব শিল্পরীতি ছিল। এই শিল্পরীতি দিল্লির শিল্পরীতি অপেক্ষা স্বতন্ত্র ছিল। এইসব অট্টালিকায় পাথর ও ইট দুই-ই ব্যবহৃত হত। ইলিয়াস শাহী বংশ দেশে এক স্বতন্ত্র শিল্পরীতির প্রবর্তন করে, শিল্প-স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও নতুন যুগের সূচনা করে।

ইলিয়াস শাহী শাসনকালে শিক্ষার বিকাশ

শিক্ষার ক্ষেত্রেও ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানগণ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা বহু মাদ্রাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি, মক্কা ও মদিনাতেও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউসুফ শাহ একটি কলেজ নির্মাণ করেছিলেন।

উপসংহার :- এই সমস্ত দিক থেকে বিচার করলে যথার্থই বলা যায়, ‘A new chapter was opened in the History of Bengal with the accession of Ilyas Shah to the throne of Lakhnauti…”

(FAQ) বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

২. মালাধর বসুকে গুণরাজ খান উপাধি দেন কে?

রুকনউদ্দিন বারবক শাহ।

৩. বাইশ-দরওয়াজা কে নির্মাণ করান?

শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ।

৪. আদিনা মসজিদ নির্মাণ করান কে?

সিকান্দার শাহ।

Leave a Comment