শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ

বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রসঙ্গে দিল্লি আধিপত্য মুক্ত বাংলা, পূর্ব ভারতে স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা, প্রাদেশিক সীমান্ত স্থাপনের চেষ্টা, বাংলায় নবযুগের সূচনা, সাতগাঁও অধিকার, ত্রিহুত বারানসি জয়, পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষা, নেপাল অভিযান, উড়িষ্যা অভিযান, দিল্লির ফিরোজ শাহের বাংলা অভিযান, একডালা দুর্গে আশ্রয়, একডালা দুর্গ অবরোধ, ইলিয়াস শাহের আক্রমণ, শান্তি স্থাপন, কামরূপ অভিযান ও তার কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ

রাজাশামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
বংশইলিয়াস শাহী
রাজ্যবাংলা
রাজত্বকাল১৩৪২-৫৭ খ্রি
রাজধানীপাণ্ডুয়া
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ

ভূমিকা :- ড: নুরুল হাসান বলেছেন যে, “ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে একটি কৃতিত্বপূর্ণ যুগের সুচনা করেন।” স্যার জে. এন. সরকারের মতে, “ইলিয়াস শাহ লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসার ফলে বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় আরম্ভ হয়।”

দিল্লি আধিপত্য মুক্ত বাংলা

ইলিয়াস শাহের আমল থেকে বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ চতুর্দশ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত বাংলা দিল্লীর আধিপত্য মুক্ত ছিল। বাংলার এই স্বাধীন সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজী ইলিয়াস শাহ।

পূর্ব ভারতে স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা

বক্তিয়ার খলজির পর থেকে পূর্ব ভারতে এক স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই প্রচেষ্টাগুলি সাফল্যমণ্ডিত হয় নি। দিল্লীর সুলতানশাহীর আক্রমণে বারবার বাংলাকে কেন্দ্র করে স্বাধীন সুলতানি গড়ার চেষ্টা বিফল হয়। ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম এই নীতিকে সফলভাবে প্রয়োগ করেন।

প্রাদেশিক সীমান্ত স্থাপনের চেষ্টা

  • (১) ইলিয়াস শাহ বাংলার সীমান্তকে তার প্রাকৃতিক সীমারেখায় স্থাপন করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। বাংলার পশ্চিম সীমান্তকে দিল্লী সুলতানির আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করতে হলে গঙ্গা-কোশী-গণ্ডক উপত্যকায় সীমান্ত স্থাপনের দরকার ছিল। বৃহত্তর বঙ্গের পশ্চিমে প্রাকৃতিক সীমান্ত এই রেখায় অবস্থিত।
  • (২) দিল্লীর বাহিনীকে বাধা দিতে হলে এই তিন নদীর উপত্যকা ও নদীর বিস্তৃত জলসীমা আত্মরক্ষার কাজে আসে। বাংলার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল উড়িষ্যা। উড়িষ্যা ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে কোনো প্রাকৃতিক সীমারেখা নেই।
  • (৩) এই কারণে বাংলার দক্ষিণ সীমান্তকে সুদৃঢ় করতে হলে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত আধিপত্য স্থাপনের দরকার ছিল। নতুবা উড়িষ্যা বা আরও দক্ষিণের দেশ থেকে বাংলায় আক্রমণ ঘটত। বাংলার উত্তর সীমায় হিমালয় পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার ছিল তাঁর অপর লক্ষ্য।
  • (৪) বাংলার পূর্বে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছিল বাংলার প্রাকৃতিক সীমান্ত। ইলিয়াস শাহ ও তাঁর বংশধররা বাংলার সীমান্তকে এই প্রাকৃতিক সীমারেখায় স্থাপনের চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে হোসেন শাহী সুলতানরাও একই লক্ষ্য নেন।
  • (৫) সপ্তদশ শতকের ইউরোপের ইতিহাসে ফ্রান্স যেরূপ রাইন ও পিরানীজ সীমান্ত পাওয়ার চেষ্টা করে ইলিয়াস শাহী বংশ সেইরূপ বাংলার প্রাকৃতিক সীমান্ত স্থাপনের চেষ্টা করেন।

বাংলায় নবযুগের সূচনা

ইলিয়াস শাহের আমলে বাংলার স্থানীয় শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। নানা দিক থেকে ইলিয়াস শাহী শাসনকে বাংলায় নবযুগের সূচনা বলা যায়।

সাতগাঁও অধিকার

১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে বসার পর ইলিয়াস শাহ সাতগাঁও অধিকার করেন। সাতগাঁও ছিল এক বিখ্যাত নদীবন্দর ও শাসনকেন্দ্র। তিনি সোনারগাঁওয়ে ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার আধিপতা নেন। এইভাবে গোটা বাংলায় তাঁর আধিপত্য স্থাপিত হয়।

ত্রিহুত, বারাণসী জয়

ইলিয়াস শাহ এর পর পশ্চিমমুখী হয়ে বিহারের ত্রিহুত অঞ্চল আক্রমণ করেন। এই সময় ত্রিহুতে সখী সিং ও কামেশ্বর সিং নামে দুই দুর্বল রাজা শাসন করতেন। ইলিয়াস তাদের পরাস্ত করে কোশী-গণ্ডক উপত্যকার দিকে অগ্ৰসর হন।

পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষা

এরপর তিনি চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও বারাণসী অধিকার করেন। এর ফলে পশ্চিমে তার সীমান্ত সুরক্ষিত হয়।

নেপাল অভিযান

  • (১) ইলিয়াস ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে নেপাল অভিযান করেন। উত্তর সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য তিনি জয়রাজ দেবকে পরাস্ত করে কাঠমাণ্ডু লুঠ করেন। তিনি বহু ধনরত্ন নিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসেন। নেপালের বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দির তিনি ধ্বংস করেন।
  • (২) কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই মন্দির ধ্বংসের কাজকে ধর্মীয় গোড়ামি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আসলে নতুন বিজিত অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের প্রতীক হিসেবে শত্রুপক্ষের মন্দির আক্রমণ করা হত। এই কাজগুলির সঙ্গে ধর্মীয় গোঁড়ামির সম্পর্ক বিশেষ ছিল না।
  • (৩) ইলিয়াস শাহ যদি প্রকৃতই গোড়া ধর্মোন্মাদী হতেন তবে তিনি বিজিত অঞ্চলে ধর্মান্তর করবার চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর নিজ রাজ্যের মধ্যে হিন্দু মন্দির ভাঙ্গেন বলে জানা যায় নি। সুতরাং ইলিয়াসের এই কাজগুলিকে সঠিক পটভূমিতে বিচার করা উচিত।

উড়িষ্যা অভিযান

  • (১) এরপর ইলিয়াস শাহ বাংলার দক্ষিণ সীমান্তকে সুরক্ষিত করার জন্য চেষ্টা চালান। তিনি সুবর্ণরেখা পার হয়ে উড়িষ্যার ভেতর অভিযান চালিয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত এগিয়ে যান। উড়িষ্যার রাজার বহু ধনসম্পত্তি ও ৪৪টি হস্তী লুঠ করে আনা হয়।
  • (২) ইলিয়াস শাহ অবশ্য উড়িষ্যার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন নি। তবে উড়িষ্যার রাজা ইলিয়াসের পরাক্রমে ভীত হয়ে বাংলার দক্ষিণ সীমান্ত আক্রমণে বিরত থাকেন।

দিল্লির ফিরোজ শাহের বাংলা অভিযান

ইলিয়াস শাহের ক্ষমতা বৃদ্ধি বিশেষত বিহার ও উত্তরপ্রদেশে তাঁর রাজ্য বিস্তার দিল্লী সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শিরঃপীড়া সৃষ্টি করে। ফিরোজ শাহ বাংলার এই ভূঁইফোড সুলতানের ক্ষমতা চূর্ণ করার উদ্দেশ্যে প্রায় ১০ হাজার অশ্বারোহী সেনাসহ বাংলা অভিযান করেন। গোরক্ষপুর, চম্পারণ হয়ে ফিরোজ শাহ বাংলায় আসেন। ইলিয়াসের রাজধানী পাণ্ডুয়া ফিরোজ তুঘলক দখল করেন।

একডালা দুর্গে আশ্রয়

ইলিয়াস শাহ তাঁকে বাধা না দিয়ে পিছু হটে আসেন এবং দিনাজপুরের একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। এই দুর্গটি মাটির তৈরি হলেও দুর্ভেদ্য ছিল এবং চারদিকে মহানন্দা নদীর জলপ্রবাহ দ্বারা ঘেরা ছিল।

একডালা দুর্গ অবরোধ

  • (১) সুলতান ফিরোজ শাহ, বাংলার রাজধানী বিনা বাধায় দখল করেন। তিনি কর হ্রাসের প্রলোভন দ্বারা প্রজাদের তার পক্ষে আনার চেষ্টা করেন এবং একডালা দুর্গ অবরোধ করেন। ইতিমধ্যে বর্ষাকাল আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
  • (২) বাংলার মশার কামড়ে ফিরোজ শাহের বাহিনী ও ঘোড়াগুলি অস্থির হয়ে পড়ে। ফিরোজ বুঝতে পারেন যে, আর বেশিদিন অবরোধ চালান যাবে না। সুতরাং তিনি তাঁর সেনাদের রাজধানী পাণ্ডুয়ার দিকে পিছু হটতে নির্দেশ দেন।

ইলিয়াস শাহের আক্রমণ

ইলিয়াস শাহ মনে করেন যে, দিল্লী বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাচ্ছে। সুতরাং তিনি দুর্গ থেকে বের হয়ে তাঁর সেনাদলসহ ফিরোজের বাহিনীকে আক্রমণ করলে, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইলিয়াসের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু তিনি তাঁর অবশিষ্ট সেনাসহ পুনরায় একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন।

শান্তি স্থাপন

  • (১) সুলতান ফিরোজ একডালায় আক্রমণ চালাবার উদ্যোগ করলে মুসলিম মহিলারা দুর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে করুণ ক্রন্দন করেন। এর ফলে ফিরোজের মনে দয়ার উদ্রেক হয়। আফিফের মতে, দুর্গ আক্রমণের সময় সেনাদল দুর্গের মুসলিম নারীদের ওপর অত্যাচার করতে পারে একথা ভেবে ধর্মপ্রাণ ফিরোজ নিরস্ত হন।
  • (২) তিনি আক্রমণ প্রত্যাহার করে দিল্লী ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। কোশী নদী উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী রাজ্য সীমারূপে গণিত হয়। ইলিয়াস দিল্লি সুলতানের কাছে দুবার উপঢৌকন পাঠান। তবে বাংলা কার্যত স্বাধীন হয়ে যায়।

কামরূপ অভিযান

দিল্লীর সঙ্গে শান্তি স্থাপনের পর ইলিয়াস শাহ পূর্ব সীমান্তে কামরূপ অভিযান করেন (১৩৫৭ খ্রি)। ইলিয়াসের বাহিনী ব্রহ্মপুত্র পার হয়। তবে এই অভিযানে কোনো স্থায়ী ফল হয় বলে জানা যায় নি।

কৃতিত্ব

ইলিয়াস শাহ সুশাসক ছিলেন। পীর, দরবেশদের প্রতি তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর আমলে পাণ্ডুয়া শিল্পে স্থাপত্যে খ্যাতি পায়। তাঁর সেনাদলে হিন্দু পাইক সেনাদের বীরত্বের খ্যাতি ছিল। একডালার যুদ্ধে পাইক সর্দার সহদেব প্রাণ দেন।

মৃত্যু

সম্ভবত ১৩৫৮-১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ দেহত্যাগ করেন।

উপসংহার :- ইলিয়াস শাহের জনপ্রিয়তার প্রমাণ এই যে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ পাণ্ডুয়া দখল করে ভূমিদান দ্বারা নগরবাসীদের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করে বিফল হন।

(FAQ) বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

২. ইলিয়াস শাহের রাজধানী কোথায় ছিল?

পাণ্ডুয়া।

৩. ইলিয়াস শাহের আমলে কোন সুলতান বাংলা অভিযান করেন?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

৪. ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল কত?

১৩৪২-৫৭ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment