অপরসায়ন বা ‘অ্যালকেমি’ (Alchemy)

অপরসায়ন প্রসঙ্গে অপরসায়ন কি?, অপরসায়ন শব্দের উৎপত্তি, অপরসায়ন চর্চা, অপরসায়নের সঙ্গে যুক্ত বিষয়সমূহ, উল্লেখযোগ্য অপরসায়নবিদ, অপরসায়নের উৎপত্তি, অপরসায়ন চর্চার প্রসার, অপরসায়নের ভিত্তি, অপরসায়ন চর্চার অবসান ও অপরসায়নের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

অ্যালকেমি বা অপরসায়ন প্রসঙ্গে মধ্যযুগের প্রাথমিক, অবৈজ্ঞানিক রসায়ন অনুশীলনের ধরণ অপরসায়ন, অপরসায়ন শব্দের উৎপত্তি, অপরসায়নের উৎপত্তি, অপরসায়ন চর্চা, খ্যাতিসম্পন্ন অপরসায়নবিদ, অপরসায়নের গুরুত্ব ও অপরসায়ন চর্চার অবসান সম্পর্কে জানব।

অপরসায়ন

ঐতিহাসিক ঘটনাঅপরসায়ন
ইংরেজি শব্দAlchemy
আরবি শব্দআল-কিমিয়া
চর্চার সূত্রপাতপ্রাচীন মিশর
অপরসায়নবিদপ্যারাসেলসাস, আলবার্ট ম্যাগনাস
অপরসায়ন

ভূমিকা :- ব্যাবহারিক দিক থেকে রসায়নবিদ্যার চর্চা যথেষ্ট প্রাচীন হলেও প্রাচীন কালে এই চর্চা কখনোই যথার্থ যুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর ছিল না। প্রাচীন কালে গ্রিক ও রোমান যুগের বিদ্যাচর্চায় যুক্তিসম্মত রসায়নবিদ্যাচর্চার কোনো স্থান ছিল না। এই সময় অ্যারিস্টটল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠনে ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ – এই চারটি উপাদানের কথা বলেছিলেন। পরবর্তী বহু যুগ ধরে অ্যারিস্টটলের এই ভ্রান্ত ধারণার উপর ভরসা রেখেই ইউরোপ-এ জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। রসায়নবিদ্যার জ্ঞানে এই ভ্রান্তি সত্ত্বেও মধ্যযুগ পর্যন্ত ইউরোপের সর্বস্তরে এই ধারণাগুলিই বহুল প্রচলিত ছিল।

অপরসায়ন কি?

প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সময়ে যুক্তি ও আধুনিক বিজ্ঞান-নির্ভরতাহীন যে রসায়নবিদ্যার চর্চা ইউরোপে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তা অপরসায়নবিদ্যা’ বা ‘অ্যালকেমি’ (Alchemy) নামে পরিচিত।

অপরসায়ন শব্দের উৎপত্তি

মনে করা হয় যে, প্রাচীন মিশরীয় শব্দ ‘খেম’ (Khem) শব্দটি থেকে গ্রিক ‘খেমিয়া’ (Khemia) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরবরা মিশর দখল করার পর আরবদের দ্বারা এই শব্দটিই আল-কিমিয়া’য় পরিণত হয়। আরবি ‘আল-কিমিয়া’ (Al-Kimiya) শব্দটি থেকে ইংরেজি Alchemy শব্দের উৎপত্তি, যার বাংলা হল অপরসায়ন।

অপরসায়ন চর্চা

প্রাচীন গ্রিস, মিশর, চিন প্রভৃতি দেশে অপরসায়নের চর্চা হলেও ইউরোপে এই বিদ্যাচর্চা এসেছে আরব থেকে।

অপরসায়নের সঙ্গে যুক্ত বিষয়সমূহ

অপরসায়নবিদ্যার সঙ্গে জড়িত ছিল জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা, জাদুবিদ্যা, সর্বপ্রাণবাদ, রহস্যবাদ চর্চা, সাধারণ ধাতু থেকে সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু তৈরির অর্থহীন চেষ্টা প্রভৃতি।

(ক) জ্যোতিষচর্চা

তখন জ্যোতিষচর্চায় বিভিন্ন ধাতুগুলিকে পৃথক পৃথক গ্রহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হত।

(খ) জাদুবিদ্যাচর্চা

জাদুবিদ্যার প্রচারকগণ অলৌকিক শক্তির দ্বারা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তা মানবসমাজের কল্যাণে ব্যবহার করার কথা বলত।

(গ) সর্বপ্রাণবাদ অনুসরণ

সর্বপ্রাণবাদী মতবাদের দ্বারা প্রকৃতির সকল বস্তুতে প্রাণের অস্তিত্বের কল্পনা করা হয়েছিল।

(ঘ) রহস্যবাদচর্চা

রহস্যবাদের অনুরাগীরা মনে করতেন যে প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের গুপ্তশক্তি রয়েছে। এই শক্তিগুলিকে মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানবসমাজের উপকার হবে।

(ঙ) মূল্যবান ধাতু তৈরির প্রয়াস

অপরসায়নবিদরা (Alchemists) রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দ্বারা সিসা বা কোনো সাধারণ ধাতুকে রূপান্তরের মাধ্যমে কোনো বহুমূল্য ধাতুতে, বিশেষ করে সোনায় পরিণত করার গবেষণায় নিয়োজিত ছিল। তারা এমন এক পরশ পাথরের সন্ধান করছিল যার স্পর্শে সাধারণ ধাতু মুহূর্তে সোনায় পরিণত হবে।

উল্লেখযোগ্য অপরসায়নবিদ

ইউরোপের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অপরসায়নবিদ ছিলেন মহম্মদ উমেইল আল তামিনি, বেঞ্জামিন মুসাফিয়া, হারমেস ট্রিসমেজিস্টাস, কর্নেলিয়াস অ্যাগ্রিপ্পা, প্যারাসেলসাস, আলবার্ট ম্যাগনাস প্রমুখ।

অপরসায়নের উৎপত্তি

অপরসায়নচর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল প্রাচীন মিশরে। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, মৃত্যুর পরও মানুষের এক জীবন থাকে। এই কারণে তারা মৃতদেহ সংরক্ষণের বা মমি তৈরি পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, তারই ফলে তাঁদের রাসায়নিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল। এইভাবেই মিশরে সর্বপ্রথম অপরসায়ন বিষয়ে চর্চা শুরু হয়।

অপরসায়নচর্চার প্রসার

  • (১) গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর জয় করেন। এরপর ধীরে ধীরে গ্রিক দার্শনিকরা মিশরীয়দের জগৎ-সম্পৰ্কীয় চিন্তা-ভাবনার সংস্পর্শে আসেন। তাঁরা ক্ষিতি (ভূমি), অপ্ (জল), তেজ (আগুন) ও মরুৎ (বায়ু) – এই চারটি উপাদানের সহায়তায় বিভিন্ন বস্তুর গঠন সম্পর্কিত মিশরীয়দের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হন।
  • (২) গ্রিকরা এই বিষয়ে চর্চা শুরু করে এবং এই পথেই গ্রিসে অপরসায়নেরও চর্চা শুরু হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরবরা মিশর দখল করার পর মিশর থেকে অপরসায়ন বিদ্যার চর্চা আরবে ছড়িয়ে পড়ে।
  • (৩) খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে এই চর্চা আরবরা স্পেনে নিয়ে আসে। সেখান থেকে তা পরবর্তীকালে ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রাচীন চিন এবং ভারত-এও স্বতন্ত্রভাবে অপরসায়ন বিদ্যার চর্চা শুরু হয়েছিল।

অপরসায়নের ভিত্তি

  • (১) অপরসায়নের চর্চা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তত্ত্বে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাস্তব কোনো ভিত্তি ছিল না। পঞ্চদশ শতকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন-এর সঙ্গে যুক্ত সংস্কারপন্থীরা অপরসায়নের এই জাদুবিদ্যার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তথাপি সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সবের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় নি।
  • (২)  অপরসায়নবিদরা বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সহায়তায় অনেক রোগ সারাতেন। কিন্তু তাঁরা রোগ সারার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করতে পারতেন না। তাই মানুষ একে জাদুবিদ্যা বলে মনে করত। এই জাদুবিদ্যার সংস্কার করেই আবার পরবর্তীকালে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা সম্ভব হয়েছিল। এজন্য জাদুবিদ্যাকে অনেকে ‘প্রাক্-বিজ্ঞান’ বা ‘Proto Science’ বলে অভিহিত করেছেন।

অপরসায়ন চর্চার অবসান

পঞ্চদশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপে অপরসায়ন বিদ্যার ব্যাপক চর্চার ফলে প্রকৃত রসায়নবিদ্যার চর্চা যথেষ্ট ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে অপরসায়ন বিদ্যার ব্যর্থতা মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল, হুক, মেয়ো প্রমুখের আধুনিক রসায়নচর্চা অপরসায়নের ত্রুটি, ভ্রান্তি ও বার্থতাগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরে। অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর কল্পিত গুটিকয় মৌলের দ্বারা গঠিত বিশ্বচিত্র ক্রমে ভেঙে পড়তে থাকে। প্যারাসেলসাস যে তিনটি মৌলের তত্ত্ব প্রচার করেন তা-ও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।

অপরসায়নের গুরুত্ব

ভ্রান্ত হলেও অপরসায়ন চর্চার বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল। যেমন –

(ক) যথার্থ রসায়নের সূচনা

অপরসায়নের জাদুবিদ্যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। প্লেগ থেকে মুক্তির জন্য প্যারাসেলসাস কর্তৃক প্রদত্ত কবচের ব্যবহারেও কোনো বিজ্ঞান ছিল না। কিন্তু তাঁর অনুগামীরা যখন জাদুবিদ্যার মাধ্যমে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রসায়নচর্চা শুরু করেন তখন এর মধ্যে আধুনিক যথার্থ রসায়নচর্চার দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা পথ অবশ্যই তৈরি হয়। অপরসায়নবিদ্যার সংস্কার করেই তা থেকে আধুনিক রসায়নের উৎপত্তি ঘটে। তাই অনেকে অপরসায়নবিদ্যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের বীক্ষণাগার বলে অভিহিত করেন।

(খ) নতুন আবিষ্কার

অপরসায়নবিদরাই সর্বপ্রথম বারুদ, ধাতুবিদ্যা-সংক্রান্ত বিভিন্ন কৌশল প্রভৃতি আবিষ্কার করেন। অপরসায়নবিদ প্যারাসেলসাস দস্তা নামে ধাতব মৌলের আবিষ্কার করেন।

(গ) পদার্থের গঠন

পদার্থের গঠন সম্পর্কে ধারণাসপ্তদশ শতকের কণাতত্ত্বের ধারণা অর্থাৎ ক্ষুদ্র কণিকার দ্বারা পদার্থের গঠনের ধারণা পূর্বতন সব ভ্রান্ত ধারণাকে দূর করে দেয়। নতুন যুগের বিজ্ঞানী বয়েল মৌলিক পদার্থের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করে ফেলেন। পদার্থবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন রসায়নচর্চায় খুব বেশি দূর এগোতে না পারলেও পরমাণুর গঠন সম্পর্কে তিনি যে চিত্র প্রকাশ করেন তা আধুনিক রসায়নের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়

উপসংহার :- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাচীন যুগেই আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে অ্যারিস্টটলের ভ্রান্ত ধারণার উপর ভরসা রেখে ইউরোপে রসায়নবিদ্যার চর্চা বহুল প্রচলিত ছিল, যা অপরসায়ন বিদ্যা নামে পরিচিত।

(FAQ) অপরসায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. অপরসায়নবিদ্যা কি?

প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সময়ে যুক্তি ও আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভরতাহীন যে রসায়নবিদ্যার চর্চা ইউরোপে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তা অপরসায়নবিদ্যা বা অ্যালকেমি নামে পরিচিত।

২. অপরসায়ন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ কি?

Alchemy.

৩. ইউরোপের দুজন অপরসায়নবিদের নাম লেখ।

মহম্মদ উমেইল আল তামিনি, প্যারাসেলসাস।

৪. অপরসায়ন চর্চার সূত্রপাত ঘটে কোথায়?

প্রাচীন মিশরে।

৫. গ্রিক বির আলেকজান্ডার মিশর জয় করে কখন?

৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment