তুঘলক বংশ প্রসঙ্গে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক, মহম্মদ বিন তুঘলক, ফিরোজ শাহ তুঘলক, তুঘলক শাহ, আবুবকর, মহম্মদ শাহ, সিকান্দার শাহ, নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ, নসরৎ শাহ ও তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জানবো।
দিল্লী সুলতানির তুঘলক বংশ
বিষয় | তুঘলক বংশ |
সময়কাল | ১৩২০-১৪১২ খ্রি: |
প্রতিষ্ঠাতা | গিয়াসউদ্দিন তুঘলক |
পাগলা রাজা | মহম্মদ বিন তুঘলক |
শেষ সুলতান | নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ |
তৈমুরের আক্রমণ | ১৩৯৮ খ্রি: |
ভূমিকা:- ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী সুলতানির খলজি বংশ -এর পতন ঘটে। এরপর গাজি মালিক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং শুরু হয় তুঘলক বংশের ইতিহাস।
তুঘলক বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক
খলজি আমলে গাজি মালিক ছিলেন পাঞ্জাবের অন্তর্গত দিপালপুরের শাসনকর্তা। ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লীর সুলতান খসরু শাহকে পরাজিত ও নিহত করেন এবং গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তিনিই তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা।
তুঘলক বংশের সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জুনা খান মহম্মদ- বিন-তুঘলক নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম হল ফকরউদ্দিন মহম্মদ জুনা খান। ভারত ইতিহাসে তাঁকে ‘পাগলা রাজা’ বা উন্মাদ রোগগ্রস্ত বলা হত। তার রাজত্বের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) রাজধানী স্থানান্তরণ
মহম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পরিবর্তন করেন। কারণ দেবগিরি সাম্রাজ্যের মধ্যস্থলে হওয়ায় পুরো সাম্রাজ্য ভালোভাবে শাসন করা যাবে। এবং বারবার মোঙ্গল আক্রমণে বিপর্যন্ত দিল্লির চেয়ে দেবগিরি অনেক বেশি নিরাপদ হবে। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
(২) প্রতীক মুদ্রা বা তামার নোট প্রচলন
মহম্মদ-বিন-তুঘলক ১৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন করেন। সমকালীন ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতানের দান খয়রাত ও খোরাসান জয়ের পরিকল্পনার দরুন যে অর্থসংকট দেখা দেয় তা কাটাবার জন্য এবং বিশেষত রূপার সংকট থেকে মুক্তি পেতে তিনি ব্রোঞ্জ বা তামার নোটের প্রচলন করেন। শেষ পর্যন্ত মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়।
(৩) দোয়াবে রাজস্ব সংস্কার
১৩২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ দোয়াবে রাজস্ব বৃদ্ধি করে সরকারের আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করেন, যার মোকাবিলা করতে তিনি পতিত জমিকে চাষযোগ্য করতে ‘আমির-ই-কোহি’ নামে কৃষি বিভাগ খোলেন।
(৪) আমির-ই-কোহি
মহম্মদ-বিন-তুঘলক দোয়াবে রাজস্ব সংস্কার করতে গিয়ে ‘আমির-ই-কোহি’ নামে কৃষিবিভাগ স্থাপন করেন। কৃষির উন্নতি ও পতিত জমি পুনরুদ্ধার করে তাকে আবাদযোগ্য করে তোলাই ছিল আমির-ই-কোহি-র প্রধান উদ্দেশ্য। এই ব্যবস্থার ফলে অর্থের প্রচুর অপচয় হয়।
(৫) মোঙ্গল আক্রমণ
১৩২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে মোঙ্গল নেতা তরমাশিরিন খান ভারত আক্রমণ করেন। তিনি মিরাটের যুদ্ধে সুলতানি বাহিনীর হাতে পরাজিত হন।
(৬) মৃত্যু
গুজরাটের পলাতক শাসক মালিক তার্ঘিকে দমন করার জন্য মহম্মদ-বিন-তুঘলক সিন্ধুদেশ অভিযান করেন। অসুস্থ অবস্থায় থাট্টায় ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদের মৃত্যু হয়।
তুঘলক বংশের সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক
ভারতে সেচ পরিকল্পনার জনক হলেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। মহম্মদ-বিন-তুঘলক ছিলেন তাঁর খুল্লতাত। তাঁকে ‘সুলতানি যুগের আকবর‘ও বলা হয় । তাকে রোম সম্রাট অগাস্টাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তার রাজত্বের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) জনহিতকর কার্যাবলি
ফিরোজ তুঘলকের উল্লেখযোগ্য জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি হল কৃষির উন্নতির জন্য জলাধার, খাল, কূপ খনন। ২৪ রকম করের বদলে, ৪ রকম কর প্রবর্তন করেন। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান এবং দরিদ্রদের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন।
(২) সেচ পরিকল্পনা
সেচ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ফিরোজ তুঘলক ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেচ খাল খনন করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৫০ মাইল দীর্ঘ যমুনা খাল এবং ৯৬ মাইল দীর্ঘ শতদ্রু-ঘর্ঘরা খাল। এছাড়াও দেড় শতাধিক কূপ খনন করে সেচ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন।
(৩) সুলতানির পতনে দায়িত্ব
দিল্লীর সুলতানির পতনের জন্য ফিরোজ তুঘলককে অনেকাংশে দায়ী করা যায়। কারণ, তাঁর শাসননীতি ছিল দুর্বল। ইক্তাগুলিকে বংশানুক্রমিক করে দেওয়ায় সেনা সংগঠনগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাঁর অনুদার ধর্মীয় নীতি হিন্দু প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
তুঘলক বংশের সুলতান তুঘলক শাহ (১৩৮৮-১৩৮৯ খ্রি:)
১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যু হলে তাঁর পৌত্র তুঘলক শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তুঘলক শাহ ছিলেন পানাসক্ত ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। তিনি রাজকার্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। অভিজাতরাও তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়।
তুঘলক বংশের সুলতান আবুবকর (১৩৮৯-৯০ খ্রি:)
শেষ পর্যন্ত ফিরোজের অপর এক পৌত্র আবুবকর তুঘলক শাহকে ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনচ্যুত করেন। আবুবকর এই রাজনৈতিক বিপ্লবে লাভবান হতে পারেন নি। ফিরোজের তৃতীয় পুত্র মহম্মদ শাহ এর সুযোগ নিয়ে দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন (১৩৯০ খ্রি:)।
তুঘলক বংশের সুলতান মহম্মদ শাহ (১৩৯০-১৩৯৪ খ্রি:)
মহম্মদ শাহ সিংহাসন অধিকার করলেও সুলতানি সাম্রাজ্যের ঐক্য ধরে রাখতে পারেন নি। তিনিও ছিলেন সুরাসক্ত এবং এজন্য তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ শাহ মারা যান।
তুঘলক বংশের সুলতান সিকন্দার শাহ (১৩৯৪ খ্রি:)
তারপরে তাঁর পুত্র সিকন্দার শাহ মাত্র চার সপ্তাহ কাল রাজত্ব করেন।
তুঘলক বংশের সুলতান নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ
- (১) সিকন্দার শাহের পর তাঁর ভ্রাতা নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন (১৩৯৪ খ্রি)। তাঁর শাসন দিল্লীর অভিজাতরা পছন্দ করত না। সাম্রাজ্যের সর্বত্র এই সময় বিদ্রোহের ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে।
- (২) দক্ষিণ ভারত, খান্দেশ, মালব, বুন্দেলখণ্ড, রাজপুতানা, গুজরাটে স্থানীয় শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফলে সুলতানি সাম্রাজ্য ভেঙে গেলে, দিল্লী ও তার পার্শ্ববর্তী স্থান নিয়ে এক ক্ষুদ্র রাজ্যের ওপর নাসিরুদ্দিন রাজত্ব করতে বাধ্য হন। জৌনপুর ও পাঞ্জাবেও স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়।
তুঘলক বংশের সুলতান নসরৎ শাহ
এদিকে নসরৎ শাহ নামে ফিরোজের এক পুত্র নিজেকে দিল্লীর সুলতান বলে ঘোষণা করেন। ফলে দিল্লীতে এক সঙ্গে দুইজন সুলতান শাসন করতে থাকেন। নাসিরুদ্দিন শাহ দিল্লীতে ও নসরৎ শাহ ফিরোজাবাদে অধিষ্ঠান করেন। অভিজাতরা ভাগ হয়ে কেউ নাসিরুদ্দিন, কেউ নসরতের পক্ষ নেন।
তুঘলক বংশের শাসনকালে তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ
এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে তৈমুর লঙ ভারত আক্রমণ করেন। তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ -এর ভয়ে দুই সুলতান দিল্লী থেকে পালিয়ে যান। তৈমুর ফিরে যাওয়ার পর নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ পুনরায় দিল্লী অধিকার করেন। তিনি মাল্লু ইকবাল ও পরে দৌলতা খাঁ নামে আফগান সেনাপতিদের অধীন হয়ে পড়েন।
উপসংহার :- ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহের মৃত্যু হলে তুঘলক বংশের পতন ঘটে। এরপর খিজির খাঁ নামে এক ব্যক্তি দিল্লীর সিংহাসনে সৈয়দ বংশ -এর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
(FAQ) তুঘলক বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৩২০-১৪১২ খ্রিস্টাব্দ।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।
মহম্মদ বিন তুঘলক।
মহম্মদ বিন তুঘলক।
নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ, ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে।
নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ।