মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন

মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন প্রসঙ্গে বরণির অভিমত, বরণির মতের ত্রুটি, চীন ও পারস্যের অনুকরণ, রৌপ্য সংকট, তাম্র মুদ্রার বিফলতা, বিফলতার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন
প্রবর্তকমহম্মদ বিন তুঘলক
সময়কাল১৩২৯-৩০ খ্রি
অনুকরণকুবলাই খান
কারণরৌপ্য সংকট
ফলাফলব্যর্থতা
মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন

ভূমিকা :- সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে সোনার টঙ্কা, রূপার টঙ্কা ও তামার পয়সা বা জিতলের প্রচলন ছিল। তিনি রূপার অভাব বশত দিনার নামে এক নতুন স্বর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং এক দিনার সমান ১০টি রূপার টা ঠিক করে দেন।

মহম্মদ বিন তুঘলক কর্তৃক তাম্র মুদ্রার প্রবর্তন

সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত মুদ্রা সংস্কার ছিল ১৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতীক তাম্র মুদ্রার প্রবর্তন।

মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা সম্পর্কে বরণীর অভিমত

বরণীর মতে, সুলতান দান খয়রাত্, ও খোরাসান অভিযান-এর পরিকল্পনার জন্য রাজকোষ শূন্য করে ফেলেন। তখন অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতীক তাম্র মুদ্রার প্রবর্তন করেন।

সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা সম্পর্কে বরণীর মতের ত্রুটি

ঐতিহাসিক বরণীর এই অভিমতে বহু ত্রুটি দেখা যায়। যেমন –

  • (১) ফেরিস্তার মতে, মহম্মদের প্রচলিত মুদ্রা ছিল ব্রোঞ্জের, তামার নয়। সুলতান মহম্মদের এই প্রতীক মুদ্রা পরীক্ষা করে টমাস এই মুদ্রাগুলি ব্রোঞ্জ মিশ্রিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন।
  • (২) সুলতান মহম্মদ অর্থ সঙ্কটের দরুন প্রতীক মুদ্রা চালু করেন একথা বরণীর নিজের রচনার দ্বারা সমর্থিত হয় নি। কারণ, বরণী বলেছেন যে, প্রতীক মুদ্রাগুলি অচল হলে সুলতান সেগুলি সরকারী রাজকোষে ফেরৎ দিয়ে তার বিনিময়ে স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে নিতে নির্দেশ দেন।
  • (৩) যদি মহম্মদের রাজকোষ শূন্য থাকে তবে কিভাবে তিনি প্রতীক মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রা পরিশোধ করেন। তবে তার ৩ লক্ষ ৭০ হাজার সেনা ও অন্যান্য কর্মচারীদের নগদ বেতন দিতে প্রচুর টাকার দরকার হত। এজন্য হয়ত তিনি নির্দেশক মুদ্রার কথা ভাবেন।

মহম্মদ বিন তুঘলক কর্তৃক চীন ও পারস্যের অনুকরণ

চীন-এ কুবলাই খান একদা “চাও” নামে কাগজের নোট চালু করেন এবং পারস্যে গাইখাতু খান প্রতীক মুদ্রা চালু করেন। উদ্ভাবনীপ্রিয় মহম্মদও অনুরূপভাবে ব্রোঞ্জের মুদ্রা চালু করেন।

মহম্মদ বিন তুঘলকের সময় রৌপ্য সংকট

  • (১) গার্ডনার ব্রাউন প্রমুখ গবেষকরা মনে করেন যে, চতুর্দশ শতকে বিশ্বে রৌপ্য সঙ্কট চলছিল। ভারত-এও রূপার সরবরাহ কম ছিল। রূপার ও সোনার মুদ্রার বিনিময় হার মহম্মদ যেভাবে স্থির করে দেন তা বিচার করলে দেখা যায় তাঁর আমলে রূপার সরবরাহ বেশ কম ছিল।
  • (২) গার্ডনার ব্রাউনের মতে, একমাত্র বাংলা থেকে কিছু রূপা দিল্লীতে সরবরাহ হত। মহম্মদ তার বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য-এর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক টাকশাল স্থাপন করেন। প্রতি টাকশালে রূপার চাহিদা মেটান সহজ ছিল না।
  • (৩) মোট কথা রূপার সরবরাহ প্রয়োজন অপেক্ষা কম থাকায়, সুলতান রূপার মুদ্রার স্থলে তামা বা ব্রোঞ্জের মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তার আমলের রূপার টাকাগুলি পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে তাতে রূপার পরিমাণ কম ছিল। এই ঘাটতি মেটাতে তিনি বিকল্প তামা বা ব্রোঞ্জের মুদ্রা চালু করেন।

সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের তাম্র মুদ্রার বিফলতা

  • (১) সুলতান মহম্মদের এই মুদ্রা নীতি সম্পূর্ণ বিফল হয়। বরণীর মতে, এই নতুন মুদ্রা নির্মাণে সরকারী একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় হিন্দুরা ব্যাপক এই তামার মুদ্রা জাল করে। প্রদেশেও ব্যাপকভাবে জাল মুদ্রা চালু হয়।
  • (২) সাধারণ লোকের পক্ষে আসল ও জাল মুদ্রা চেনা সম্ভব না হওয়ায় তারা এই মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে। দোকানদার ও ব্যবসায়ীরা তাম্রমুদ্রা নিতে অসম্মতি জানায়। সুলতান মুদ্রা জাল বন্ধ করতে অসমর্থ হলে এই মুদ্রা অচল হয়ে পড়ে।
  • (৩) ৪ বৎসরের মধ্যে মহম্মদ উপলব্ধি করেন যে, তার নীতি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি নির্দেশ দেন যে, যারা ইচ্ছা করবে তারা রাজকোষে এই মুদ্রা জমা দিয়ে বিনিময়ে স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রা নিতে পারবে। ফলে হিন্দুরা সরকারকে জাল টাকা জমা দিয়ে সোনার বা রূপার টাকা নিয়ে যায়।

মহম্মদ বিন তুঘলকের মুদ্রা সংস্কারের বিফলতার কারণ

সুলতান মহম্মদের মুদ্রা সংস্কার নীতির বিফলতার জন্যে বিশেষ কয়েকটি কারণের উল্লেখ করা যায়। যেমন –

  • (১) তিনি তার এই প্রতীকি মুদ্রা যাতে জাল না হতে পারে এজন্য উপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেন নি। জাল মুদ্রা প্রস্তুতকারীদের শাস্তিদানের কোনো ব্যবস্থাও তিনি করেননি। চীনের কাগজের মুদ্রা ‘চাও’ যাতে জাল না হয় তার জন্য চীন সম্রাট কুবলাই খান ব্যবস্থা নেন। মহম্মদ তা থেকে শিক্ষা নেন নি।
  • (২) ডঃ আগা মেহেদি হোসেনের মতে, সুলতানি যুগে সিংহাসনে ঘন ঘন রাজবংশের পরিবর্তন হত। সুতরাং মহম্মদের প্রবর্তিত তাম্র মুদ্রা তার পরবর্তী সুলতানরা বৈধ মুদ্রা হিসেবে স্বীকার করবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।
  • (৩)  মহম্মদ তাঁর তাম্র মুদ্রাকে রৌপ্য মুদ্রার সমান মূল্য ধরেন। লোকে আশঙ্কা করে যে মহম্মদের পরের সুলতান যদি এই তাম্র মুদ্রা স্বীকার না করেন, তবে এই মুদ্রার তামা গলিয়ে সম পরিমাণ রূপা কখনও পাওয়া যাবে না। এজন্য তারা এই মুদ্রাকে মেনে নিতে চায় নি।
  • (৪) সাধারণ অশিক্ষিত প্রজারা তামার মুদ্রাকে রূপার মুদ্রার সমান মূল্য দিতে রাজী হয়নি। তাদের আশঙ্কা হয় যে সুলতান তামার নোট দিয়ে তাদের রূপার মুদ্রাগুলি কেড়ে নিবেন। এজন্য পুরাতন সোনা-রূপার মুদ্রাগুলি লোকে লুকিয়ে ফেলে।
  • (৫) বিদেশী ইরানী ও ইরাকী বণিকরা মাল খরিদের সময় তাম্র মুদ্রা দিতে থাকে। কিন্তু তাদের আনীত মাল বিক্রির সময় তারা তাম্র মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে। কারণ, তাদের দেশে এই মুদ্রার কোনো মূল্য ছিল না। মহম্মদ ইরাক, ইরান বা চীন সরকারের সঙ্গে এই মুদ্রা বিনিময়ের জন্য কোনো চুক্তি করেন নি।

মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তনের ফলাফল

  • (১) মহম্মদের মুদ্রা সংস্কার নীতির ফলে জাল মুদ্রায় বাজার ছেয়ে যায়। সরকারে জমির খাজনার জন্য আসলের বদলে জাল মুদ্রা দেওয়া হয়। রাজকোষে এই মুদ্রা স্তূপের মত পড়ে থাকে। লোকের হাতে যে সোনার ও রূপার টাকা ছিল লোকে তা লুকিয়ে ফেলে তামার টাকায় মালপত্র কিনতে থাকে।
  • (২) খুৎ, মুকাদ্দমগণ তাদের প্রদেয় রাজস্ব জাল নোটে প্রদান করে। হিন্দু ও বিদ্রোহীরা টাঁকশাল তৈরি করে গোপনে জাল মুদ্রা তৈরি করে এবং তার দ্বারা শহর থেকে অস্ত্র, ঘোড়া ও অন্যান্য জিনিষ কিনে নেয়। বিদেশী বণিকরা জাল টাকার ভয়ে কিছুদিনের জন্য ভারতে মাল পাঠান বন্ধ করে।

উপসংহার :- যাই হোক মহম্মদের প্রবর্তিত তামার বা ব্রোঞ্জের মুদ্রায় অন্যায় কিছু ছিল না। তার একমাত্র দোষ ছিল যে তিনি এই মুদ্রার জাল বন্ধ করতে পারেন নি। তবে এজন্য রাজকোষ শূন্য হয় বরণীর এই কথা বিশ্বাস্য নয়। কারণ, ইবন বতুতা রাজকোষের অর্থ শূন্যতা লক্ষ্য করেননি।

(FAQ) মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সুলতান প্রতীকী মুদ্রা বা তামার নোট প্রবর্তন করেন?

মহম্মদ বিন তুঘলক।

২. কার অনুকরণে মহম্মদ বিন তুঘলক তামার নোট চালু করেন?

চিনের কুবলাই খান।

৩. মহম্মদ বিন তুঘলকের তামার নোট প্রবর্তনের কারণ কি ছিল?

রৌপ্য সংকট।

৪. মহম্মদ বিন তুঘলক কখন তামার নোট চালু করেন?

১৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment