আলাউদ্দিন খলজি

সুলতান আলাউদ্দিন খলজি প্রসঙ্গে রাজতান্ত্রিক আদর্শ, উত্তর ভারত অভিযান, দক্ষিণ ভারত অভিযান, করদ রাজ্য, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সংযোগ, আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার ও আলাই দরওয়াজা সম্পর্কে জানবো।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজি

ঐতিহাসিক চরিত্রআলাউদ্দিন খলজি
রাজত্ব ১২৯৬-১৩১৬ খ্রি:
প্রকৃত নামআলি গুরুশাস্প
উপাধিসিকান্দার-ই সানি
চিতোর জয়১৩০৩ খ্রি:
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি

ভূমিকা :- খলজি বংশ -এর শ্রেষ্ঠ সুলতান হলেন আলাউদ্দিন খলজি। তাঁর প্রকৃত নাম আলি গুরুশাস্প। তাঁর উপাধি ছিল ‘সিকন্দর-ই সানি বা বিশ্ববিজেতা’।

আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ হল তিনি রাজার দেবস্বত্ব ও সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, আর রাজনীতিকে ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে উলেমাদের প্রভাব অস্বীকার করেন এবং দরবারে মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন। ন্যায় ও পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করাই হল আলাউদ্দিনের রাজনৈতিক আদর্শের মূল কথা।

আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান

সুলতান আলাউদ্দিন উত্তর ভারত -এর বেশ কয়েকটি রাজ্য জয় করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

(১) গুজরাট জয়

আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট জয় করেন। তখন গুজরাটের রাজা ছিলেন বাঘেলা বংশীয় কর্ণদেব, রানি কমলাদেবী এবং কর্ণদেবের কন্যা দেবলাদেবী। গুজরাট ছিল অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ, এখানকার কৃষিক্ষেত্র ছিল উর্বর।

(২) রণথম্ভোর জয়

আলাউদ্দিন ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোর জয় করেন। তখন রণথম্ভোরের রাজা ছিলেন বীর হামিরদেব।

(৩) চিতোর জয়

আলাউদ্দিন ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে রানা রতন সিংহকে পরাজিত ও নিহত করে চিতোর জয় করেন। চিতোরের নতুন নাম দেন খিজিরাবাদ। অনেকের মতে আলাউদ্দিনের চিতোর অভিযানের পিছনে কারণ হল পদ্মিনী উপাখ্যান। এই কাহিনি মালিক মহম্মদ জয়সির পদ্মাবৎ কাব্যে প্রথম বর্ণিত হয়।

(৪) অন্যান্য রাজ্য জয়

এছাড়াও আলাউদ্দিন ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে মালব, ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে মারোয়াড় এবং ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে জালোর জয় করেন।

আলাউদ্দিন খলজির আক্রমণের সময় রাজপুত রমণীদের জহরব্রত

দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিনের আক্রমণের সময় চিতোর দুর্গের রাজপুত রমণীরা আত্মসম্মান রক্ষার জন্য জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে আত্মবিসর্জন দেন। আত্মসম্মান রক্ষার এই প্রথা ‘জহরব্রত’ নামে পরিচিত।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দক্ষিণ ভারত অভিযান

আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য অভিযান-এর প্রধান উদ্দেশ্য হল দক্ষিণ ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্য-এর বিস্তার ঘটানো এবং দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির ব্যাপক ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা। আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারতে যে সকল রাজাদের পরাজিত করেছিল তাঁরা হলেন –

  • (১) ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে দেবগিরির যাদববংশীয় রাজা রামচন্দ্রদের।
  • (২) ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে বরঙ্গল-এর কাকতীয় বংশীয় রাজা প্রতাপরুদ্রদেব।
  • (৩) ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে হোয়শল সাম্রাজ্য -এর রাজা তৃতীয় বীর বল্লাল।
  • (৪) ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে সুদূর দক্ষিণের পাণ্ড্য় রাজ্য -এর বীর পাণ্ড্য ও সুন্দর পাণ্ড্য।
  • (৫) ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার দেবগিরি জয় করেন। তখন রাজা ছিলেন শঙ্করদেব।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির করদ রাজ্য

আলাউদ্দিন উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি জয় করে সেগুলি সরাসরি দিল্লি সুলতানির প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে নিয়ে আসেন কিন্তু দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি জয় করে সেগুলি করদ রাজ্যে পরিণত করেন।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির প্রধান সেনাপতি মালিক কাফুর

মালিক কাফুর ছিলেন আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাপতি। দক্ষিণ ভারত জয়ের প্রধান কারিগর ছিলেন মালিক কাফুর। সুলতানের বার্ধক্যের সুযোগ নিয়ে কাফুর কিছুকালের মধ্যেই সর্বাত্মক রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সংযোগ

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে ভারতে এক বিস্তীর্ণ অংশে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।

আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার

আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল অল্প বেতনে বিশাল সেনাবাহিনী পালন এবং জনগণকে নায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করা। আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুটি স্তম্ভ হল – আলাউদ্দিন খলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা।

(১) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ

বাজারদর নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাউদ্দিনের পদক্ষেপগুলি হল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়। এইসব বিষয় তদারকি করার জন্য শাহানা-ই-মান্ডি’ ও ‘দিওয়ান-ই-রিয়াসৎ নামে কর্মচারী নিযুক্ত করেন।

(২) কর

আলাউদ্দিন খলজি প্রবর্তিত তিনটি কর হল চরাই, ঘরাই ও করছি। আলাউদ্দিনের গুপ্তচরদের বলা হত বারিদ।

(৩) সের-ই-আদল

মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য ‘সের-ই-আদল’ বাজার স্থাপন করেন। এই বাজারে বস্ত্র, চিনি, ঘি, জ্বালানি তেল, ঔষধপত্র প্রভৃতি সামগ্রী সরকারি নির্ধারিত ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হত।

(৪ ) দিওয়ান-ই-রিয়াসৎ

দিওয়ান ই-রিয়াসৎ হল সুলতান আলাউদ্দিন খলজি প্রতিষ্ঠিত বিশেষ বাণিজ্য দপ্তর। দিল্লির বাইরে থেকে আগত বণিকদের দিওয়ান-ই-রিয়াসতে নাম নথিভুক্ত করতে হত এবং ন্যায্যমূল্যের বাজার গুলিতে নির্দিষ্ট মূল্যে পণ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হত।

আলাউদ্দিন খলজির আলাই দরওয়াজা

আলাউদ্দিন খলজি ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে “আলাই দরওয়াজা” নির্মাণ করেন। এটি তুর্কি স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিনের রাজসভা অলংকৃত করেন ঐতিহাসিক ও কবি আমির খসরু যাকে ভারতের ‘তোতাপাখি’ বলা হয় এবং আমির হাসান যাকে ভারতের ‘সঙ্গী’ বলা হয়।

(FAQ) সুলতান আলাউদ্দিন খলজি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের তোতাপাখি কাকে বলা হয়?

আমীর খসরু।

২. সিকান্দার-ই-সানি নামে পরিচিত কে?

আলাউদ্দিন খলজি।

৩. আলাই দরওয়াজা নির্মাণ করেন কে?

আলাউদ্দিন খলজি।

৪. খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান কে?

আলাউদ্দিন খলজি।

Leave a Comment