অসহযোগ আন্দোলনের কারণ প্রসঙ্গে যুগান্তকারী ঘটনা, গণ আন্দোলন, নবযুগের সূচনা, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, অসহযোগ আন্দোলনের কারণ হিসেবে স্বায়ত্তশাসন লাভে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, খিলাফত সমস্যা সম্পর্কে জানবো।
অসহযোগ আন্দোলনের কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | অসহযোগ আন্দোলনের কারণ |
সময়কাল | ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
লক্ষ্য | স্বরাজ লাভ |
পন্থা | অহিংস অসহযোগ |
নেতা | মহাত্মা গান্ধী |
ভূমিকা:- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই বছরে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন এবং তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন -এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
যুগান্তকারী ঘটনা
দীর্ঘ ৩৫ বছরের ‘রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি’ বা আবেদন-নিবেদনের পথ ত্যাগ করে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান জানানো ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
গণ আন্দোলন
বস্তুত, এই আন্দোলন ছিল এক সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলন এবং এর লক্ষ্য ছিল ‘স্বরাজ’ অর্জন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ -এর পর এত ব্যাপক গণ-আন্দোলন আর দেখা যায় নি।
নবযুগের সূচনা
বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কংগ্রেস নেতা আচার্য জে.বি. কৃপালনী বলেন যে, অসহযোগ আন্দোলন কংগ্রেস ও জাতীয় ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে।
প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
এই সময় ‘আবেদন-নিবেদন ও প্রতিবাদের’ দিন শেষ হয়ে যায়। জনসাধারণ বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে ইতিবাচক ও ভয়হীন চিত্তে সমবেতভাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।
অসহযোগ আন্দোলনের কারণ
জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণের পেছনে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –
(ক) স্বায়ত্তশাসন লাভে ব্যর্থতা
- (১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রবল আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভারতবাসী তাতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সফল করার জন্য গান্ধীজির আহ্বানে ভারতীয়রা দলে দলে এই যুদ্ধে যোগদান করে এবং যুদ্ধ-তহবিলে প্রচুর অর্থ দান করে।
- (২) সেনাদলে যোগদান সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বলে ঘোষিত হলেও পাঞ্জাবের সামরিক শাসনকর্তা মাইকেল ও ডায়ার তা বাধ্যতামূলক ব্যবস্থায় পরিণত করেন। এই সময় কেবলমাত্র পাঞ্জাব থেকেই সংগৃহীত হয় ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার সেনা। প্রায় ১২১/২ লক্ষ ভারতীয় সেনা বিভিন্ন রণাঙ্গণে যুদ্ধে অংশ নেয় এবং ১০ হাজার মৃত্যুবরণ করে।
- (৩) যুদ্ধ তহবিলে ভারতবাসী ৬ কোটি ২১ লক্ষ পাউণ্ড চাঁদা দেয়। ভারতের জাতীয় ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ৩০% এবং এই দায় বহন করতে হয় ভারতবাসীকেই।
- (৪) ভারতবাসী আশা করেছিল যে, যুদ্ধান্তে তাদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে, কিন্তু যুদ্ধের অবসানে দেওয়া হল মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার যা ভারতীয়দের কাছে ছিল “তুচ্ছ, বিরক্তিকর ও নৈরাশ্যজনক”। তাই দাবি আদায়ের জন্য ভারতীয়রা অন্য পথ গ্রহণে বাধ্য হয়।
(খ) অর্থনৈতিক সঙ্কট
- (১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেশবাসীকে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। খাদ্যাভাব, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ফাটকাবাজি ও বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করে। কাপড়, ওষুধ, চিনি প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে পড়ে।
- (২) ১৯১৩খ্রিস্টাব্দে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ১৪৩%, ১৯১৭-তে ১৯৬% এবং ১৯২০-তে ২৮১%। ১৯১১-তে যেখানে একজোড়া ধুতির দাম ছিল ১ টাকা ১২ আনা, ১৯১৮-তে তার দাম হয় ৬ টাকা। মোটা চাল, গম, বাজরার মূল্য ভয়াবহরূপে বৃদ্ধি পায়।
- (৩) এই সময় ভূমি-রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষক স্বল্পমূল্যে মহাজনদের কাছে কৃষিজাত দ্রব্যাদি বিক্রি করতে বাধ্য হয়, আবার তাকেই অধিক মূল্যে শিল্পজাত দ্রব্যাদি কিনতে হয়।
- (৪) শিল্পদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায় নি। খাদ্যদ্রব্যের দাম ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকদের মজুরি কিন্তু ১৫ শতাংশও বাড়ে নি। এ ছাড়া ছিল করভার ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। এর ফলে শ্রমিকদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে ওঠে।
- (৫) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ব্রিটিশ পণ্যাদির আমদানি বন্ধ হওয়ায় সরকার ভারতীয়দের শিল্প-বিস্তারে উৎসাহ দেয়, কিন্তু যুদ্ধান্তে সেগুলির ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বাধা দেয়। মন্দা ও শ্রমিক ছাঁটাই শ্রমিকদের সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়।
- (৬) বিশিষ্ট মার্কসবাদী পণ্ডিত রজনীপাম দত্ত (R,P Dutt) বলেন যে, দেশের অভ্যন্তরে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের ফলে কংগ্রেসের পক্ষে আর সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই গান্ধীজি গণ-অসন্তোষকে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের পথে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
(গ) আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
- (১) সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে। রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী ও সাধারণ মানুষের জয়লাভ ভারতে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতীয়রা উপলব্ধি করে যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারাও জয়যুক্ত হতে পারে।
- (২) এ সম্পর্কে মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন -এর রিপোর্টে বলা হয় যে, “রুশ বিপ্লব স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক বিজয় হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল এটি ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বহু ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছিল।”
- (৩) আয়ারল্যাণ্ডের ‘সিনফিন’ আন্দোলন ও মাইকেল কলিন্সের নেতৃত্বে আইরিশ গেরিলাদের দুর্বার ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম ভারতীয়দের নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে। মিশর-এ জগলুল পাশার নেতৃত্বে প্রবল ব্রিটিশ-বিরোধী গণ-আন্দোলন ভারতবাসীর মনে নতুন প্রেরণা জোগায়।
- (৪) এই সময় দূর প্রাচ্যে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চীন-এর জনগণ জাপান-এর পণ্য বয়কটের আন্দোলন শুরু করে। এই সব ঘটনা ভারতবাসীর মনে বিরাট আলোড়ন তোলে।
(ঘ) রাওলাট আইন
- (১) ভারতীয় বিপ্লববাদ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার রাওলাট আইন পাশ করতে উদ্যোগী হয়। এই আইনে স্থির হয় যে, সরকার-বিরোধী যে-কোনো প্রচার দণ্ডনীয় বলে বিবেচিত হবে।
- (২) সন্দেহভাজন যে-কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে, বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল তাদের বন্দি করে রাখা বা নির্বাসন দেওয়া যাবে, বিনা সাক্ষ্য-প্রমাণে বিশেষ আদালতে তাদের বিচার হবে এবং এই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাবে না। এই আইনের দ্বারা সংবাদপত্রের কণ্ঠও রোধ করা হয়।
- (৩) কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভারতীয় সদস্যদের সমবেত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ এই আইনটি পাশ হয়। ভারতবাসী ক্ষোভে-রোষে ফেটে পড়ে।
- (৪) গান্ধীজি এই আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইনকে ‘অসহযোগ আন্দোলনের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
(ঙ) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
- (১) রাওলাট আইনের প্রতিবাদে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তার চরম পরিণতি দেখা দেয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড -এ।
- (২) জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র জনসমাবেশের ওপর গুলি চালনা, নারী, বৃদ্ধ ও শিশুসহ নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা এবং তার পরবর্তীকালে অমৃতসর- সহ পাঞ্জাবের পাঁচটি জেলায় সামরিক আইন জারি এবং সাধারণমানুষের ওপর বর্বরোচিত আচরণ সারা দেশে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করে।
- (৩) ব্রিটিশ রাজনীতিজ্ঞ চার্চিল এই ঘটনাকে ‘অতি অস্বাভাবিক, অতিপাশবিক’ বলে অভিহিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘৃণাভরে সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। গান্ধীজি বলেন যে, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে”।
(চ) খিলাফৎ সমস্যা
- (১) ‘খিলাফৎ’ সমস্যাও অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। ভারতীয় মুসলিমরা তুরস্ক-এর সুলতানকে ‘খলিফা’ বা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু বলে মনে করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যোগদান করে। এর ফলে ইংল্যান্ড তুরস্কের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে বাধ্য হয়।
- (২) যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে তার ওপর শাস্তির খাড়া নেমে আসে। মিত্রপক্ষ তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং সুলতানের ক্ষমতাও যথেষ্ট খর্ব করে। এর ফলে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
- (৩) ‘খলিফা’-কে তাঁর হৃাতমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলিমরা যে আন্দোলন শুরু করেন, তা খিলাফৎ আন্দোলন নামে পরিচিত। গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলন -এর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সুযোগ দেখতে পান।
- (৪) গান্ধীজি মনে করেন যে, মুসলিম সমাজের খিলাফৎ আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে ইংরেজ অনুসৃত বিভেদ নীতি ব্যর্থ হবে এবং সরকারের ওপর চাপ দিয়ে ‘স্বরাজ’ লাভ সহজতর হবে। তাঁর মতে “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এমন সুযোগ একশ বছরেও আর আসবে না।”
উপসংহার:- এই সব কারণে তিনি খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান এবং এই দাবির সমর্থনে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন।
(FAQ) অসহযোগ আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মহাত্মা গান্ধী, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে।
খিলাফত আন্দোলন।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।