মেটারনিখ ব্যবস্থা বা মেটারনিখ তন্ত্র বা মেটারনিখ পদ্ধতি প্রসঙ্গে নীতি, স্থিতাবস্থার রাষ্ট্রনেতা, পুরাতন তন্ত্র, পরিবর্তন বিরোধী, শক্তি সমবায় গঠন, অরাজকতা ও নাশকতা, সমাজ ও সভ্যতার গ্ৰাস, গণতন্ত্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, অস্ট্রিয়ার অবস্থা, মেটারনিখের উপলব্ধি, বিপ্লবী ভাবধারা, রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ, আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্য, মেটারনিখ ব্যবস্থা কথাটির যৌক্তিকতা, অস্ট্রিয়ায় মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রয়োগ, জার্মানিতে মেটারনিখতন্ত্র, ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্র, ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার জনক, মেটারনিখ তন্ত্রের পতন, মেটারনিখ তন্ত্রের পক্ষে যুক্তি, বিপক্ষে যুক্তি ও মেটারনিখ তন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জানবো।
মেটারনিখ ব্যবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | মেটারনিখ ব্যবস্থা |
মেটারনিখের যুগ | ১৮১৫-১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ |
ভিয়েনা সম্মেলন | ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ |
ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি | প্রিন্স মেটারনিখ |
মেটারনিখের পতন | ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ |
ইউরোপ-এর প্রধানমন্ত্রী | প্রিন্স মেটারনিখ |
ভূমিকা :- সবরকম প্রগতি-বিরোধী ও ঘোরতর রক্ষণশীল রাজনীতিক ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ। তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি।
মেটারনিখের নীতি
তিনটি নীতির দ্বারা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভাবিত হয়েছিল। যেমন –
- (১) ইউরোপের প্রাক্-বিপ্লব যুগের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন।
- (২) ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত উদারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার গতিরোধ।
- (৩) অস্ট্রিয়ার স্বার্থকে সর্বতোভাবে বজায় রেখে ইউরোপীয় রাজনীতিতে তাঁর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা।
মেটারনিখ ব্যবস্থা
নীতি বা আদর্শগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য তিনি যে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন তা ‘মেটারনিখ ব্যবস্থা’, ‘মেটারনিখ পদ্ধতি, ‘মেটারনিখতন্ত্র’ বা ‘মেটারনিখ সিস্টেম’ নামে পরিচিত।
টমসনের মন্তব্য
ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন-এর মতে, মেটারনিখ ব্যবস্থা হল অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার এক ‘মাস্টার প্ল্যান’।
স্থিতাবস্থার রাষ্ট্রনেতা
এই ব্যবস্থার মূল কথা হল পরিবর্তনহীনতা বা স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। তিনি নিজেকে ‘স্থিতাবস্থার রাষ্ট্রনেতা’ (‘the man of status quo ‘) বলে অভিহিত করতেন।
পুরাতন তন্ত্র
তাঁর মতে পুরাতন তন্ত্রই হল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃত ভিত্তি। তিনি প্রাক্-বিপ্লব যুগের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, রাজার দৈবস্বত্ব, অভিজাততন্ত্র, সামন্ততন্ত্র এবং ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন। এই কারণেই ভিয়েনা সম্মেলনে ‘ন্যায্য অধিকার নীতির’ দ্বারা প্রাক্-বিপ্লব যুগের রাজবংশগুলিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শাসন ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।
পরিবর্তন বিরোধী
তিনি সবরকম পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন। এই কারণে এইসব রাজন্যবর্গের প্রতি তাঁর পরামর্শ ছিল, “রাজত্ব করুন, কিন্তু কোনোরকম পরিবর্তন বা সংস্কার করবেন না” (“Govern and change nothing”)।
ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গঠন
পুরাতন তন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি ‘ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গঠন করেন।
অরাজকতা ও নাশকতা
ফরাসি বিপ্লব ও বিপ্লব-প্রসূত ভাবধারাগুলিকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তাঁর কাছে এগুলি ছিল ‘রাজনৈতিক মহামারী’ ও ‘অরাজকতার দূত’। তাঁর চোখে ফরাসি বিপ্লব ছিল ‘ঘোরতর অরাজকতা ও নাশকতা’।
সমাজ ও সভ্যতার গ্ৰাস
তাঁর মতে ফরাসি বিপ্লব হল ‘চিকিৎসা-সাপেক্ষ এক মহাব্যাধি’, ‘নির্বাপণযোগ্য এক আগ্নেয়গিরি’, ‘উত্তপ্ত লৌহদণ্ড দ্বারা দগ্ধ করার মতো এক দুষ্টক্ষত’ এবং ‘সহস্র মুখবিশিষ্ট এক মহাদানব’—যার উন্মুক্ত মুখগহ্বর সমাজ ও সভ্যতাকে গ্রাস করতে উন্মুখ।
গণতন্ত্র
তাঁর মতে, “গণতন্ত্র প্রকাশ্য দিবালোককে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিতে পরিণত করে।” তিনি মনে করতেন যে, রাজা ও অভিজাতরাই সমাজ ও সভ্যতার ধারক। তাঁরাই সমাজের চালিকা শক্তি এবং একমাত্র তাঁরাই স্বার্থহীনভাবে রাষ্ট্রের সেবা করতে পারে। ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত ভাবধারা এই শ্রেণিকে ধ্বংস করে সভ্যতাকে বিনষ্ট করবে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণী
ফরাসি বিপ্লব মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাগরণ ঘটায়। তাঁর মতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হল ‘নৈতিক ক্ষত’ (‘moral gangrene)। তাঁর মতে নিয়মতান্ত্রিক শাসন, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি, অবাধ বাণিজ্য, জাতীয় রাষ্ট্র—মধ্যবিত্ত শ্রেণির এইসব ভাবধারা সভ্যতা-বিরোধী অশুভ শক্তি। তিনি মনে করতেন অভিজাত সম্প্রদায়কে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণি এইসব মতবাদ প্রচার করছে।
অস্ট্রিয়ার অবস্থা
- (১) মেটারনিখ ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী। বহু জাতি, ভাষাগোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বী মানুষকে নিয়ে গঠিত হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল খুবই শিথিল ও দুর্বল।
- (২) অস্ট্রিয়া একটি জার্মান রাষ্ট্র হলেও সেখানে হাঙ্গেরিয়ান, চেক, পোল, স্লাভ, ম্যাগিয়ার, বোহেমীয় প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করত। জার্মান রাষ্ট্রভাষা হলেও অন্যান্য ভাষাভাষা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না।
- (৩) ক্যাথলিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রোটেস্ট্যান্টের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের একমাত্র ঐক্যের বন্ধন ছিল সম্রাটের প্রতি প্রজাদের আনুগত্য।
- (৪) গ্রান্ট ও টেম্পারলি বলেন যে, অস্ট্রিয়া কোনও জাতি নয়, এটি হল একটি রাজতান্ত্রিক যন্ত্র-বিশেষ। অস্ট্রিয়ার সমাজে ভূমি-নির্ভর অভিজাতদের প্রাধান্য ছিল। দেশের অধিকাংশ ছিল অধিকারহীন কৃষক। এখানে কোনও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না।
মেটারনিখের উপলব্ধি
মেটারনিখ উপলব্ধি করেন যে, ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, জাতিবর্গের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রভৃতির আদর্শ যদি অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে, তাহলে হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।
বিপ্লবী ভাবধারা
তার মতে বিপ্লবী ভাবধারা হল ‘জীবাণু’-র মতো, যা সমস্ত ইউরোপের স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে, অর্থাৎ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ
এই কারণে কেবল অস্ট্রিয়ায় রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করে আশু ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচা যাবে না, সমগ্ৰ ইউরোপেই তার অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্য
মেটারনিখের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন-রক্ষণশীলতা ও স্থিতাবস্থার নীতি কায়েম করে সমগ্ৰ ইউরোপে বৈপ্লবিক ভাবধারাকে প্রতিহত করা।
মেটারনিখ ব্যবস্থা কথাটির যৌক্তিকতা
- (১) জন লো (John Lowe), কাইটেল (Kittel) প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, মেটারনিখ সচেতনভাবে কোনও ব্যবস্থা বা system গড়ে তোলেন নি বা তাঁর নীতিগুলি কার্যকর করার জন্য তিনি বাঁধাধরা কোনও ছক অনুসরণ করতেন না।
- (২) তাঁর নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল, এবং এই বিশ্বাসগুলি কার্যকর করার জন্য তিনি প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নীতি নেন। সুতরাং ‘মেটারনিখ ব্যবস্থা’ কখনোই বাঁধাধরা কোনও ছক নয়—যদিও তা তাঁর অনুসৃত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অস্ট্রিয়ায় মেটারনিখ নীতির প্রয়োগ
- (১) মেটারনিখ নিজ রাজ্য অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে অতি সাফল্যের সঙ্গে এই নীতি প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। বহু জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষী মানুষের দেশ অস্ট্রিয়ায় তিনি বিভেদনীতি প্রয়োগ করে এক জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে লেলিয়ে দেন।
- (২) বোহেমিয়া শাসনের জন্য তিনি জার্মান বাহিনী মোতায়েন করেন এবং লম্বার্ডিতে রাখেন হাঙ্গেরীয় বাহিনী। দমন পীড়ন দ্বারা জাতীয়তাবাদীদের কণ্ঠরোধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে এনে উদারপন্থী ছাত্র ও অধ্যাপকদের কারারুদ্ধ করা হয়।
- (৩) ছাত্র ও অধ্যাপকদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত হয়—এমনকী শ্রেণিকক্ষেও গোয়েন্দা পাঠানো হয়। ছাত্ররা যাতে উদারপন্থা দ্বারা প্রভাবিত হতে না পারে সেজন্য পাঠ্যসুচির পরিবর্তন করা হয়।
- (৪) ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ হয়। বিশেষ অনুমতি ব্যতীত বিদেশি পুস্তক, সংবাদপত্র ও অধ্যাপকদের অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়।
- (৫) অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে একটি ইউরোপীয় তথ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গোপন সংবাদ এখানে সংগ্রহ করা হত। অস্ট্রিয়ার ডাক বিভাগ মানুষের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র খুলে দেখত। রাজনৈতিক সভা-সমিতি নিষিদ্ধ হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং বাক্-স্বাধীনতা খর্ব করা হয়।
জার্মানিতে মেটারনিখ তন্ত্র
- (১) জার্মান ‘বুন্ড’ বা রাজ্য সমবায়ের সভাপতি হিসেবে অস্ট্রিয়া জার্মানিতেও রক্ষণশীল নীতি প্রবর্তন করে। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কুখ্যাত ‘কার্লসবার্ড ডিক্রি’ বা হুকুমনামা করে জার্মানির রাজনৈতিক দল ও বুরশেনস্যাফটেন (Burschenschaften)-এর মতো ছাত্র সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়।
- (২) উদারপন্থী অধ্যাপকরা বিতাড়িত হন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে বিজ্ঞান শিক্ষা বাদ দেওয়া হয়, বুদ্ধিজীবী আর্নট ও ফিক্টে রাজরোষে পড়েন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
- (৩) ছাত্র ও অধ্যাপকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হয়, মেটারনিখের দমননীতিকে কার্যকর করার জন্য জার্মানির মেইনজ শহরে একটি সদর দপ্তর খোলা হয় এবং জার্মান সংবিধানের ১৩ নং ধারা রহিত করা হয়।
ইউরোপে মেটারনিখ তন্ত্র
- (১) প্রাক্-বিপ্লব অবস্থা বজায় রাখা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ভিয়েনা সম্মেলনের অব্যবহিত পরেই ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা ‘কনসার্ট অব ইউরোপ’ গঠিত হয়। মেটারনিখের উদ্যোগে এই শক্তি সমবায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল যন্ত্রে পরিণত হয়। এর কাজই হল দমন-পীড়ন দ্বারা সমস্ত প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা।
- (২) ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে শক্তি সমবায়ের ট্রপো বৈঠকে ট্রপোর ঘোষণাপত্র দ্বারা বলা হয় যে, প্রজাদের সরকার পরিবর্তনের অধিকার নেই—কোনও দেশে বিপ্লব ঘটলে শক্তি সমবায় সেখানে হস্তক্ষেপ করে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনবে।
- (৩) এই ঘোষণা অনুসারে শক্তি সমবায় ইতালির নেপলস্ ও পিডমন্টের প্রজা-বিদ্রোহ এবং শক্তি সমবায়ের নির্দেশে ফ্রান্স স্পেন-এর উদারনৈতিক আন্দোলন দমন করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব -এর ফলে ইতালির পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যে গণ-আন্দোলন দেখা দিলে মেটারনিখ তা দমন করেন।
- (৪) ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রিস-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে রাশিয়া -র জার প্রথম আলেকজান্ডার সাহায্য করতে উদ্যোগী হলে মেটারনিখ তাঁকে নিবৃত্ত করেন। তাঁরই নির্দেশে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় ফ্রান্সকে স্পেনের বিদ্রোহ দমনের ভার দেয়।
ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার জনক
মেটারনিখ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি সারা ইউরোপে এক প্রতিক্রিয়াশীল শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। এজন্য তাঁকে ‘ইউরোপের প্রধানমন্ত্রী’ বা ‘ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার জনক’ বলে অভিহিত করা হয়।
মেটারনিখ তন্ত্রের পতন
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব -এর আঘাতে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে এবং মেটারনিখ ইংল্যান্ড -এ আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মেটারনিখতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি
ইউরোপের মেটারনিখতন্ত্রের সমর্থনে বলা যায় যে,
- (১) ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়ন -এর যুদ্ধের কারণে ইউরোপে দীর্ঘকাল কোনও শান্তি ছিল না। এই সময় ইউরোপের মানুষের কামনা ছিল শান্তি, স্বাধীনতা নয়।
- (২) ঐতিহাসিক ফেরেরো (Ferrero), রিটার ভন শ্রাবিক ( Ritter Von Shrabik), পিটার ভিরেক (Peter Viereck) প্রমুখের মতে, মেটারনিখ বিপ্লব-পীড়িত ও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউরোপকে অন্তত ত্রিশ বছরের জন্য শান্তি দিয়েছিলেন। এই শান্তির পর্বে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যথেষ্ট বিকাশ ঘটে।
- (৩) ঐতিহাসিক কেটেলবি বলেন, “তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ার মন্ত্রী। সুতরাং অস্ট্রিয়ার স্বার্থরক্ষাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।” বহু জাতি ও ভাষাভাষীর মানুষ-অধ্যুষিত অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য রক্ষণশীলতা ভিন্ন অন্য কোনও উপায় ছিল না।
মেটারনিখতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তি
- (১) মেটারনিখ পদ্ধতি ছিল নেতিবাচক, সংকীর্ণ, প্রতিক্রিয়াশীল, দমনমূলক ও অনৈতিক। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিক মেটারনিখ যুগধর্মকে উপেক্ষা করে ইতিহাসের গতির বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
- (২) তিনি কেবল ফরাসি বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক রূপই দেখেছিলেন, বিপ্লব-প্রসূত ভাবধারা – গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও উদারতন্ত্রের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন নি। নতুন যুগের আগমন-ধ্বনি তিনি শুনতে পান নি—ক্ষয়িষ্ণু পুরোনো ধ্যান-ধারণাকেই তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন।
- (৩) ঐতিহাসিক এলিসন ফিলিপস্ (Alison Philips) বলেন, “তিনি বার্ধক্যদশাগ্রস্ত হলেও পৃথিবী প্রতিদিন নব যৌবন লাভ করছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি তাঁর নীতি চালু রেখে ভুল করেন।”
মেটারনিখ ব্যবস্থার ব্যর্থতা বা পতনের কারণ
মেটারনিখ ও তাঁর পদ্ধতির পতন অনিবার্য ছিল। তার ব্যর্থতা বা পতনের কারণ গুলি হল –
- (১) মেটারনিখ যে যুগের মানুষ ছিলেন, তার যুগধর্ম ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও উদারতন্ত্র। তিনি যুগধর্মকে অস্বীকার করে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুরাতনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এটি তাঁর প্রধানতম ত্রুটি।
- (২) দমন-পীড়নের মাধ্যমে নবজাগ্রত ব্যর্থতার কারণ আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে কিছুদিনের জন্য হয়তো দমিয়ে রাখা যেত, কিন্তু তাদের জয় ছিল অনিবার্য। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে তিনি এই জিনিসটি বুঝতে পারেন নি।
- (৩) রাসেল (Russell) মন্তব্য করেছেন যে, নবজাগ্রত জাতীয়তার আদর্শই তাকে পরাজিত করেছিল। ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে ইতিহাসের গতি ঘোরাতে গিয়ে তিনি মৃত্যুফাঁদে জড়িয়ে যান।
- (৪) শিল্প বিপ্লব, জনসংখ্যার চাপ, নগরজীবনের প্রসার, বুর্জোয়াদের প্রাধান্য ইউরোপের জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। নতুন এই যুগচেতনার কাছে মেটারনিখের অষ্টাদশ শতকের আদর্শ সম্পূর্ণ বেমানান ছিল।
উপসংহার :- মেটারনিখ নিজেই বলেছেন, “এই পৃথিবীতে হয় কিছু আগে বা কিছু পরে আমার আসা উচিত ছিল। কিছু আগে এলে আমি জগৎকে উপভোগ করতে পারতাম, কিছু পরে এলে জগতের পুনর্গঠনের শরিক হতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্ব বজায় রাখতে আমাকে জীবনপাত করতে হচ্ছে।”
(FAQ) মেটারনিখ ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮১৫-১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ।
প্রিন্স মেটারনিখ।
প্রিন্স মেটারনিখ।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব।