ফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের প্রভাব প্রসঙ্গে ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রভাব হিসেবে স্বৈরাচার ধ্বংস, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ফরাসি জাতির রাজা, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের বন্দোবস্ত রদ, গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠিত, বুর্জোয়াদের ক্ষমতা দখল, শিল্প বিপ্লবের সূচনা, শ্রমিক শ্রেণীর জাগরণ, ফ্রান্সের বাইরে প্রভাব হিসেবে মেটারনিখের মন্তব্য, মিশেলের মন্তব্য, ফিশারের মন্তব্য, বেলজিয়ামের স্বাধীনতা লাভ, জার্মানির জাগরণ, ইতালিতে গণ আন্দোলন, পোল্যাণ্ডে স্বাধীনতা আন্দোলন ও ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে জানবো।

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

ঐতিহাসিক ঘটনাফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের প্রভাব
সময়কাল১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ
রাজাদশম চার্লস
প্রধানমন্ত্রীপলিগন্যাক
নেতাএডলফ থিয়ার্স
ফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

ভূমিকা:- জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ঐতিহাসিক লিপসন-এর মতে, “ফ্রান্সের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে।”

ফ্রান্সের অভ্যন্তরে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

ফ্রান্সের আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব ছিল নিম্নরূপ।

(১) স্বৈরাচার ধ্বংস

ঐতিহাসিক গর্ডনক্রেইগ (GordonCraig) বলেন যে, দশম চার্লসের আমলে যে স্বৈরাচার স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল জুলাই বিপ্লব তা ধ্বংস করে।

(২) নিয়ম তান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্স -এ স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজবংশের পতন ঘটে এবং অর্লিয়েন্স রাজবংশের অধীনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাজা ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত নন—তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মাত্র এবং জনগণই হল প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

(৩) ফরাসি জাতির রাজা

বিপ্লবের পর রাজা লুই ফিলিপ একটি সনদ গ্রহণ করেন। তার রচয়িতা ছিলেন জনগণ, রাজা নন। তিনি‘ ফ্রান্সের রাজা নয়—‘ফরাসি জাতির রাজা উপাধি ধারণ করেন এবং বিপ্লবের ত্রিবর্ণ-রঞ্জিত পতাকা গ্রহণের দ্বারা ফরাসি জাতি ও জনগণের জয় ঘোষণা করেন।

(৪) ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের বন্দোবস্ত রদ

জুলাই বিপ্লব ভিয়েনা সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত ‘ন্যায্য অধিকার নীতির’ উপর প্রবল আঘাত হানে এবং তার অসারতা প্রমাণ করে। হ্যাজেন বলেন যে, এই বিপ্লব ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের বন্দোবস্তকে বানচাল করে দেয়।

(৫) গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠিত

লিপসন বলেন, “১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব প্রকৃত পক্ষে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব -এর পরিপূরক।” এই বিপ্লবের ফলেই সাম্য, ধর্ম নিরপেক্ষ শাসন, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক নীতি ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লব অভিজাততন্ত্র, যাজকতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের উপর প্রবল আঘাত হানে।

(৬) বুর্জোয়াদের ক্ষমতা দখল

এই বিপ্লবের ফলে যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রাধান্য স্থাপন বা পুরাতনতন্ত্রের পুনঃস্থাপনের সব উদ্যোগ চিরতরে ব্যর্থ হয় এবং ধনী বুর্জোয়া সম্প্রদায়ই রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করে।

(৭) শিল্প বিপ্লবের সূচনা

গর্ডন ক্রেইগ বলেন যে, জুলাই বিপ্লবের পর ফ্রান্স এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয় যাতে ধনী বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। তাদের মাধ্যমে ফ্রান্সের অর্থনীতি নবজীবন লাভ করে এবং ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব-এর সূচনা হয়।

(৮) শ্রমিক শ্রেণীর জাগরণ

জুলাই বিপ্লব শ্রমিক শ্রেণির জাগরণ ঘটায়। অধ্যাপক হবসবম (Hobsbowm) বলেন যে, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের গণ-বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল ‘ব্যারিকেড’ এবং এই পদ্ধতির প্রধান শক্তি ছিল শ্রমিক শ্রেণি। জ্যাক ড্রজ বলেন যে, “আত্মশক্তি সম্পর্কে শ্রমিকদের সচেতন করার ক্ষেত্রে জুলাই বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”

(৯) চিন্তা জগতে প্রভাব

(ক) এই বিপ্লব ফ্রান্সের চিন্তাজগতকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। রোমান্টিক লেখকরা জাতীয় স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের জয়গান করে সাহিত্য রচনা শুরু করেন।

(খ) ভিক্টর হুগো বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের ছবি তুলে ধরেন। মহিলা ঔপন্যাসিক জর্জ স্যান্ড নারীমুক্তির কথা লিখতে থাকেন। সেন্ট সাইমন সামাজিক ন্যায়ের আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। লা-মার্টিন, ভিগনে, মাসেট, বালজাক প্রমুখ সাহিত্যিকরা নিজ নিজ সাহিত্য-কীর্তি নিয়ে আবির্ভূত হন।

ফ্রান্সের বাইরে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

জুলাই বিপ্লবের ঢেউ ফ্রান্সের সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপ-এর নানা দেশে আছড়ে পড়ে।

(১) মেটারনিখের মন্তব্য

মেটারনিখ ব্যঙ্গ করে বলেন যে, “ফ্রান্সের সর্দি হলে ইউরোপের হাঁচি হয়। মিশলে (Michelet) ও কুইনেট (Quinet) ফ্রান্সকে’ বিপ্লবের অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করেন।

(২) মিশলের মন্তব্য

ঐতিহাসিক মিশলে-র মতে, ফ্রান্স হল মানবতারূপ জাহাজের কাণ্ডারী (“Thepilotoftheshipofhumanity)।

(৩) ফিশারের মন্তব্য

ঐতিহাসিক ফিশার বলেন যে, “প্যারিসের চুল্লি থেকে উড়ন্ত অগ্নিকণা শক্তি সমবায়-শাসিত ইউরোপের কাষ্ঠখণ্ডের উপর পড়ে এক দাবানলের সৃষ্টি করে।”

(৪) বেলজিয়ামের স্বাধীনতা লাভ

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সন্ধির দ্বারা বেলজিয়ামবাসীর দাবি উপেক্ষা করে বেলজিয়ামকে নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সুযোগে বেলজিয়ামবাসী হল্যান্ডের সঙ্গে তাদের সংযুক্তি নাকচ করে স্বাধীন হয়ে যায়।

(৫) জার্মানির গণজাগরণ

জার্মানিতে ব্যাপক গণ-জাগরণ দেখা দেয়। জার্মানির স্যাক্সনি, হ্যানোভার, হেস, ব্যাডেন, ব্যাভেরিয়া প্রভৃতি স্থানের জনগণ জোর করে শাসকদের কাছ থেকে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র আদায় করলেও মেটারনিখের চাপে শেষ পর্যন্ত আবার স্বৈরতন্ত্রই ফিরে আসে।

(৬) ইতালিতে গণ আন্দোলন

ইতালির পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যে শাসন সংস্কারের দাবিতে গণ-আন্দোলন মেটারনিখের চাপে স্তব্ধ হয়ে যায়।

(৭) পোল্যাণ্ডে স্বাধীনতা আন্দোলন

রুশ অধিকৃত পোল্যান্ড-এ স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে জার প্রথম আলেকজান্ডার নিষ্ঠুর দমননীতির মাধ্যমে তা স্তব্ধ করে দেন।

(৮) ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন

জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে ইংল্যান্ড-এ চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয়।

(৯) অন্যান্য দেশে প্রভাব

স্পেন, পর্তুগাল ও সুইজারল্যান্ডে উদার নৈতিক শাসন-সংস্কার প্রবর্তিত হয়। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, এই বিপ্লবের ফলে ইউরোপ দুটি আদর্শগত শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যথা –

(ক) রাইন নদীর পশ্চিম তীরের দেশগুলি রক্ষণশীলতা ত্যাগ করে উদারপন্থার প্রতি আনুগত্য জানায়। এই অঞ্চলে বুর্জোয়া শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়।

(খ) রাইনের পূর্ব তীরের দেশগুলি স্বৈরতন্ত্রের অধীনে থাকে। এই অঞ্চলে ক্ষমতা থাকে অভিজাতদের হাতে।

উপসংহার:- বস্তুত, জুলাই বিপ্লব ইউরোপের সর্বত্র বিপ্লবী ভাবধারাকে জাগ্রত করলেও কোথাও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে পারেনি। একমাত্র বেলজিয়াম ভিন্ন ইউরোপের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা কোথাও পরিতৃপ্ত হয়নি। তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে জুলাই বিপ্লবের ফলে ইউরোপের উপর প্রসারিত মেটারনিখের বজ্রমুষ্ঠিতে আঘাত লাগে, এবং এই বিপ্লব হল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বৃহত্তর বিপ্লবের প্রস্তুতি-পর্ব।

(FAQ) ফ্রান্সে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কখন কোথায় জুলাই বিপ্লবসংঘটিত হয়?

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ফ্রান্সে।

২. জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে কোন রাজার পতন ঘটে?

দশম চার্লস।

৩. জুলাই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেন কে?

অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ।

৪. জুলাই বিপ্লবের সময় কোন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে?

বেলজিয়াম।

Leave a Comment