গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে কৃষি, জমির ভাগ, অগ্ৰহার, রাজস্ব, উৎপন্ন ফসল, জলসেচ ব্যবস্থা, বস্ত্র ও রেশম শিল্প, বাণিজ্য, নিগম প্রথা, মুদ্রা ও সাধারণ লোকের আর্থিক দুরবস্থা সম্পর্কে জানবো।

গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাগুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা
সাম্রাজ্যগুপ্ত সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতাশ্রীগুপ্ত
শ্রেষ্ঠ রাজাসমুদ্রগুপ্ত
শকারিদ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা

ভূমিকা :- প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাদান থেকে দেখা যায় যে গুপ্ত যুগে অর্থনৈতিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল। তবে এই যুগের শেষের দিকে অর্থনীতির অবক্ষয় লক্ষ্য করা যায়।

গুপ্ত যুগে কৃষি

ভারতের গুপ্ত যুগে লোহার পূর্ণ ব্যবহারের ফলে এবং জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কৃষির বিশেষ উন্নতি হয়। সিন্ধু-গাঙ্গেয়-যমুনা উপত্যকায় লোকবসতি বিস্তার বেড়ে যায়। এই কারণে গুপ্ত যুগে গ্রাম ও বিষয়ভিত্তিক শাসনের প্রাধান্য বেড়ে যায়।

গুপ্ত যুগে জমির ভাগ

এই সময় জমিগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হত। যথা –

  • (ক) রাষ্ট্রের মালিকানাধীন অকর্ষিত জমি। রাজা কর্মচারীদের এই জমি বেতনের পরিবর্তে দিতেন।
  • (খ) সীতা জমি বা সরকারি মালিকানাধীন কর্ষিত উর্বরা জমি, যার থেকে রাষ্ট্রের প্রভূত অর্থ আয় হত।
  • (গ) ব্যক্তিগত মালিকানার কৃষি জমি, যার থেকে রাজা রাজস্ব বা কর পেতেন।

গুপ্ত যুগে অগ্ৰহার প্রথা

রাজা ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দান করতেন। একে অগ্রহার দান বলা হত। আইনত গ্রহীতার মৃত্যু হলে রাজা এই জমি ফেরত পেতে পারতেন। কার্যত গ্রহীতার পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে অগ্রহার ভূমিদান ভোগ করত। গুপ্ত যুগে সামন্ত প্রথার অস্তিত্ব ছিল।

গুপ্ত যুগে রাজস্ব ব্যবস্থা

ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ জমি মালিক, প্রজা বা কৃষকের দ্বারা জমি আবাদ করিয়ে ১/২ অথবা ১/৫ অংশ ফসল নিত, বাকি প্রজা বা কৃষক পেত। সামস্ত প্রথার ফলে কৃষির উন্নতি অব্যাহত ছিল না।

গুপ্ত যুগে উৎপন্ন ফসল

জমিতে ধান, গম, আখ, আম, অন্যান্য ফল, বাঁশ প্রভৃতি জন্মাত। বাংলাদেশ আখ বা গুড় বা চিনির জন্য বিখ্যাত ছিল। গুড়ের জন্যই বাংলার নাম গৌড়ফা-হিয়েন -এর মতে, পূর্ব ভারতে ধানের চাষ এবং পশ্চিম ভারতে গমের চাষ বেশী হত। ভারতে কৃষি পণ্যের প্রভূত ফলন হত। বাংলার চিনি পশ্চিম ভারত -এ গুজরাট ও দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত রপ্তানি হত।

গুপ্ত যুগে জলসেচ ব্যবস্থা

জমিতে জলসেচের জন্য খাল ও নদী বাঁধ বা হ্রদ খোদাই করা হত। স্কন্দগুপ্ত গুজরাটের বিখ্যাত জলসেচের কেন্দ্র সুদর্শন হ্রদের বাঁধ মেরামত করিয়েছিলেন। এছাড়া জলসেচের জন্য কূপ ও পুকুর খোঁড়া হত।

গুপ্ত যুগে বস্ত্র ও রেশম শিল্প

  • (১) গুপ্তযুগে বস্ত্র শিল্পের খুবই অগ্রগতি হয়েছিল। বারাণসী ছিল রেশম বস্ত্র তৈরির জন্য বিখ্যাত। মথুরায় কার্পাস বস্ত্র বয়ন করা হত। মসলিন, রেশম সূতী কাপড়, তাঁত কাপড়, পশমের কাপড় প্রচুর পরিমাণে এই যুগে তৈরি হত। চীন -এর সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলে ভারতের রেশম উৎপাদন ও রেশম রপ্তানি কমে যায়। ভারতে হূণ আক্রমণ -এর পর এই শিল্পে আরও মন্দা দেখা দেয়।
  • (২) রোমিলা থাপারের মতে, স্থল ও সমুদ্র পথে চীনা রেশম ব্যাপক আমদানী হলে ভারতীয় রেশম শিল্পে মন্দা দেখা দেয়। তখন একমাত্র ভারতীয় বাজারের ওপর নির্ভর করে রেশম শিল্পকে টিকে থাকতে হয়। তাই দেখা যায় পশ্চিম ভারতের বহু রেশম ব্যবসায়ী তাদের বৃত্তি ও বাসস্থান পরিবর্তন করে। কার্পাস বস্ত্রের বয়ন একটি বিরাট শিল্প ছিল। দেশের ভেতর এই বস্ত্রের বিরাট চাহিদা ছিল।

গুপ্ত যুগে অন্যান্য শিল্প

  • (১) অন্যান্য শিল্পের মধ্যে হাতির দাঁতের কাজ, পাথর খোদাই, ধাতু শিল্প বিশেষত লোহার কাজ, সোনা, রূপার গহনা তৈরির কাজ প্রভৃতিরও খুব চলন ছিল। এছাড়া কাঠের কাজ, পোড়ামাটির কাজও জনপ্রিয় শিল্প ছিল। গুপ্ত যুগে চর্ম শিল্পের বিস্তার ঘটে। চামড়ার পাদুকার ব্যবহার বাড়ে। চামড়ার তৈরি সৌখীন পাখা, বোতল, ঢাকনা প্রভৃতির ব্যবহার আরম্ভ হয়।
  • (২) গুপ্ত যুগের মাটির জিনিষে মাটির সঙ্গে অস্ত্র মিশিয়ে মাটির পাত্রগুলিকে আকর্ষণীয় করা হত। মণি-মুক্তা খোদাইয়ের সৌখীন কাজ, সোনা-রূপার অলংকার শিল্পীরা করত। এই যুগে মুক্তার হার বা মুক্তমালার উল্লেখ দেখা যায়।

গুপ্ত যুগে বাণিজ্য

এই যুগে রাজনৈতিক ঐক্য এবং দেশের সর্বত্র শান্তির জন্য অন্তর্বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বহির্বাণিজ্যেরও প্রভূত প্রসার ঘটেছিল। কুষাণ যুগ থেকে পশ্চিম ভারতের বন্দরগুলির মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে যে বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়, গুপ্ত যুগে তা অব্যাহত ছিল। অনেকে মনে করেন যে, গুপ্ত যুগের অসাধারণ বৈষয়িক সমৃদ্ধির মূলে ছিল রোমান বাণিজ্য।

গুপ্ত যুগের রপ্তানি দ্রব্য

ভারত থেকে রোমান সাম্রাজ্যে শুধুমাত্র রেশম রপ্তানি হত না। ভারতীয় জীবজন্তু যথা সিংহ, বাঘ, তোতা পাখি, ভালুক প্রভৃতিরও রোমে চাহিদা ছিল। চামড়া, পশুর লোম, হাতির দাঁতের দ্রব্য, মুক্তা, চন্দন কাঠ, নীল, লোহার জিনিষ, পাথর, সুগন্ধি দ্রব্য ভারত থেকে রপ্তানি হত। এছাড়া রান্নার মশলা, বিশেষত লঙ্কা, মরিচ পশ্চিম দেশে বিশেষভাবে রপ্তানি হত।

গুপ্ত যুগে নিগম প্রথা

প্রাচীন গুপ্ত যুগে গিল্ড বা নিগম প্রথা ছিল। বণিকরা তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য নিগম গঠন করত। কারিগররাও নিগম গঠন করত। নিগম প্রধার দরুণ কোনো বহিরাগত ব্যক্তি নিগমের বিনা অনুমতিতে বাণিজ্য বা শিল্পের কাজ করতে পারত না। নিগমের নিয়ম অনুসারে জিনিষপত্রের দরদাম স্থির করতে হত।

গুপ্ত যুগের মুদ্রা

ভারতে গুপ্তযুগের মুদ্রাগুলি পরীক্ষার ফলে দেখা যায়, প্রথম দিকে সেগুলি শক-কুষাণদের অনুকরণে তৈরি করা হত। রোমান মুদ্রার প্রভাবের কথা স্মিথ বলেছেন। গুপ্তযুগের শেষদিকে মুদ্রার মানের যথেষ্ট অবনতি হয়। এছাড়া গুপ্ত যুগে রৌপ্যমুদ্রার অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ লক্ষ্য করে কোশাম্বি গুপ্ত যুগে বাণিজ্যের প্রয়োজন কমে যায় বলে মনে করেন।

গুপ্ত যুগে সাধারণ লোকের আর্থিক দুরবস্থা

  • (১) অধুনা গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পণ্ডিতেরা দ্বিতীয় চিন্তা করছেন। তাদের মতে, গুপ্ত যুগে দুটি সমান্তরাল অর্থনীতি প্রচলিত ছিল। একদিকে বিশেষ শ্রেণী বিশেষত ক্ষত্রিয়, বণিক ও শাসক ব্রাহ্মণদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই স্বচ্ছল। তারা বিলাসে, আরামে, প্রমোদে সময় কাটাত।
  • (২) নগরের স্বচ্ছল অধিবাসীরাও আরামে, ভোগে ও বিলাসে জীবন কাটাত। বাৎসায়নের কামসূত্রে, কামন্দকের নীতিসারে এরূপ বিলাসী নগর জীবনের ছবি পাওয়া যায়। অপরদিকে সমাজের নীচু তলার লোকেদের অবস্থা এরূপ স্বচ্ছল ছিল এমন মনে করা যায় না। পুরাতন নগর যথা, পাটলিপুত্র, রাজগৃহ, শ্রাবস্তী ধ্বংসোন্মুখ হয়েছিল একথা ফা-হিয়েন বলেছেন।

উপসংহার :- ক্রমে প্রাচীন বাণিজ্য পথগুলির গৌরব অস্তমিত হয়। গুপ্ত যুগে গ্রাম ও জনপদগুলিই প্রাধান্য পাচ্ছিল। নগরগুলি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছিল। সম্ভবত হূণ আক্রমণের পর এই পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সুতরাং ৩৬৪ খ্রিস্টাব্দের পর গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লোপ পেতে থাকে।

(FAQ) গুপ্ত যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গুপ্ত যুগের সময় বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি ছিল?

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

২. কামসূত্র কার লেখা?

বাৎসায়ন।

৩. নীতিসার কার লেখা?

কামন্দক।

৪. কবিরাজ কার উপাধি ছিল?

সমুদ্রগুপ্ত।

Leave a Comment