ভারতে হুণ আক্রমণ

ভারতে হুণ আক্রমণ প্রসঙ্গে গুপ্তযুগে হুণ আক্রমণ, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত, হূণ আক্রমণ প্রতিরোধ, হূণ আক্রমণের প্রকৃতি, তোরমানের আক্রমণ, মিহিরকুলের আক্রমণ সম্পর্কে জানবো।

ভারতে হুণ আক্রমণ

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতে হুণ আক্রমণ
সময়কালগুপ্ত সাম্রাজ্য
হূণ নেতাতোরমান, মিহিরকুল
প্রতিরোধস্কন্দগুপ্ত
ভারতে হুণ আক্রমণ

ভূমিকা :- হূণ জাতি আদিতে মধ্য এশিয়ায় বসবাস করত বলে জানা যায়। পরে তারা চীন সীমান্তে বসবাস করতে থাকে। পরে হুণ জাতির একাংশ রাশিয়া পার হয়ে ইউরোপ অভিযান করে। হূণ জাতির অপরাংশ যার নাম ছিল এপথ্যালাইট বা সাদা হুণ তারা ভারত ও পারসিক সীমান্তে হানা দেয়। পারসিক সাম্রাজ্য হূণ আক্রমণে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে।

গুপ্তযুগে ভারতে হুণ আক্রমণ

  • (১) ভিটারি স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায় যে, গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্ত সর্বপ্রথম হুণ আক্রমণের সম্মুখীন হন। ভিটারি স্তম্ভলিপিতে স্কন্দগুপ্তের সঙ্গে হূণদের যুদ্ধের কোনো তারিখ দেওয়া নেই। হূণদের রাজার নামও দেওয়া নেই। তবে ভারতে সর্বপ্রথম হূণ আক্রমণের কথা এই শিলালিপি থেকে জানতে পারা যায়।
  • (২) গ্রীক ভ্রমণকারী কসমস ও চীনা দূত সুং ইয়ুনের রচনা হতে হুণদের সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়। হুণরা ছিল ঘোরতর রক্তপিপাসু ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, পরাস্ত নির্বিচারে সকলকেই হত্যা করত। কিংবদন্তি আছে যে, যেদিকে হুণ সেনা চলত মাংসভোজী পশু-পাখী নরমাংসের লোভে তাদের পিছু পিছু চলত।

গুপ্তযুগে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত

  • (১) গুপ্ত সম্রাটরা ভারতের ভেতরে রাজাজয়ে নজর দেন একথা সত্য। কিন্তু তারা ভারতের আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে দৃঢ়ভাবে রক্ষার কোনো ব্যবস্থা করেননি। তাঁরা সিন্ধু উপতাকার ওপর, বিশেষত পাঞ্জাব ও গান্ধার -এর উপর দৃঢ়ভাবে ক্ষমতা স্থাপন না করার ফলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত উন্মুক্ত হয়ে যায়।
  • (২) রোমিলা থাপার বিষয়টি অন্য দিক থেকে বিচার করেছেন। তার মতে, সমুদ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিমের মালব, অর্জুনায়ন, যৌধেয় প্রভৃতি উপজাতিদের পরাস্ত করে তাঁর করদ রাজ্যে পরিণত করে ভুল করেন।
  • (৩) এই যুদ্ধপ্রিয় উপজাতিদের তিনি যদি অক্ষুণ্ণ রাখতেন তারা পরবর্তীকালে হূণ আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারত। যেভাবেই হোক, গুপ্ত সম্রাটদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতির দুর্বলতার সুযোগে হুণরা ভারতে ঢুকে পড়ে।

গুপ্তযুগে হুণ আক্রমণ প্রতিরোধ

স্কন্দগুপ্ত অবশ্য খুবই সাহসী ও কুশলী সেনাপতি ছিলেন। তিনি হূণ আক্রমণকে প্রতিহত করেন। এর ফলে হূণ আক্রমণের প্রধান তরঙ্গ ভারত সীমান্ত হতে ব্যাহত হয়ে ফিরে যায়। এজন্য ডঃ মজুমদার স্কন্দগুপ্তকে “ভারতের রক্ষাকারী” (Savior of India) আখ্যা দিয়েছেন। কে. এম. পানিক্কর বলেছেন যে, স্কন্দগুপ্তের পরবর্তীকালে যে হূণ আক্রমণ হয় তা ছিল অপ্রধান। প্রধান আক্রমণকে স্কন্দগুপ্ত তাঁর সমরকুশলতার দ্বারা ফিরিয়ে দেন।

গুপ্তযুগে হূণ আক্রমণের প্রকৃতি

এখন একথা বলা হয় যে,

  • (১) যে হূণ শক্তি ভারত আক্রমণ করে তারা খুব শক্তিশালী ছিল না। অন্ততঃ হুণদের যে শাখা পারস্য আক্রমণ করেছিল তাদের তুলনায় খুবই শক্তিহীন।
  • (২) হুণদের মূল আক্রমণের পথ থেকে ভারত সীমান্ত দূরে থাকায় হূণরা খুবই অসুবিধা ভোগ করেছিল।
  • (৩) ভারত সীমান্তে পর্বতমালা থাকায় হুণদের প্রতিহত করা সহজ ছিল।

গুপ্তযুগে হূণ আক্রমণের সমালোচনার যৌক্তিকতা

কিন্তু এই সমালোচনাগুলির যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে। যেমন –

  • (১) কত সংখ্যক হূণ স্কন্দগুপ্তের বিরুদ্ধে এসেছিল তা না জেনেই বলা হয়েছে যে, তারা খুব শক্তিশালী ছিল না। যেহেতু পারস্য সম্রাট ফিরোজ হুণদের হাতে পরাস্ত হন এবং স্কন্দগুপ্ত হূণ যুদ্ধে জয়লাভ করেন তাই বলা হয় এরা শক্তিশালী ছিল না।
  • (২) ভারত সীমান্তে পর্বতমালার অবস্থান চিরকাল আছে। যদি এই পর্বতমালা আলেকজান্ডার, ব্যাকট্রিয় শক্তি, কুষাণ প্রভৃতিকে প্রতিহত করতে না পারে তবে হূণদের ক্ষেত্রে তা আলাদা বাধা হতে পারে না।
  • (৩) সর্দার পানিক্করের অভিমতকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তার অভিমত হল যে, হূণরা ছিল প্রকৃতই শক্তিশালী এবং স্কন্দগুপ্ত রীতিমত কষ্ট করেই তাদের প্রতিহত করে ৫০ বছরের জন্য ভারতকে হূণ আক্রমণ হতে রক্ষা করেন।
  • (৪) যদি আমরা বিচার করি যে, স্কন্দগুপ্তের পরে তোরমান ও মিহিরকুলের নেতৃত্বে হূণরা পুনরায় ভারতে ঢুকেছিল সেজন্য স্কন্দগুপ্ত দায়ী ছিলেন না। পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটরা সীমান্ত রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না করায় তোরমান ভারতে ঢুকতে পারেন।

তোরমানের নেতৃত্বে হূণ আক্রমণ

স্কন্দগুপ্তের পরে ভারতে হূণ আক্রমণের কথা আমরা তোরমানের মুদ্রা, চীনা সূত্র ও গুপ্ত শিলালিপি থেকে জানতে পারি। উত্তরপ্রদেশ, মালব, পাঞ্জাবে “তোরমানশাহী” মুদ্রা আবিষ্কার থেকে প্রমাণ হয় যে, এই সকল অঞ্চল তিনি গুপ্তদের কাছ থেকে জয় করে নেন। তিনি ‘মহারাজা’, ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি নেন। অনেকে মনে করেন যে, মালবের গুপ্ত শাসনকর্তা ভানুগুপ্ত ও তার সামন্ত গোপরাজ তোরমানকে হঠিয়ে দেন।

মিহিরকুলের নেতৃত্বে হূণ আক্রমণ

  • (১) তোরমানের পর যে বিখ্যাত হূণ বিজেতা ভারতে হূণ অনুপ্রবেশের পথ তৈরি করেন তার নাম ছিল মিহিরকুল। অনেকে বলেন যে, মিহিরকুল প্রকৃতপক্ষে ভুল ছিলেন কিনা তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কলহণের রাজতরঙ্গিনীতে মিহিরকুলের নিষ্ঠুরতার বিবরণ পাওয়া যায়।
  • (২) মিহিরকুল পাঞ্জাব জয় করে মালব জয় করেন। হিউয়েন সাং -এর মতে, তিনি সারা ভারত জয় করেন। সম্ভবতঃ এই মন্তব্যে অতিশয়োক্তি আছে। মিহিরকুল মালব অধিকারের চেষ্টা করলে মালবের গুপ্ত সামন্ত যশোধর্মণ তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন।

উপসংহার :- গুপ্ত সাম্রাজ্য ও ভারত ইতিহাসের ওপর হূণ আক্রমণের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। স্কন্দগুপ্তের পর গুপ্ত সাম্রাজ্য যেরূপ দুর্বল হয়ে পড়ে হূণ আক্রমণের আঘাতে তার পতন ত্বরান্বিত হয়।

(FAQ) ভারতে হুণ আক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন গুপ্ত রাজার আমলে প্রথম হূণ আক্রমণ ঘটে?

স্কন্দগুপ্ত।

২. কোন গুপ্ত রাজা হূণ আক্রমণ প্রতিরোধ করেন?

স্কন্দগুপ্ত।

৩. ভারত অভিযানকারী দুজন হূণ রাজার নাম লেখ।

তোরমান ও মিহিরকুল।

৪. ভারতের এটিলা কাকে বলা হত?

হূণ নেতা মিহিরকুল।

Leave a Comment