গুপ্ত যুগের শিল্পকলা

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে গুপ্ত শিল্পকলার প্রকৃতি, অজন্তার শিল্প ভাস্কর্য, বাঘগুহা বিহার, মন্দির স্থাপত্য, মন্দিরের অংশ, মন্দিরের শ্রেণিবিভাগ, দশাবতার মন্দির, মন্দিরের বৈশিষ্ট্য, দ্রাবিড় রীতি, ভাস্কর্য শিল্প, চিত্রকলা ও ধাতু শিল্প সম্পর্কে জানবো।

ভারতের গুপ্ত যুগের শিল্পকলা

ঐতিহাসিক ঘটনাগুপ্ত যুগের শিল্পকলা
সাম্রাজ্যগুপ্ত সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতাশ্রীগুপ্ত
শ্রেষ্ঠ রাজাসমুদ্রগুপ্ত
শকারিদ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
গুপ্ত যুগের শিল্পকলা

ভূমিকা :- ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেছেন যে, “স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা এই তিনটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত শিল্পকলার অসাধারণ বিকাশ গুপ্তযুগে ঘটেছিল। গুপ্ত যুগের মনীষা যেন সহস্ৰ শাখায় বিকশিত হয়ে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্পের ডালিকে ভরিয়ে দেয়।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলার প্রকৃতি

শিল্পের ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগের অগ্রগতি তার সাহিত্যিক অগ্রগতির মতই বিস্ময়কর ছিল। গুপ্ত যুগে স্থাপত্য শিল্পের নতুন যুগ আরম্ভ হয়। আগের যুগের স্থাপত্য ধারার সঙ্গে গুপ্ত যুগের নব ধারা মিশিয়ে তাকে এক বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয়। এই বৈশিষ্ট্যের ছাপ দেখা যায় গুপ্ত যুগের গুহামন্দিরগুলির নির্মাণ কৌশলে। অজন্তা ইলোরা, বাঘ গুহার নির্মাণে পাহাড় কেটে চৈত্য ও বিহার তৈরির কৌশল গুপ্ত যুগে আবিষ্কার করা হয়।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা দৃষ্টান্ত অজন্তার শিল্প ভাস্কর্য

  • (১) অজন্তায় মোট ২৮টি গুহার মধ্যে পাঁচটি গুপ্ত পূর্ব যুগের বলে মনে করা হয়। বাকি ২৩টির মধ্যে ২১টি বৌদ্ধ বিহার এবং ২টি চৈত্য। এই গুহাগুলিকে এখন ক্রমিকভাবে নম্বর যুক্ত করে উল্লেখ করা হয়।
  • (২) ২৬ নং গুহা চৈত্যটি বেশ প্রশস্ত ও ভাস্কর্যমণ্ডিত এবং একটি বুদ্ধমূর্তি ঝোলান পা-যুক্ত অবস্থায় তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য ভঙ্গিমায় বসা অথবা দাড়ানো বুদ্ধমূর্তিও এই গুহায় আছে। পাথর কেটে ভাস্কর্যের কাজ বেশ উচ্চমানের।
  • (৩) অজন্তার বিহারগুলির মধ্যে ১১ নং গুহা বিহার সম্ভবত প্রাচীনতম। এই গুহার কেন্দ্রে একটি প্রশস্ত কক্ষ বা হল ঘর চারটি থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ১, ২, ১৬, ১৭ নং গুহায় দেওয়ালের চিত্রশিল্প জগৎ-বিখ্যাত। যদিও চিত্রগুলি ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত, কিন্তু নরনারীর দৈহিক সৌন্দর্য এবং মানসিক ভাবের অসাধারণ প্রকাশ এই সকল চিত্রে দেখা যায়।
  • (৪) ১, ২, ১৬, ১৭, ১৯ নং গুহার চিত্রের অনেকগুলি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। গৌতম বুদ্ধ -এর জীবন কাহিনী ও জাতকের গল্প নিয়ে প্রধানত চিত্রগুলি আঁকা। পশু, পাখি, রাজা, রাজপ্রাসাদ, কৃষক পূর্ণভাবে এখানে উপস্থিত। এখানে বোধিসত্ত্ব পদ্মপানি অবলোকিতশ্বরের ত্রিভঙ্গ মূর্তির চিত্রটিকে অনেক সমালোচক সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন।
  • (৫) মূর্তির মাথায় হীরা-মুক্তা খচিত মুকুট, মুখে বেদনার করুণাঘন প্রকাশ, দৃষ্টিতেও করুণা ও বেদনা ঝরে পড়ছে। দৃষ্টি অবনত। মূর্তিটি একটি তরুণ যুবকের শরীর নিয়ে চিত্রিত। বোধিসত্বের ভাবে মহাযান শাস্ত্রে বলা হয় যে, জগত বাসীকে দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে তিনি ত্রাণ করবেন। এই মূর্তিতে মনে হয় মানুষের বেদনার তিনি অংশভাগী। আর একটি চিত্রও বিখ্যাত। ভিক্ষুবেশে বুদ্ধ তার পূর্বাশ্রমের পত্নী গোপা ও পুত্র রাহুলের কাছে ভিক্ষা চাইছেন।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলার নিদর্শন বাঘ গুহা বিহার

  • (১) মধ্যপ্রদেশে বাঘ গুহার বিহারে ৯টি গুহা আছে। এই বিহারের কেন্দ্রীয় কক্ষের আয়তন ১৬ বর্গফুট। এই বিহারে ভাস্কর্যমণ্ডিত একটি বারান্দা আছে যা এই বিহারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাঘ গুহার বারান্দার দেওয়ালে চিত্রশোভা দেখা যায়।
  • (২) চিত্রশৈলী অনেকটা অজন্তার ধরনে এবং বিষয়বস্তু বুদ্ধের জীবন কাহিনী। যেখানে অজন্তার চিত্রগুলি নিরাসক্তি ও বৈরাগ্যের সুরে বাঁধা সেখানে বাঘ গুহার চিত্রগুলি অনেক বেশী পার্থিব, মানবিক।
  • (৩) বাঘের হাতির শোভাযাত্রার দৃশ্য অতীব বিস্ময়কর। ভূপালের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গুহা মন্দির উদয়গিরি সমগ্র একটি পাহাড় কেটে তার বাইরের দিকে পাহাড় অক্ষুণ্ণ রেখে ভেতরে মন্দির তৈরি করা হয়।
  • (৪) গুহার ভেতরের ছাদগুলিকে ধরে রাখার জন্যে খোদাই করা থাম রাখা হয়। উদয়গিরির রাণী গুফা গুহাটি এখনও ভাল অবস্থায় আছে এবং এটিই বৃহত্তম। এই বিহারের থামযুক্ত বারান্দা আছে।

প্রাচীন গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে মন্দিরের স্থাপত্য

  • (১) গুপ্ত যুগে মন্দির স্থাপত্যের বিশেষ শৈলী রচিত হয়। গুপ্ত যুগের আগে কোনো হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়নি। একমাত্র পাহাড় কেটে গুহামন্দির তৈরি করা হত। মন্দির তৈরির জন্য ইট, পাথর প্রভৃতি স্থায়ী উপকরণ এর আগে ব্যবহার হত না। গুপ্ত যুগেই সর্বপ্রথম পাথর বা ইটের তৈরি মন্দির নির্মাণ আরম্ভ হয়।
  • (২) মন্দির নির্মাণের জন্য এক বিশেষ স্থাপত্য শৈলী আবিষ্কৃত হয়। মন্দিরের চত্বরের চতুর্দিকে প্রশস্ত উঠান ও প্রাচীর থাকত। গুপ্ত যুগের মন্দিরের এই স্থাপত্য শৈলী মোটামুটি এখনও চালু আছে। গুপ্ত যুগেই সর্বপ্রথম মন্দিরের চূড়া উঁচু করে তৈরি করার চলন হয়।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে মন্দিরের অংশ

প্রতি মন্দিরের তিনটি অংশ থাকত। যথা –

  • (১) সিংহ দরজা পার হয়ে প্রশস্ত অঙ্গন;
  • (২) অঙ্গনের পর নাটমন্দির, যেখানে ভক্তজন সমবেত হত;
  • (৩) গর্ভগৃহ, যেখানে বিগ্রহ অধিষ্ঠিত থাকত। গর্ভগৃহকে নিয়ে যে মন্দির তা নাটমন্দিরের সঙ্গে প্রশস্ত অলিন্দ দ্বারা সংযুক্ত থাকত।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে মন্দিরের শ্রেণিবিভাগ

গঠনভঙ্গির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অধ্যাপক সরসী কুমার সরস্বতী গুপ্তযুগের মন্দিরগুলিকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন, যথা –

  • (১) সমতল ছাদের বর্গক্ষেত্র মন্দির ও মণ্ডপ। যথা – সাঁচির বিষ্ণু মন্দির, তিগওয়ার বিষ্ণু মন্দির, এরণের বরাহ মন্দিরের গঠন এই রীতিতে হয়। সাঁচির বিষ্ণুমন্দিরে আলো-ছায়ার সুষম বণ্টন লক্ষণীয়।
  • (২) সমতল ছাদের বর্গক্ষেত্র মন্দির, কিন্তু গর্ভগৃহের চারপাশে পরিক্রমার জন্য অলিন্দ এবং সামনে মন্ডপ, যথা – নচনা কুঠারার পার্বতী মন্দির, ডুমারার শিবমন্দির, মেগুতির বিষ্ণুমন্দিরের কথা বলা যায়।
  • (৩) নিচু শিখর যুক্ত বর্গক্ষেত্র মন্দির, যথা – দেওগড়ের দশাবতার মন্দির, ভিতারগাঁওয়ের ইষ্টক মন্দির, আইহোলের দুর্গা মন্দির।
  • (৪) মাঝখানে উঁচু দুধারে ঢালু অর্থাৎ ধনুকের আকারের ছাদযুক্ত আয়তক্ষেত্র মন্দির এবং মন্দিরের পিছন দিক অর্ধবৃত্তের মত। সোলাপুরের তের মন্দির এবং কৃষ্ণা জেলার কপোতেশ্বর মন্দির এই শ্রেণীতে পড়ে। এই মন্দিরগুলি আয়তনে ছোট। সম্ভবত বৌদ্ধ চৈত্যগুলিকে মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়। এই মন্দিরগুলির শিল্প স্থাপত্য অকিঞ্চিৎকর।
  • (৫) বৃত্তাকৃতি মন্দির যার চার কোণে কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে থাকত। মণিনাগের মন্দির এই পর্যায়ে পড়ে। সম্ভবত চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর মন্দিরগুলিতে গুপ্ত স্থাপত্যের মৌলিক চিহ্ন নেই।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলার নিদর্শন দশাবতার মন্দির

দেওগড়ের দশাবতার মন্দির পাথরের তৈরি ও পাথরের দেওয়ালে ভাস্কর্যের কাজ। এই মন্দিরের শিখর বা ধ্বজা ৪০ ফুট উঁচু। মন্দিরটি উঁচু প্রশস্ত বেদী বা দেবী পটের ওপর স্থাপিত। দেওগড়ের মন্দিরের নির্মাণ কাল অনেকের মতে ষষ্ঠ শতাব্দী। গুপ্ত স্থাপত্যের ছায়ায় এই মন্দির তৈরি হয়।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলার দৃষ্টান্ত ভিতার-গাঁওয়ের মন্দির

ভিতার-গাঁওয়ের মন্দিরের সঠিক সময় জানা যায়নি। ডঃ সরস্বতীর মতে, এই মন্দির গুপ্ত যুগেই তৈরি হয়। ভিতারগাঁওয়ের মন্দিরে গর্ভগৃহের গায়ে একটি পার্শ্ব প্রকোষ্ঠ দেখা যায় এবং গর্ভগৃহের সঙ্গে সংযোগের পথ আছে। এই মন্দিরের নির্মাণে বুদ্ধগয়ার মহাবোধি বিহারের প্রভাব দেখা যায় বলে তিনি মনে করেন। এই মন্দিরের শিখরটি পিরামিডের মত।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে মন্দিরের বৈশিষ্ট্য

এই সময় নির্মিত মন্দির গুলির বৈশিষ্ট্য হল –

  • (১) তার গঠনের মাল মশলা-পাথর, ইট প্রভৃতি মজবুত ও স্থায়ী দ্রব্যে;
  • (২) তিন মহলা মন্দির, (ক) সিংহ দরজা, (খ) মণ্ডপ, (গ) মূল মন্দির;
  • (৩) মন্দিরের ভেতর অলিন্দ, অঙ্গন পরিক্রমা পথে;
  • (৪) চূড়া বা শিখরে;
  • (৫) সমতল ও ঢেউ খেলানো ছাদে দেখা যায়।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে দ্রাবিড় রীতি

এই মন্দির স্থাপত্যে দ্রাবিড় রীতি ও নাগর রীতির প্রভাব লক্ষ্যণীয়। উচ্চ গৃহ নাগর রীতির পরিচয় দেয়। মন্দিরগুলির উপরতলার সঙ্কীর্ণতা দ্রাবিড় রীতির আভাষ দেয়। মন্দিরের ভাস্কর্যও দ্রাবিড় রীতির পরিচায়ক।

ভারতের গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে ভাস্কর্য শিল্প

  • (১) গুপ্ত যুগের ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত হয়ে, সম্পূর্ণ ভারতীয় শৈলীতে এই ভাস্কর্য এক অসাধারণ শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছে যায়। এই যুগের মথুরা ও অমরাবতীর ভাস্কর্যশৈলী একটি পরিণতিতে পৌঁছে যায়।
  • (২) গান্ধার শিল্প কুষাণ যুগে পূর্ণতা পেয়েছিল এবং তাতে গ্রীক ও রোমান প্রভাব ছিল। গান্ধার শিল্পরীতির স্থূলত্ব ও যান্ত্রিকতা গুপ্ত শিল্পীদের সৃজনীশক্তি অতিক্রম করে যায়। মথুরা শিল্পরীতির পার্থিবতা ও বেঙ্গী বা অমরাবতী শৈলীর ইন্দ্রিয়তা অতিক্রম করে গুপ্ত ভাস্কর্য এক অতিন্দ্রিয় স্তরে পৌঁছে যায়।
  • (৩) ডঃ নীহাররঞ্জন রায় ও ডঃ সরসী কুমার সরস্বতী গুপ্ত ভাস্কর্যে এই যুগের বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে দেখেছেন। ডঃ রায়ের মতে, সারনাথের বুদ্ধ মূর্তি অথবা গুপ্ত যুগের দেবদেবী মূর্তির গঠনে ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করা যায়।
  • (৪) দেবতাদের মূর্তি মনুষ্যাকারে নির্মিত। দেবতার বক্ষ কপাটের ন্যায়, দেব-দেবীর ওষ্ঠাধর মৃদুহাস্যে স্ফুরিত, চক্ষু অর্ধনিৰ্মিলীত। হৃদয়ে পরম জ্ঞানের উদয় হলে তবেই এমন হয়। দেবীদের অঙ্গুলি চাপা ফুলের ডগার মত ঈষৎ উঁচু, জানু কদলীকান্ডের মত, চক্ষু সফরী বা হরিণের মত ভ্রু যুগল বঙ্কিম।
  • (৫) ডঃ সরস্বতীর মতে, গুপ্ত যুগের শিল্পীরা তাদের রচনায় বাইরের সৌন্দর্যের সঙ্গে অন্তরের ভাবের মিলন ঘটান। এইভাবে শিল্পে অতীপ্রিয়তা ও আধ্যাত্মিকতা পরিলক্ষিত হয়। প্রাণী, উদ্ভিদ, মনুষ্য মূর্তি ছিল শিল্পের বিষয়বস্তু।
  • (৬) জায়বিক উত্তেজনা বাদ দিয়ে শান্ত সমাহিত রূপ-লাবণ্য এই মূর্তিতে বিকশিত। জীবনের গভীরতর ভাবে তা উদ্ভাসিত। শান্ত, সংযমের সঙ্গে মনোভাব প্রকাশের জন্য বিভিন্ন মুদ্রার ব্যবহার, দেহের বিভিন্ন ভঙ্গিগুলি লক্ষ্য করার মত। মুদ্রায় যেমন হাত ও আঙুলের ব্যবহার দেখা যায়, ভঙ্গে তেমন দেহের দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখা যায়।
  • (৭) বুদ্ধগয়ার মথুরা রীতিতে নির্মিত বুদ্ধমূর্তিটি বিশেষ বিখ্যাত। বুদ্ধগয়ার মূর্তি সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা জাগায়, সারনাথের বুদ্ধমূর্তি সূক্ষ্মতা ও রুচিবোধের পরিচয় দেয়। এছাড়া কোসমের শিব-পার্বতী রিলিফ, দেওগড়ের মন্দিরে রামায়ণ -এর রিলিফের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
  • (৮) সারনাথের থেকে দেওগড়ের মূর্তিগুলির পার্থক্য এই যে, সারনাথের মূর্তি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন আর দেওগড় পরস্পর সংযুক্ত। সারনাথে বুদ্ধের করুণাঘন, ধ্যানী রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এই বুদ্ধ-মূর্তির আধ্যাত্মিকতা বিশেষভাবে প্রকাশমান। মথুরার শিল্পেও এই আধ্যাত্মিকতার ভাব স্পষ্ট। যথা মনুবার কার্তিকেয় মূর্তি বা শিবমূর্তির কথা বলা যায়।
  • (৯) দেওগড়ের দশাবতার মন্দিরের অনন্ত শয্যায় বিষ্ণুর রিলিফের কাজ উল্লেখ্য। তবে সারনাথের তুলনায় মাজাঘষা কম ও উজ্জ্বলতা কম। মালবে ভিলসার উদয় গিরিতে বরাহ অবতারের রিলিফ বিশেষ বিখ্যাত। এখানে অরাজকতা ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে বরাহরূপী বিষ্ণুর প্রচণ্ড তেজ ও শক্তি যেন ফুটে উঠেছে। এই মূর্তি যেন মানুষের মনে আশা, বিশ্বাস সৃষ্টি করে।
  • (১০) ডঃ নীহাররঞ্জনের মতে, এই বরাহ মূর্তি খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকের ভাস্কর্যের সঙ্গে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকের বাদামি, ইলোরা ভাস্কর্যের যোগসূত্রের কাজ করছে। গুপ্ত যুগে দাক্ষিণাত্যের ভাস্কর্যে সারনাথের প্রভাব কিছুটা আইহোলের রিলিফ ভাস্কর্যে দেখা যায়।
  • (১১) দক্ষিণের নিজস্ব রীতি অনুযায়ী সারনাথের শাস্ত্র, ভাবের সঙ্গে দক্ষিণী নমনীয় নম্রভাব লক্ষণীয়। কানহেরির গুহা ভাস্কর্যে সারনাথের মৃদু প্রভাব দেখা যায়। সারনাথের তরল, কমনীয়, শান্ত ভাব এখানে অনুপস্থিত বলা যায়। মূর্তিগুলির ভঙ্গি কঠিন। বাদামি গুহার ভাস্কর্যেও ভামা বা কার্লের রীতির পূর্ণ বিকাশ দেখা যায়।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলার বর্ণনায় চিত্রকলা

  • (১) গুপ্ত চিত্রকলার অভূতপূর্ব বিকাশ অজন্তার গুহার গায়ে দেখা যায়। ১৬ ও ১৭ নং গুহায় কয়েকটি অসাধারণ চিত্র আছে। গুপ্ত যুগের চিত্রকলা ধর্মীয় বিষয়কে অতিক্রম করে মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে রচিত হয়।
  • (২) চিত্রগুলিতে বাস্তব জীবনের ছাপ বহুল পরিমাণে দেখা যায়। বুদ্ধের জীবনকে অবলম্বন করেও বহু প্রাচীর চিত্র আঁকা হয়। অজন্তা ছাড়া বাঘ গুহার চিত্রগুলির বর্ণ-সুষমা ও নর-নারীর দৈহিক সৌন্দর্য বিশেষ উল্লেখ্য।

গুপ্ত যুগের শিল্পকলা প্রসঙ্গে ধাতু শিল্প

প্রাচীন গুপ্ত যুগে ধাতুশিল্পের বিকাশও কম উন্নত ছিল না। দিল্লীর মেহেরৌলীতে রাজা চন্দ্রের নামে যে লৌহস্তম্ভ দেখা যায় তাতে কখনও মরিচা পড়েনি। এই স্তম্ভের মসৃণতা ও ঔজ্জ্বল্য দেখে প্রথমে এটি লোহার বলে অনেকে বিশ্বাস করতে পারে নি। গুপ্ত যুগের তৈরি ব্রোঞ্জ ও তামার মূর্তিগুলিও এই যুগের ধাতুশিল্পের উন্নতির পরিচয় দেয়।

উপসংহার :- অধুনা ডঃ ভার্গব নামক প্রত্নতত্ত্ববিদ এই অভিমত দিয়েছেন যে, মেহেরৌলীর লৌহস্তম্ভ ও কুতুবমিনার গুপ্তযুগেই তৈরি হয়েছিল। এই মিনারটি মানমন্দির হিসেবে কাজ করত। পরে সুলতানি যুগে ইলতুৎমিস এটিকে কুতবমিনার বলে নামকরণ করেন। এই মত এখন সকল ঐতিহাসিক স্বীকার করেননি।

(FAQ) গুপ্ত যুগের শিল্পকলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. অজন্তার গুহাচিত্র কোন সময়ে অঙ্কিত হয়?

গুপ্তযুগে।

২. গুপ্ত যুগে প্রতিটি মন্দিরে কতগুলি অংশ ছিল?

৩ টি।

৩. গুপ্ত যুগকে পেরিক্লীয় যুগের সাথে তুলনা করেন কে?

ঐতিহাসিক বার্ণেট।

৪. গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে?

সমুদ্রগুপ্ত।

৫. গুপ্ত যুগের শ্রেষ্ঠ কবি কে ছিলেন?

কালিদাস।

Leave a Comment