আসানসোল

আসানসোল কোন জেলায় অবস্থিত, আসানসোল কিসের জন্য বিখ্যাত, আসানসোলের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান ঘাঘর বুড়ি মন্দির, উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানবো।

এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান, সীমা, নাম বুৎপত্তি, শহরের প্রাচীনত্ব, জনসংখ্যা, আসানসোল পৌরসভা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ, আদিবাসী, শাক্ত সম্প্রদায়, জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম ধর্মের বিস্তার সম্পর্কে জানবো।

আসানসোল শহর

শহরআসানসোল
জেলাপশ্চিম বর্ধমান
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
দেশভারত
আসানসোল শহর

ভূমিকা :- ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম বর্ধমান জেলার একটি নগর ও পৌর নিগমাধীন অঞ্চল হল আসানসোল। এই শহর পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরাঞ্চল এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলার সদর।

আসানসোলের ভৌগোলিক অবস্থান

২৩.৬৮° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৬.৯৮° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে আসানসোল শহরটি অবস্থিত। সমুদ্র সমতল থেকে শহরটির গড় উচ্চতা হল ৯৭ মিটার।

শহর আসানসোলের সীমা

এই শিল্পনগরীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দামোদর ও অজয় নদ। আসানসোল উত্তর এবং পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড, পূর্বে বীরভূম জেলা এবং দক্ষিণে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলা দ্বারা বেষ্টিত।

আসানসোল নামের বুৎপত্তি

পশ্চিম বর্ধমান জেলার ‘আসানসোল’ নামটি সাঁওতালি ভাষা থেকে এসেছে। ‘আসান’ কথার অর্থ বড় গাছ এবং ‘সোল’ কথার অর্থ হল ধান চাষের যোগ্য ভূমি।

শহর আসানসোলের প্রাচীনত্ব

ঐতিহাসিক উৎস থেকে জানা গেছে আসানসোল গ্রামের বয়স ২৫০ বছর। আসানসোল খ্যাত ঘাঘরবুড়ি মন্দিরের ফলক থেকে ১৬২০ সালের উল্লেখ এই জনপদ-এর প্রাচীনত্বের প্রমাণ দেয়।

আসানসোলের জনসংখ্যা

বর্তমানে আসানসোল শহরটির জনসংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশ। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার থেকে আসানসোলের সাক্ষরতার হার বেশি।

দুর্গাপুর নিকটবর্তী আসানসোল পৌরসভা

১৮৮৫ অর্থাৎ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা বছরে জন্ম হয় আসানসোল পৌরসভার। ১৮৯৬ সালের পর থেকে এই পৌরসভার সক্রিয়তা আরো বাড়তে থাকে।

শহর আসানসোলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

আসানসোল শহরের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা উর্দু বিদ্যালয়, বি বি কলেজ, বিধানচন্দ্র কলেজ, মনিমালা গার্লস কলেজ, আসানসোল চেলিডাঙা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, শান্তিনগর বিদ্যামন্দির, মণিমালা গার্লস স্কুল ইত্যাদি।

আসানসোলের যোগাযোগ ব্যবস্থা

  • (১) দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহন নিগম কলকাতা এবং মালদা, শিলিগুড়ি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, সিউড়ি, পুরুলিয়া, বর্ধমান, কালনা, হাবড়া, ব্যারাকপুর, দীঘা, বোলপুর, কিন্নাহার, বহরমপুর এবং অন্যান্য অনেক গন্তব্যস্থলে দৈনন্দিন বাস পরিষেবা পরিচালনা করে।
  • (২) বিভিন্ন বেসরকারি বাস সংগঠন আসানসোল থেকে বর্ধমান, কল্যাণী, হাওড়া, বারাসাত ও বাঁকুড়া শহর -এ বাস পরিচালনা করে। আসানসোলের প্রধান রেল স্টেশন শহর আসানসোল জংশন। এই স্টেশন থেকে বহু স্থানে রেল সংযোগ রয়েছে।
  • (৩) উত্তর ভারত ও কলকাতার সঙ্গে সংযোগের প্রায় সমস্ত ট্রেন আসানসোলের সাথে সংযুক্ত। ফলে আসানসোল নতুন দিল্লি, জম্মু, অমৃতসর, লুধিয়ানা, এলাহাবাদ, কানপুর, লখনৌ, দেরাদুন, জয়পুর, কোটা, যোধপুর, জয়সালমির, গোয়ালিয়র, ভোপাল, ইন্দোর, পাটনা, রাঁচি এবং ধানবাদের মতো শহরগুলির সাথে চমৎকার সংযোগ স্থাপন করে।
  • (৪) মুম্বাই, আহমেদাবাদ, সুরাটের মত পশ্চিমী শহরগুলি এবং ভুবনেশ্বর, বিশাখাপত্তনম, বিজয়ওয়াড়া, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, তিরুবনন্তপুরমের মত শহরগুলির সঙ্গে রেল যোগাযোগ রয়েছে আসানসোল শহরের। রেলপথে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রধান শহর গুয়াহাটির সাথেও আসানসোল সংযুক্ত।

শহর আসানসোলের সড়কপথ

১৯ নং জাতীয় সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড আসানসোলকে অতিক্রম করেছে। এই সড়কটি পূর্বে কলকাতা এবং উত্তর-পশ্চিমে দিল্লিকে আসানসোলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১৪ নং জাতীয় সড়ক আসানসোল শহরকে দক্ষিণে ওড়িশা রাজ্যের সঙ্গে এবং উত্তরে ফারাক্কা ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছে। শহরটি সড়কপথে ধানবাদ, বাঁকুড়া, পাটনা, হলদিয়ার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে।

আসানসোলের রেলপথ

রেল পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু হল আসানসোল শহর। আসানসোল রেল বিভাগের স্টেশনগুলি হল অণ্ডাল, রাণীগঞ্জ এবং দুর্গাপুর। বর্ধমান-আসানসোল রেলপথ হাওড়া-দিল্লি প্রধান লাইনের একটি অংশ। অন্ডালের সঙ্গে আসানসোল এবং পরে জামশেদপুর, পুরুলিয়া ও খড়্গপুর থেকে বাঁকুড়া পর্যন্ত আরেকটি রেলপথ আছে।

শহর আসানসোলের আকাশপথ

আসানসোল মহানগরের অন্তর্গত বার্ণপুর শহরে দামোদর নদের তীরে একটি ব্যক্তিগত বিমানবন্দর রয়েছে। এই বিমানবন্দরটি ইস্কো ইস্পাত কারখানার মালিকানাধীন। বর্তমানে এটি ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হয়।

আসানসোলের আদিবাসী সম্প্রদায়

এই আসানসোলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আধিক্য যে রয়েছে তা ঘাঘরবুড়ি মন্দিরের নাম থেকেই বোঝা যায়। নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা অনুসারে আসানসোলের আদিবাসীরা হলেন নিগ্রোয়েড তথা প্ৰটোঅস্ট্রাল জাতি বা অস্ট্রিক জাতি।

শহর আসানসোলের জৈন ধর্ম

এই অঞ্চলে জৈন ধর্ম -এরও বিস্তার ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে জামুরিয়া, সালানপুর ইত্যাদি এলাকার মানুষরা এই জৈনধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়। এখানে এখনো জৈনধর্মে আস্থাশীল মানুষেরা বংশপরম্পরায় রয়েছেন।

আসানসোলের শাক্ত সম্প্রদায়

এই অঞ্চলে শাক্ত সম্প্রদায়ের আধিক্য দেখা যায়। জামুড়িয়ার নিকটবর্তী সিঙ্গারণ গ্রামে শ্মশান কালী পূজা, দেবী মনসা পূজা ও শিব গাজনের খ্যাতি চিরকাল রয়েছে।

শহর আসানসোলের বৌদ্ধ ধর্ম

কিছু সময় পরে বৌদ্ধ ধর্ম -এর প্রভাবও এই অঞ্চলে পড়তে শুরু করে। আসানসোলের বুধাগ্রামের যে নামকরণ তা বুদ্ধগ্রাম থেকেই এসেছে। এখানে এক প্রকার শিবপুজা হয় যার নাম বুদ্ধেশ্বর শিব, যা খুবই বিখ্যাত।

আসানসোলের ইসলাম ধর্ম

এই অঞ্চলে পীর, সুফি, ফকিরদের প্রভাবের ফলে ইসলাম ধর্মও বিস্তারিত হতে থাকে। চুরুলিয়া, বৈজুদ্দিপুর, পরিহারপুর, রহমতনগর, নিয়ামতপুর ইত্যাদি এলাকাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মাবলম্বী মানুষে বসতি গড়ে উঠেছে।

শহর আসানসোলের ঘাঘরবুড়ি মন্দির

ঘাঘরবুড়ি আদতে এই এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের আরাধ্যা দেবী। পরবর্তীতে অবশ্য ব্রাহ্মণ পরিবারের পূজাও ওই মন্দিরে হতে থাকে। ‘বাদনা’ নামক পরবে সাঁওতালরা এই মন্দিরে মিলিত হয় উপাসনার জন্য। এই ঘাঘরবুড়ি মন্দির আসানসোল মহানগরের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

আসানসোল সম্পর্কে জনশ্রুতি

জনশ্রুতি অনুসারে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু একবার পুরী যাত্রা করার সময় যাত্ৰা পথে দুষ্কৃতীরা তাঁর সমস্ত সম্পদ লুন্ঠন করেছিলেন। পরে হীরাপুর বাসিন্দা তাঁর প্রধান শিষ্য মানিকচাঁদ ঠাকুরের কাছে তিনি সব ফিরে পান।

স্বাধীনতা সংগ্রামে আসানসোলের ভূমিকা

স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ করে গান্ধীজীসত্যাগ্রহঅসহযোগ আন্দোলন -এর ঢেউ এসে লেগেছিল এই আসানসোলে। গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯২১ সালে এখানে গড়ে উঠেছিল কংগ্রেস সমিতি। আসানসোলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন গান্ধীজীর শিষ্য বিজয় পাল। বর্তমানে তাঁর নামে আসানসোলে একটি রাস্তা ও বি.এড কলেজ ও গড়ে উঠেছে।

আসানসোলের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব

শহর আসানসোল ও তার পাশাপাশি অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিখ্যাত গল্ফ খেলোয়াড় অর্জুন অটওয়াল, বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী বিবেক সিং প্রমুখ।

দুর্গাপুর নিকটবর্তী আসানসোলের দর্শনীয় স্থান

ঘাঘরবুড়ি মন্দির ছাড়াও আসানসোলের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান কল্যানেশ্বরী মন্দির। প্রায় বারোশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা বল্লাল সেন। এই কল্যাণেশ্বরী দেবীর নাম থেকেই মাইথন নামটির উৎপত্তি। ‘মাই কা থান’ (অর্থাৎ মা কল্যাণেশ্বরী দেবীর থান) থেকেই ক্রমে ছোট হয়ে মাইথন নাম প্রচলিত হয়। আসানসোলের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান হল কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত আসানসোল গ্রাম।

আসানসোলের উৎসব

শহর আসানসোলের অন্যতম প্রধান উৎসব গাজন। আগুরী সম্প্রদায় তথা উগ্র ক্ষত্রিয়দের অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে এটি বিবেচিত হয়। চৈত্র মাসে পাঁচদিন মহাসমারোহে এই গাজন উৎসব পালন করা হয়। তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষ তথা হাঁড়ি, ডোম, মুচি, বাউরী, বাগদি সকলেই এতে অংশ নেয়।

উপসংহার :- বহু বিস্মৃত ইতিহাসের মোড়কে ঢাকা শহর হল আসানসোল। শহরের অনতিদূরে বিহারীনাথ পাহাড়ের সৌন্দর্য পর্যটকদের চিরকালীন আকর্ষণের জায়গা আর শীতকালে ও বর্ষাকালে মাইথন বাঁধের সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেয় পর্যটকদের।

(FAQ) আসানসোল শহর সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আসানসোল শহরটি কোন জেলায় অবস্থিত?

পশ্চিম বর্ধমান।

২. পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরাঞ্চল কোনটি?

আসানসোল।

৩. কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান কোথায়?

আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্ৰামে।

৪. আসানসোলের অন্যতম প্রধান উৎসব কি?

গাজন।

৫. আসানসোলের আদিবাসীদের আরাধ্যা দেবী কে ছিলেন?

ঘাঘরবুড়ি।

Leave a Comment